সমস্যাটা তাহলে “পাশ্চাত্য সংস্কৃতি” নিয়ে ছিল না…

সুমিত রায়:

এতোদিন খুব দেশি সংস্কৃতি-দেশি সংস্কৃতি করা হচ্ছিল। ছোট পোশাক পরিহিতা নারীরা পাশ্চাত্য পোশাক পরে সাংস্কৃতিক দূষণ ঘটাচ্ছে, তাই এসব বর্জনীয় ও দেশীয় সংস্কৃতির সাথে যায় এমন পোশাকই পরবার যোগ্য এমন কথা আসছি একটা মহল থেকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টানিয়ে এইসব প্রচার করা হচ্ছিল।

কিন্তু এবারে যখন একজন নারী ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে, মানে একেবারে পূর্ণাঙ্গ দেশি পোশাক পরে রাস্তায় নামলো তখন সবাই আবার ট্রোলিং শুরু করলো। দাবি হচ্ছে, এগুলো অশ্লীল পোশাক! ঠিক এজন্যই এটার দরকার ছিল। ব্লাউজ নিজেই একটি পাশ্চাত্য ভিক্টোরিয়ান পোশাক, যা ব্রিটিশরা পাশ্চাত্য আধুনিকতার নামে এই দেশে ছড়িয়েছিল, কিছুটা বাণিজ্যিক প্রয়োজনও থেকে থাকবে। কিন্তু তার আগে বাংলার হিন্দু-মুসলিম নারীরা নির্বিশেষে এক কাপড়ের শাড়ি পরতো, কোন ব্লাউজ ছাড়া। আজ যারা এই পোশাককে অশালীন বলছে তাদের পূর্বপুরুষরাই এগুলো পরতো, কিন্তু তখন এগুলো অশালীন ছিল না, অশালীন হয়েছে আজ!

এটার দরকার ছিল, কারণ এর মাধ্যমেই ধরা পড়ে গেছে যে দেশি সংস্কৃতি – দেশি সংস্কৃতি করা গোষ্ঠিটির কাছে আদতে বিদেশি সংস্কৃতি কোন সমস্যা ছিল না, দেশি সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারেও তাদের তেমন কোন উদ্বিগ্নতা ছিল না। তাদের একটাই কনসার্ন ছিল, তা হলো কথিত অশালীনতার বিরোধিতা, তাদের দ্বারা মডেস্টির সংজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া, আর সেগুলোকেই দেশি সংস্কৃতির কথা বলে জাস্টিফাই করা। শালীনতা-অশালীনতা, শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে, সাধারণীকৃত করতে ও চাপিয়ে দেবার জন্য তারা দেশি সংস্কৃতির কার্ড খেলেছিল মাত্র। এভাবে এটাকে ধরিয়ে দেয়ার দরকার ছিল।

এর মাধ্যমে এও বোঝা গেল যে, দেশে একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা একদিকে যেমন দেশীয় সংস্কৃতির কার্ড খেলে নিজেদের শালীনতা-অশালীনতা সম্পর্কিত আদর্শগুলোকে সমাজে চাপিয়ে দিতে চায়, অন্যদিকে তারা তাদের শালীনতা-অশালীনতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকেই দেশীয় সংস্কৃতি ও বাঙ্গালিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, নিজেদের মতো করে বাঙ্গালিত্বের একটা ধারণা নির্মাণ করতে চায়, অন্যান্য বিষয়গুলোকে, যেমন ব্লাউজহীন শাড়িকে ক্যান্সেল আউট করতে চায় নিজেদের সংস্কৃতি থেকেই। এই শেষোক্ত উদ্দেশ্যটিই বেশি বিপজ্জনক, যা নিয়ে সচেতন হতে হবে।

অনেকে বলছেন, একসময় মানুষ অভাবের জন্য ব্লাউজ ছাড়া চলতো, এখন ফ্যাশনের জন্য পরছে, আর এটাই আপত্তিকর। কিন্তু এই দাবিতে সমস্যা আছে। সেটা বোঝার জন্য অন্য কিছু জিনিস নিয়ে আলোচনা করে আসতে হয়। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি তৈরি হয়েছে, তাই মানুষ ব্লাউজ পরা মানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুশীলন করা শুরু করেছে, গরিবদের টাকা ছিলনা তাই দেশি সংস্কৃতির চর্চা ধরে রেখেছিল।

আর এটা কেবল পোশাক না, সব ক্ষেত্রেই সত্য। গ্লোবালাইজেশনের ফলে মার্কেটে বিদেশি পণ্য এসেছে, কিন্তু ট্যাক্সেশন ও সরকারি পলিসির জন্য দাম বেশি, তাই অবস্থাপন্নরাই বিদেশি পণ্য ব্যবহার করি, গরিবরা পারে না, তাই দেশী পণ্য ব্যবহার করে। সেই সাথে টেস্টের ব্যাপার আছে। টাকা থাকলে এডুকেশন থাকে, টেস্ট ভালো হয়, বিদেশি পণ্যের কোয়ালিটি ভালো, তাই সেদিকেই মানুষ যায়, বাংলা সিনেমার বদলে হলিউড দেখে। গরিবদের টাকা থাকে না, ইংরেজি শিক্ষা থাকে না, টেস্ট তৈরি হয় না, তাই বাংলা সিনেমা দেখে। আমাদের মত গ্রোয়িং ইকোনমি, আমদানি নির্ভর দেশ আর ডেভলপিং কান্ট্রিতে তো গরিবরাই বেশি দেশি সংস্কৃতির চর্চা করবে, নাকি? এটাই তো স্বাভাবিক।

একটা সময় দেশে ব্লাউজ প্রচলিতই ছিল না। তখন পয়সাওয়ালারাও ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরতো। কেননা তখনও দেশি বাজারে পাশ্চাত্যের পণ্য আসেনি, ধনীরা সেগুলো বেশি দামে কিনতে শুরু করেনি, পোশাকের ফ্যাশন নিয়ে অন্তত ব্লাউজের দিক থেকে ক্লাস কালচারে ভিন্নতা তৈরি হয়নি। তাই গরিবরাই ব্লাউজ ছাড়া চলবে, ধনিরা ব্লাউজ পরবে এরকম সিচুয়েশন আসেনি, যা পরে এসেছে। আর এসব আলোচনা নির্বিশেষেই ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরিধান দেশি সংস্কৃতিই হচ্ছে।

কিন্তু ফ্যাশন কেবল সৃজনশীলতার মাধ্যমে তৈরি হয় না, নতুন উদ্ভবের মাধ্যমে হয় না, আর সবাই ক্লাস বা স্টেইটাস অনুযায়ী ফ্যাশন চর্চা করে না, পোশাক পরে না। ফ্যাশন অনেক সময় রোমান্টিক হয়, মানে স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে, পুরনো ট্রেন্ডগুলো এভাবে জনপ্রিয় হয়ে আসে। মানুষও কেবলমাত্র তার সামর্থ অনুযায়ী পোশাক পরে না, স্ট্যাটাস বা ক্লাস বুঝে পোশাক পরে না, অনেক সময় সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ, আন্দোলন, সিম্বলিজম ইত্যাদি পোশাক নির্বাচনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। এখন যেমন অনেকে পাশ্চাত্য সংগীত এভেইলেবল থাকার পরও দেশী সংস্কৃতিতে টানের জন্য লোকগীতির চর্চা করতে পারেন, তেমনি দেশি সংস্কৃতির চর্চা হিসেবে ব্লাউজ ছাড়া শাড়িও পরতে পারেন, এর সাথে পূর্বে মানুষ কোন পরিস্থিতিতে ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরতো, তার কোন সম্পর্ক নেই। আর একই কারণে এটি আপত্তিকরও হয় না।

নিচে ১৯৭৩ সালে ছাপানো একটি এক টাকার নোট দেয়া হলো, যেখানে একজন ব্লাউজহীন শাড়ি পরিহিতা নারীকে ধান ভাঙতে দেখা যাচ্ছে। পরে ছবিটিকে পরিবর্তন করে দেয়া হয়। তবে এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, ব্লাউজ ছাড়া শাড়িকে একসময় বাংলাদেশেও অশালীন ভাবা হতো না, এটা স্বাভাবিক পোশাক ছিল।

শেয়ার করুন: