পূর্ণাশা অরোরা:
আমার স্কুল নালন্দা। নালন্দায় পড়তাম বলে নারী-পুরুষের বৈষম্য সহ্য করেছি অনেক বড় হয়ে। আমাদের মধ্যে কখনও ছেলে-মেয়ে বিভেদ করা হয়নি। আমাদের স্কুল ইউনিফর্ম সবার একই, ছেলে-মেয়ে সবাই একই রকম ফতুয়া আর প্যান্ট পরতাম। আমাদের স্কুল থেকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেলে লোকে আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, একটা স্কুল- যেখানে ছেলে-মেয়েদের পোশাক একই!
আবার অনেকে তো আমাদের কোনো কোনো মেয়েদের এই বলে শাসিয়ে যেতো যে, “কেমন স্কুল তোমরা, মেয়েরা ওড়না পরে না, ছেলেদের মতো ফতুয়া-প্যান্ট পরে!” ছোটবেলায় যখন প্রথম এমন কথা শুনেছি তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, জবাব দিতে পারিনি। আমরা তো কখনও শিখিনি ছেলেমেয়ের মধ্যে তফাৎ আছে, তারা এক পোশাক পরতে পারবে না! এরপরে এমন কথা আরও শুনেছি, কথাগুলো দিনকে দিন কেবল তিক্ত হতেই শুনেছি। তবে পরের দিকে যখন কেউ এমন কথা বলতো, আমাদের ছেলে বন্ধুরাই গিয়ে তাদের বলে আসতো, “আমরা একই জামা পরি কারণ আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই এক, ইউনিফর্ম মানেই তো তাই!”
যখন জেএসসি-এসএসসি দিতে অন্য স্কুলে গিয়েছি, ওখানকার শিক্ষকরা পরীক্ষা চলাকালীন আমাদের বলতো, “এদেশে কোনো স্কুলে এমন পোশাক হয় নাকি? মেয়েগুলো ওড়না পরে না, অসভ্য মেয়ে সব।” মৌখিক পরীক্ষায় পড়াশোনার কথা না জিজ্ঞেস করে আমাদের পোশাক নিয়ে কথা শোনাতো। আমরা কেন ছেলেমেয়ে একসাথে মিশি তা নিয়ে কতকিছু বলতো!
বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়গুলো আমরা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই সবকিছু জেনেছি। ফলে আমাদের কখনও ছেলেদের সামনে পিরিয়ড নিয়ে লজ্জায় চলতে হয়নি। বরং আমাদের কষ্ট হচ্ছে জানলে ওরাই আগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতো। বিষয়টা যতটা স্বাভাবিক হবার কথা ঠিক ততটাই স্বাভাবিক রেখে আমরা বড় হয়েছি।
যখন স্কুলের বাইরের দুনিয়ার সাথে যুক্ত হলাম, দেখতে পেলাম আমাদের কাছে যা স্বাভাবিক ছিলো, এখানে সেসব অস্বাভাবিক, লজ্জাজনক। আমার ব্যাগে স্যানিটারি প্যাড দেখে কলেজের এক ছেলে একদিন বললো, “এসব কেউ ব্যাগে এভাবে চোখের সামনে রাখে? তোর ‘শরীর খারাপ’ তো আসছিস কেন?” আমি খুব অবাক হলাম, কারণ আমার শরীর খারাপ না, একটা স্বাভাবিক ব্যাপার পিরিয়ড হওয়া, অসুস্থতা তো না!
আবার হাঁটতে চলতে ছেলেদের এড়িয়ে যাওয়া লাগে যাতে তারা আমাকে খারাপভাবে ছুঁতে না পারে। রাস্তায় লোকের তাকানো থেকে, স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হয়। কই, স্কুলে তো আমরা ছেলেমেয়েরা ঘাড়ে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতাম, তখন তো এই চিন্তা করতে হয়নি। তখন তো নিজের অধিকার বা সুরক্ষা নিয়ে এমন চিন্তিত হতে হয়নি!
মূলত এই চিন্তা ভাবনাগুলো মানুষের ভেতরই থাকে। হাজার বছরের এই রীতি যে নারীদের সবকিছু সামলে চলতে হবে, কেননা পুরুষ তো ধরবেই, তা আমাদের সমাজের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। ছেলেরা এটা জেনেই বড় হয় যে তারা superior, একজন মেয়েকে অস্বস্তিবোধ করানোয় ক্ষতি নেই, বরং তা কেবল মজা এবং মেয়েরা তা মেনে নেবে। আমাদের স্কুলে তা হয়নি, আমাদের সকল কাজে এবং কথায় একসাথে রাখা হয়েছে, একইভাবে রাখা হয়েছে, যা থেকে আমরা দেখে বড় হয়েছি আমাদের কোনো তফাৎ নেই, আমরা কেউই superior না, সবাই সমান। কারোর সাথে অন্যায় হলে সে প্রতিবাদ করবে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে।
নারী দিবস নারীদের সংগ্রামকে উদযাপন করবার, নারী দিবস নারীদের অর্জনকে উদযাপন করবার। আমরা জন্ম থেকেই সংগ্রামে লিপ্ত হই, আমাদের অধিকারের জন্য নিজেদেরই লড়তে হয়। আমার বন্ধুরা যেমন আমাদের এই সংগ্রামে ছোট থেকেই পাশে থেকেছে, যারা কখনো আমাদের weaker gender হিসেবে না দেখে সমানভাবে দেখেছে, তাদের ধন্যবাদ। আমার ছোট্টবেলার জগৎটা যেমন সমতার, বৈষম্যহীন এবং স্বাভাবিক, আশা করি সমস্ত দুনিয়াও এমন হবে একদিন। নারীদের সংগ্রাম সফল হোক, সকল নারী তাদের বাধা-বারণ ছাপিয়ে এগিয়ে যাক, সমতা পাক।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।