‘সিডিউসার’ থেকে সাবধান! সকলে সমস্বরে বলো, আমরা মানুষ!

ফারদিন ফেরদৌস:

প্রিয় ভগিনী! প্রিয় মা!
আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন!
অনেক মেধার পরিচয় দিয়ে ওখানে নাম লেখাতে হয়েছে আমরা সবাই তা জানি। আপনাদের মেধার তারিফ আছে দেশজুড়ে।

কিন্তু আপনাদের বুদ্ধির তারিফ করবার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার সমস্ত বুদ্ধি কিনা বর্গা দিয়ে বসে আছে আধিপত্যের প্রতিভু নষ্ট পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে। আপনি একজন সিডিউসারের পাশে দাঁড়িয়ে কইতেছেন, ছোটো পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়!

নারী পণ্য হোক কোনো ফিলানথ্রপিস্ট কিংবা প্রোগ্রেসিভ মানুষই এটা চায় না। কিন্তু নারীর বিজ্ঞানী হতে যেহেতু বাঁধা নেই, তাই নারীর পোশাকের সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিজ্ঞান জুড়ে দেয়া পুরাই অর্বাচীনতা ও বাতুলতা।

যাদের কথায় নাচতে নাচতে ধর্মীয় ড্রেসকোড না মানা নারী ও পুরুষের ভাস্কর্যের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জনগুরুত্বহীন আজাইরা বিষয়কে ইস্যু করতে চাইছেন, তাদের মূল সমস্যা নিজেদের চিন্তার আড়ষ্টতায় ভোগা উগ্র ধর্ম।

যার সাথে সত্যিকারের ধর্মবোধের ন্যূনতম সম্পর্ক নাই। ধর্ম মানুষকে অধিকারবোধ শেখায়, খামোখা নারীর পোশাক নিয়ে পড়ে থাকে না।

দেশে এখন হাজারটা সমস্যা আছে, তার প্রতিবাদে আপনাদের মুখে ‘রা’ বের হয় না। আপনারা পড়ে আছেন ধর্ম আর বিজ্ঞান বিপরীতমুখী দুই ধারাকে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করানোয়। এই বাল্যখিল্যতা মধ্যযুগীয় চিন্তার চেয়েও বাজে অসারতা ও বড় অধঃপাত।

পোশাক নিয়ে যে ডায়ালগগুলো আপনারা দিচ্ছেন এটা পুরাই পুরুষতান্ত্রিক মগজপ্রসূত ভাবনা। নারী হিসেবে আপনারা নিজেকে যদি স্বাধীন সত্তাবান কোনো মানুষ ভাবতেন তাহলে প্রশ্ন তুলতেন, হে যুবক, তুমি ঘূর্ণাক্ষরেও আমার পাশে দাঁড়াইয়ো না। কারণ তোমার উদোম মুখশ্রী, নেকেড পা কিংবা সুদর্শন ন্যুড হস্ত মোবারক, খোলা লোমশ বুক আমাদেরকে ভীষণভাবে সিডিউস করে।

হে যুবক, তুমি আমার সাথে বাইরে এসে এক কাতারে দাঁড়াইয়ো না, কারণ তোমরা আমাদের মাহরাম না। আমাদেরকে গুণাহগার বানাইয়ো না হে গায়রে মাহরাম।

আপনারা যদি ধর্ম মানতেন তবে ঘরের বাইরে আসতেন না, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে পুরুষের নেতৃত্বে নিজেদেরকে নিয়ে যেতে চাইতেন না। নারী ও পুরুষের সহপাঠ স্কুলিং-এ কোনোদিনই নাম লেখাতেন না। পুরুষ টিচারকে বলতেন, আপনারা আমাদের ক্লাস নেবেন না। নারীর সামনে মুখ দেখাবেন না!আপাদমস্তক জিরাফের সাথে সন্ধি করে মোটাদাগের ধর্ম যেখানে মানতে পারতেছেন না, সেখানে ঠুনকো পোশাক নিয়ে পড়ে থাকা যুগপৎভাবে ভয়ানক গোঁড়ামি ও বোকামি।

যে বেটা ধর্মের জুজুকে সামনে রেখে লিঙ্গ দিয়ে ইথিক্স চিন্তা করে,
যে ছাওয়ালের মাথায় মগজের পরিবর্তে অবদমিত বিকৃত যৌনাচার ভরা,
যেই ছেলে নিজেই নিজেকে সিডিউসার বলছে;
আপনি নারী হয়ে ৭০ প্রস্থ কালো কাপড় পরবার পরও ওই কাপুরুষ আপনার জন্য বিপজ্জনক আছে এবং থাকবে। সুযোগ পেলেই তাদের লৈঙ্গিক রাজনীতির আগ্রাসন দেখাবে।

সবার আগে এইসব যৌন পারভার্টেডের কাছ থেকে সাবধান থাকুন। সতর্ক ও সচেতন হোন। নিজের বোধ ও সত্তাকে বাঁচান।

পোশাকের ভাবনা! সেতো অনেক পরের কথা। জানবেন, এইদেশের সামষ্টিক মানুষ অশালীন পোশাক পরে না, দেশবিরোধী পোশাকও গায়ে জড়ায় না। হিজাব কিংবা শাড়ি, পাঞ্জাবি কিংবা টি শার্ট; যার যার অবস্থানে সবাই সঠিক আছে। কেউ কারো মাথাব্যথার ন্যূনতম কারণ না।

পোশাক নামের সিলি ইস্যুতে আরেকবার রাস্তায় দাঁড়ানোর আগে,
পুরুষের নোংরা মগজ দিয়ে নারীত্বকে বিচার করবার আগে,
নারীদের জন্যে এক অন্ধকার সময় ডেকে আনবার আগে,
মানুষের মুক্তির কথা স্তব্ধ করে দেয়ার আগে,
প্লিজ একবার পড়ুন, ফরাশি দার্শনিক ও নারীবাদের আইকন সিমোন দ্য বোভোয়ারের মহত্তম গ্রন্থ ‘ল্য দ্যজিয়েম সেক্স’ বা দি সেকেন্ড সেক্স।
জানুন পুরুষের প্রভুত্ব ও পক্ষপাতিত্ব। ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে’, পিতৃতন্ত্র ছাঁচে ঢালাই করে উৎপাদন করে একটি উপভোগ্য বস্তু: নারী।

প্লিজ একশ’ বছর আগের মানুষ বেগম রোকেয়াকে একবার ছুঁয়ে দেখুন…
“ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ”।

লেখক: সাংবাদিক
২৬ আগস্ট ২০২২

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.