সুযোগ থাকার পরেও কেন অত্যাচার সহ্য করে নারী?

মুসাররাত নাজ:

ঘটনা ১
একজন নারী যিনি শিক্ষিত। চাকরি করছেন। তিনি নিজের ইচ্ছেতে কোনো সাধারণ কেনাকাটাও করতে পারেন না। উনার স্বামী খুবই রাগী মানুষ। তাই স্বামী রেগে যাবেন এমন কাজ তিনি করতে চান না।

ঘটনা ২
তিনি একজন নারী, যার একটা পিএইচডি ডিগ্রি আছে। চাকরি করছেন। চড়া বেতনের চাকরি করেন। স্বামীও খুবই ভালো একটা চাকরি করেন। প্রতিটা ঈদ করেন শ্বশুরবাড়িতে। একবার তাদের সন্তান বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, এবারের ঈদে গ্রামে না গেলে হয় না? এতেই ভদ্রলোক ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। এবং চেয়ার উঠিয়ে ডাইনিং টেবিলে ছুঁড়ে মারেন। টেবিলের গ্লাস ভেঙে চুড়ে একাকার। আর বাদবাকি বিষয়ে তিনি কী কী করেন কে জানে!

ঘটনা ৩
আরেকজন নারী নিজে একটা মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করেন। স্বামীও খুবই ভালো আয় রোজগার করেন। স্বামীর কথা হচ্ছে ওই নারীকে চাকরি ছাড়তে হবে। বাধ্য হয়ে তিনি চাকরি-বাকরি ছেড়ে ঘরে বসে থাকলেন। এবং কয়েকমাস পরেই শুনলেন ঘরে বসে বসে খাও। আরামেই তো থাকো।

ঘটনা ৪
নারীটির স্বামীর চরিত্রে দোষ আছে। নানা বয়সী নারীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক করা হবি। ওদের পিছনে টাকা ঢালতে হিসেব করে না। এসব জেনে ওই স্ত্রী তার স্বামীকে কিছু বললেই মারধর জোটে। তবুও তিনি সহ্য করে যান। সন্তান আছে এই দোহাই দেন।

ঘটনা ৫
এরেঞ্জড ম্যারেজ। মেয়েটি জয়েন্ট ফ্যামিলিতে স্বামীর সাথে বাস করে। শ্বশুর বাড়ির প্রতিটি লোক মেয়েটির উপর অত্যাচার করে। প্রতিটি কাজে বাধা, অপমান, অশান্তি। মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। মেয়েটি যায় না। দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করে।

ঘটনা ৬
বিয়ের তৃতীয় দিনের মাথাতেই খুব করে পিটানো হয়েছে মেয়েটিকে। অন্যান্য অশান্তি যেমন তেমন, এই মারধরের পরিমাণটাই বেশি। এখন আবার স্বামী এবং তার পরিবার মিলে চাকরি ছাড়ার জন্যে তাড়া দিচ্ছে।
এই মারধরের ইতিহাসের পরেও ওই মেয়েটি চাকরিতে রিজাইন দিয়েছিলেন। তবে পরেরদিন অফিসে যেয়ে তা আবার প্রত্যাহার করে নেন।

ঘটনা ৭
এটা টিভি বা নিউজ দেখেন যারা সবাই জানেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা মেয়ে ১০ তলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছে। সুইসাইড নোটে লিখে গেছে বাবার শারীরিক মানসিক অত্যাচারের কথা। এবং লোকটা চারিত্রিকভাবেও দুশ্চরিত্র। রেপিস্ট। মেয়েটির মা কেন এতো দীর্ঘদিন ধরে এমন অত্যাচারী চরিত্রহীন পুরুষের সাথে সংসার করলো? মেয়েটির মা এবং নানীর যে ভিডিও দেখা গেছে সেখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে লোকটা শুরু থেকেই অত্যাচারী।

এমন অসংখ্য ঘটনা জানা যায়। নারী তার পারিবারিক সাপোর্ট না থাকায় অথবা নারী স্বেচ্ছায় অত্যাচার সহ্য করেই যাচ্ছে। যারা বলেন, যাবার জায়গা নেই, থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই বলে অত্যাচার সহ্য করে যায় নারী, তাদের উপরোক্ত কয়েকটা ঘটনাবলী থেকে প্রশ্ন করতে পারি, যে নারীরা শিক্ষিত, উপার্জনক্ষম এবং পরিবার থেকেও সাপোর্ট পাচ্ছেন, তারা কেন সংসারটা করছেন? সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই সব সময় সমাধান না। তাই বলে প্রতিবাদটুকুও করবে না নারী? কেন জানি না আমার মনে হয় তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই অত্যাচারিত হয়। আর বাবা-মায়েদের হিসাবটা হলো মেয়ের ডিভোর্স হলে সম্মানহানি হয়, কিন্তু মেয়ের অত্যাচারে তাদের সম্মানে একটুও আঁচ লাগে না। আবার সেই মেয়েই যদি আত্মহত্যা করে ফেলে, তখন বলে ওরা জানতেন না। জানলে এমন ঘটতে দিতেন না।

আমার ধারণা বেশিরভাগ নির্যাতিতাই তার ওপরে নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে না লোকলজ্জায়। চাচা মামার কাছে মুখ থাকবে না, পাড়ার লোকে প্রশ্ন করবে, এই কথা ভেবে আপনি যদি অত্যাচার মেনে নেন সে আপনার ইচ্ছে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তবে অন্য কারও নির্যাতন থেকে রেহাই পাবার রাস্তা আপনি বন্ধ কর‍তে পারেন না। কর‍তে চাওয়াও উচিত না। জীবন পাড়ার লোক আর আত্মীস্বজনের টিকাটিপ্পনীর চাইতে অনেক বড়। সেই জীবনে সুখ না থাকলেও স্বস্তি থাকা বাঞ্ছনীয়।

তালাক প্রাপ্তার তকমা লাগবে এই সামাজিক লজ্জা? নাকি মানসিকভাবে দাসত্ব করার মনোভাব থেকে বের হতে পারেনি নারী? অথবা তার সহ্য ক্ষমতা এতো বেশি হয়ে গেছে যে ঠিক কোন সময়ে কতটা সহ্য না হলে অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসতে হয় সেই বুদ্ধিটাই লোপ পেয়ে গেছে? অনেক প্রশ্ন আসে মাথায়, কিন্তু হিসাব মেলাতে পারি না।

✍️মুসাররাত নাজ

শেয়ার করুন: