বীরাঙ্গনাদের কাছে মোদের স্বাধীনতার ঋণ

??????????????সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: যে অঙ্গ সেদিনও বীরত্ব দেখাতে পারেনি, শুধু প্রাণটা ধরে রাখা ছাড়া, আজও পারেনা, তবু তেমন একটা নামের বোঝা তাদের অঙ্গকে ভারবাহী করে রেখেছে মাত্র। সেই ভারে যুক্ত হয়েছে বয়সের সাথে দারিদ্র। কেন তবে এমন নাম, যা আজও অসম্মানিত করে রেখেছে আমাদের? স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনাদের এমন প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে পাওয়া গেল না।

সংসারে তাদের জায়গা হয়নি! সমাজ তো দূরের কথা, পেটের সন্তানরাও তাদের মর্যাদা দেয়নি।যে সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় পাশে, রেলের বস্তিতে, খাস জমিতে দু’খানা চটের ছাউনি দিয়ে রোদ-শীতে বুকের উষ্ণতা দিয়ে, মমতার আর্দ্রতা দিয়ে বড় করেছেন। সেই সন্তানরাও এক সময় নিজের জন্ম পরিচয়কে ধিক্কার দিয়ে ছেড়ে গেছে। পেটের ভাড়া না হোক, কোলের ভাড়াও পরিশোধ করেনি তারা। আর যারা ছেড়ে যায়নি তারাও মায়ের মতো নানা ভাবে নিগৃহীত।

যুদ্ধের সময় এই নারীদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২২ বছর। সেদিন যৌবনই নাকি ছিল শত্রু! আর আজ কিশমিশের মতো কুচকে যাওয়া ত্বক ও শুকিয়ে যাওয়া কলাগাছের মতো শরীর তাদের শত্রু। তাদের যে ত্যাগের বিনিময়ে মাথার উপর এই স্বাধীন একটা আকাশ, সেই আকাশটাও যখন ছাউনির অভাবে বৃষ্টিতে ভিজাতে থাকে, রোদে পোড়াতে থাকে, তখন আকাশটাও যৌবনের শরীরের মতো শত্রু মনে হয়। পেটে খিদা না থাকলে উমের দরকার পড়ে না তেমন। চোখ মুদলেই জুড়িয়ে আসে ঘুমে। খিদায় পেটও যেমন কামড়ায়, সেই দুর্বিষহ দিনের স্মৃতিও যেন সেই সময়টাকে বেছে নেয় কলিজাটায় খোঁচা দিতে।

কথা হচ্ছিল কুড়িগ্রামের কয়েকজন বীরাঙ্গনার সাথে। যারা এই প্রথম মিডিয়ার সামনে নিজের পরিচয়ের কথা বললেন। বললেন, যদিও ৪৩ বছর ধরে সমাজে আমরা ধিকৃত হয়েছি, কিন্তু কেউ কোনদিন আমাদের কথা শুনতে আসেনি। ঘটনাগুলো সবাই জানলেও আমরা কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বার বার তালিকা হলেও আামাদের জন্য কেউ ভাবেনি।

দিনক্ষণ মনে নাই কালে গ্রামের খুকি বেওয়ার (৬২)। নিজের মতো করে বললেন, ‘হুজুগের সময় কি আর কিছুর হুঁশ ছিল? মিলিটারি আইসবার নাইগছে শুনিয়া হামরা জঙ্গলের মইদ্দে পালাইছি। কোলে আছিল দুই বছরের বেটি আলেয়া। মিলিটারি পাশত আইসলে আলেয়া ভয় পায়া কান্দি ওঠে। আর কি কইম, কোলের ছাওয়া টানিয়া জঙ্গলে ফেলে দিয়া হামার আচঁল ধরি টানিয়া ক্যাম্পে নিয়া গেইল। কয়দিন গেইছে চলি মোর মনে নাই। পরে সুস্থ হয়া শুনবার পাইছং পাঁচ দিন পরে মরা মরা অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলায়া দিছিল তারা। সেটি থাকি মাইনসে তুলি আনি বাড়িত দিছে। কিন্তু বাড়ি আর পাইলং কই। দ্যাশ স্বাধীন হইলে সবায় বাড়ি বাড়ি ফিরি আসিল, আর হামরা বাড়ি ছাড়া হইলং। স্বামী হামার বাড়িত থাকি তাড়ায়া দিল। সেই থাকি রেলের জাগাত আশ্রয় নিয়া আছং’।

একই গ্রামের আবিরন (৬০)। স্বামী হোসেন আলী তখন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দুই সন্তান, আবুল তখন তিন বছরের ও নাজমার ছয় মাস। হোসেন আলী যুদ্ধে যাওয়ার খবরে মিলিটারি ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। পালানোর সময় আবিরনকে ধরে ফেলে চারজন মিলিটারি। বললেন, ‘কোলের ছাওয়া আঁচাড় মারি ফেলে দিয়া মোক টানতে টানতে পাট ক্ষেতে নিয়া যায়। অজ্ঞান অবস্থায় আছিলাম সারা রাইত। পরের দিন ছাওয়া সুদ্দায় মার বাড়িত আইসং। যুদ্ধ শেষে স্বামী বাড়িত ফিরি মোক নিয়া আর খায় নাই। আর একখান বিয়া করি সংসার করিচে। মোর সারা জীবন মায়ের বাড়িত কাটিল। ওমরায় কোনদিন খোঁজ নিল না। ওমরা মুক্তিযোদ্ধা হইল আর মুই কলঙ্কিনি থাকিনু’।

তরুবালা (৬১) দুপুরের রান্না শেষ করে স্বামী নিশিকান্তের পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছিলেন। মিলিটারি আসতে পারে তাই দ্রুত খেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর সব আয়োজন শেষ। কিন্তু ভাত আর খাওয়া হয়নি কারও। বললেন, দুম দুম করে মিলিটারি আসিয়া হামার ঘরোত ঢুকি গেল। হামরা হিন্দু বলি গালি দিতে দিতে হামার স্বামীক মারতে মারতে টানি হিঁচড়ে নিয়া যাইতে দেখি মুই চিক্কর দিয়া ছাড়ি দিবার কইনু। কয়জন তাকে ছাড়িয়া মোর চুল ধরিয়া টানিয়া ছোট পুলের পাড়ের ক্যাম্পে নিয়া গেইছে। ছয় মাসের কোলের ছাওয়ার কান্দন শুনি গ্রামের মাতব্বরেররা ক্যাম্পে যায়া মোক আনিয়া হাসপাতালে ভর্তি করায়। সুস্থ হয়া শুনবার পাও মোর স্বামীক সেই দিনই মিলিটারিরা সিও অফিসত নিয়া গুলি করি মাইরচে। ওমার লাশটাও পাওয়া যায় নাই’।

দুলো বেওয়া (৬০) । কালে গ্রামের স্বামী বরকতউল্ল্যা এক বছরের আশরাফকেসহ দুলোকে বাড়িতে রেখে পালিয়ে যান। একদিন দুলো বেওয়ার পালা আসে। বললেন, মিলিটারি আইসছে শুনি পালবার ধরি, কিন্তু পাট ক্ষেতে ধরা পরি যাই। আর বলতে পারলেন না। কান্নায় কথা গলায় আটকে যায় তার। অনেক কষ্টে যা বোঝালেন ঠাটমারি ব্রিজের পাড়ের ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতন সয়ে ঘরে ফিরে আসেন ঠিকই, কিন্তু স্বামী তাকে নিয়া সংসার করিতে রাজী ছিলেন না। আত্মীয়-স্বজন তার স্বামীকে অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে রেখে গেলে  বরকতউল্ল্যা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে।

নীলকণ্ঠ গ্রামের আয়েশা বেওয়ার (৬৫) যুদ্ধটা আরও কঠিন। আজও প্রতিনিয়ত যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে থাকার উপায় পান না। স্বামী পনির উদ্দিন তখন পালিয়ে ছিলেন।  তিন বছরের মেয়ে পরিনা, আর তিনি ছিলেন আট মাসের অন্ত:সত্ত্বা। আয়েশা থাকতেন মায়ের বাড়িতে। মিলিটারি এমন অবস্থায়ও তাকে রেহাই দেয়নি। ধরে নিয়ে গেছে অর্জূন ডারার রেল ব্রিজের পাশের ক্যাম্পে। চারদিন পর ছেড়ে দিলে মায়ের বাড়িতে ফিরে মৃত সন্তান জন্ম দেন তিনি। স্বামী যুদ্ধ শেষে  বাড়ি ফিরে আসে, কিন্তু আয়েশার বাড়ি ফেরা হয় না। পনির উদ্দিন আবার বিয়ে করেন। আয়েশার মা মারা গেলে ভাইয়েরাও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। খাসজমিতে ঝুপড়ি ঘরে পরিনাকে নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। পরিনাকে বিয়ে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তারও সংসার হয় নাই মায়ের বীরাঙ্গনা হওয়ার অপরাধে।

কালে গ্রামের জহুরন বেওয়া (৬২) ও তার স্বামী আজদ্দিকে একসাথেই ধরে নিয়ে যায় । ‘১০/১২ জন মিলিটারী হামার বাড়িত আসি দুইজনকে ধরি নিয়া যায় । মোক চাকলার দিঘির পারের এক জঙ্গলের তাবুতে আটকে রাখে।কিন্তু হামার স্বামীকে কোনটে নিয়া যায় তার খোঁজ কাইয়ো জানে না। তার লাশটাও পাওয়া যায় না’। দেশ স্বাধীন হলে জহুরুলের জন্ম হয়। এই পেটের সন্তানও কথায় কথায় মাকে অসম্মান করে আজও। মায়ের সাথে থাকে না সে ছেলে।

কালে গ্রামেরই আরেকজন আছমা (৫৮)। তখনও বিয়ে হয়নি তার। মিলিটারি ক্যাম্পে আটকা ছিলেন বলে আর বিয়ে হচ্ছিল না। অবশেষে আট সন্তানের বাবা এক বৃদ্ধের দেখাশোনার জন্য বউ হয়েছেন। সেই স্বামীও নিজে চলাফেরা করতে না পারলেও, বীরাঙ্গনার খোটা দিতে ভুলে করেনি।

সুরুজজান বেওয়া (৫৮)। নতুন বউয়ের গায়ের হলুদ-মেহেদীর গন্ধ তখনও যায়নি। মিলেটারি বাড়িতে এসে শাশুড়ি-স্বামীর সামনেই তাকে ধর্ষণ করে। তবুও সারা জীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হয়েছে সংসারে।

এই ইউনিয়নের মেহেরজান (৬৩), হাজেরা (৬৫), বছিরন (৬০), খোতেজা (৬৬) ও পলাশবাড়ির ময়না বললেন তাদের জীবনের কাহিনী। যে কাহিনী ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশ। যে কাহিনী এই নারীদের সমাজ সংসারে কোন সম্মান দেয়নি, দেয়নি নিরাপত্তা। অথচ নাম দিয়েছে বীরাঙ্গনা। স্বাধীন দেশের কোন সরকার তাদের খোঁজ করেনি। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে রাজাকাররাও নাম অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নিলেও কুড়িগ্রামের কতশত বীরাঙ্গনার কোন তালিকা করেনি কেউ।

তারা বললেন, সচ্ছল পরিবারের অনেক মেয়েও তখন ধর্ষিতা হয়েছিলেন, যাদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন। আমরা তাদের মিলিটারি ক্যাম্পে দেখেছি, কিন্তু তারা আজও বলতে চান না তাদের কথা।

বীর প্রতীক আব্দুল হাই বললেন, মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে কুড়িগ্রামে কয়েক শত নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সমাজ সংসারের অবহেলায় তারা সারা জীবন কাটিয়েছেন। তাদের অনেকেই এখনও জীবিত আছেন। বীরাঙ্গনারা যেহেতু ইতিহাসের অংশ তাদের তালিকা করা ও দুস্থদের সহায়তা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

একাত্তরের ২০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা কুড়িগ্রামে স্থায়ী আসন গাড়ে। ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা ছোট বড় শত শত ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়ে অপারেশন চালায়। কুড়িগ্রাম শহরে সিও অফিস থেকে ঠাটমারী রেল সেতু পর্যন্ত চারটি ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পগুলো থেকে প্রায়ই অপারেশনে নেমে পাকিস্তানি সেনা বেলগাছা ইউনিয়নের কালে ও নিলকণ্ঠ গ্রামের নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনসহ নানা নির্যাতন চালাতো।

পরিচিতি: লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন: