#BreakTheBias: প্রয়োজন নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা

ফারহানা আফরোজ রেইনী:

ইদানিং ফেসবুক এ একটি ভিডিও দেখা যায়। একটা ছেলে মোবাইল এ পাসওয়ার্ড দিচ্ছিলো, তার বৌ দেখতে চাওয়াতে সে সরিয়ে ফেলে। মেয়েটি সেটা দেখতে চায়, কারণ সে ছেলেটির অর্ধাঙ্গিনী বলে। এরপর ছেলেটি যা করে তা হচ্ছে সে মেয়েটিকে অর্ধেক পাসওয়ার্ড দেখিয়ে উঠে যায়। তার যুক্তি হচ্ছে, অর্ধাঙ্গিনী যখন তখন অর্ধেক দেখবে, পুরোটা দেখার অধিকার তার নেই।

অকাট্য যুক্তি ! অর্ধাঙ্গিনী শব্দের এতো বাস্তবসম্মত মানে আর হয় না বোধ করি! আমি ছেলেটির মোবাইল এর পাসওয়ার্ড দেখতে চাওয়ার বিষয়ে কোনোভাবেই মেয়েটিকে সমর্থন করি না, আবার ছেলেটি অর্ধাঙ্গিনী শব্দের যে মানে করেছে তার ভয়াবহতা নিয়েও চিন্তিত। তবে সত্যি কী, প্রাত্যহিক জীবনে অর্ধাঙ্গিনীদের এই রকম অর্ধেক সুবিধা দিয়েই চলতে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ইংরেজি “Better half ” কেই বোধ হয় বাংলায় অর্ধাঙ্গিনী বলে। ইংরেজি থেকে বাংলায় আসতেই আসতেই বেচারা “better” গায়েব হয়ে শুধু half থেকে গিয়েছে। তাই এই অর্ধেক সুবিধা নিয়ে কীভাবে নিজের সর্বোচ্চ ভালো করা যায় তার চিন্তাটা নিজেদেরই করতে হবে।

এ কারণেই, এবং নানা কারণেই মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা অনেক জরুরি। অনেক মেয়েরাই আছেন যারা স্বামী অনেক সম্পদশালী বলে নিজের আয় রোজগারের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না; আবার এই একই কারণে অনেক মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাধাও পেয়ে থাকেন চাকরি করা বা রোজগার করার বিষয়ে। নিজের রোজগার করার সাথে স্বামীর সম্পদশালী হওয়া বা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। নিজেদের আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের জায়গাটা শক্ত করার দায়িত্বটা নিজেরই নিতে হবে। স্বামীর টাকা আছে, বা সম্পদ আছে এটা অবশ্যই ভালো বিষয়, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে স্বামীর অনেক সম্পদও প্রয়োজনে তারা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে না।

মাঝে মাঝে অনেক মেয়েকে/নারীকে বলতে শুনি, তাদের স্বামী নাকি তাদের একা কোথাও যেতেই দেবে না, যারা বলে তারা বেশ গর্বের সাথেই কথাটা বলে। শুনে যতটা না ঈর্ষা হয় তাদের স্বামী ভাগ্য নিয়ে, তার চেয়ে বেশি মায়া হয় তাদের অসহায়ত্ব দেখে। আবার অনেক ছেলেকে বলতে শুনি, তারা নাকি তাদের বৌকে একা কোথাও ছাড়েন না। এইসব ছেলেদের কেয়ারিং ভাব দেখে আমার কলেজ এর এক বাংলা স্যার এর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি সব সময় বলতেন, “মেয়ে নুপুর পরবে ভালো কথা, কিন্তু তোমার নুপুরের শব্দ যেন কোনো পাহারাদারের পাহাড়া দেয়ার অস্ত্র না হয়ে যায়।” বিভিন্ন সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি অনেক নারীই স্বামীর সহিংস আচরণকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মনে করে।

তাদের মতে, স্বামী অভাবে থাকলে আর হাতে টাকা না থাকলে তার তো মন – মেজাজ ভালো থাকে না তাই বৌ কে একটু- আধটু মারতেই পারে। এখানে মার খাওয়াটাকে জীবনের অংশ বা নিয়তি মনে না করে যদি ঘরের মেয়েরাও কিছুটা রোজগার করে আর্থিকভাবে তার স্বামীকে সাহায্য করতে পারতো, তাহলে তো সব দিক দিয়েই ভালো হওয়ার কথা ছিল। কাজ মানে কাজ। যে যেখানে, যে অবস্থানে থাকবে সেখান থেকে তার জন্য যেটা করা সম্ভব। কিছুটা আয় রোজগার হয় এমন কোনো কাজে জড়িত হলে যে শুধু টাকা পয়সা রোজগার হয়, তাই নয়। মেয়েদের মনমানসিকতার উপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পরে। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা মেয়েদের জন্য যে অবস্থান তৈরি করে দেয়, তাতে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। একা হয়ে যাওয়া বা একাকিত্ব বোধ হওয়া – দুই ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা যেমন আত্মবিশ্বাস তৈরি করে তেমনি প্রতিকূল অবস্থার সাথে টিকে থাকার সাহসও জোগাতে পারে।

আয় রোজগার করা মানে উশৃঙ্খলতা নয়। বরং একটা সিস্টেম, একটা সুন্দর ব্যবস্থাপনা। মেয়েরা সংসারটা চালায়, অর্থনৈতিক কাজের সাথে জড়িত থাকলে সংসার ব্যবস্থাপনাটা অনেক বেশি দক্ষ হয়/ভালো হয়। যে মেয়েটা নিজে রোজগার করে, তার অন্যের রোজগারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, মায়া থাকে। যে মেয়ে রোজগার করে, সংসারের প্রয়োজনে সেই তার সবটুকু নিয়ে এগিয়ে আসতে কোনো দ্বিধা করে না। আর্থিক স্বনির্ভরতা মনটাকেও উদার করে।

পরিবার থেকেই এই বিষয়টি মেয়েদের শিখতে পারা উচিত আর মেয়েদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার বীজটা পরিবার থেকেই বপন করে দেয়া উচিত। অনেক বাবা-মা আছেন তারা মেয়েদের পড়াশুনায় ছেলেদের সাথে কোনো বৈষম্য করবেন না, কিন্তু চাকরি করতে দেয়ার ক্ষেত্রে চাকরির চাইতে মেয়েকে ভালো ছেলের কাছে পাত্রস্থ করাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ভালো পাত্র পেয়ে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে মেয়ের পড়ালেখাটা শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন না। এখনও এগুলো হয়, হরহামেশাই হচ্ছে। মেয়েদের মর্যাদার বিষয়টি যদি পরিবার না বোঝে, তাহলে অন্য একটি পরিবারে গিয়ে সে কখনই সেই মর্যাদা পাবে না। আমরা যদি সম্পদশালী ছেলের অর্ধাঙ্গিনী করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাই, কিংবা অভাবী স্বামীর অভাবের দায় মেটানোর জন্য যদি মেয়েদের পিঠটা পেতে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাই, তাহলে তার দায় আমাদের।

একবার একদল কিশোরী – কিশোরীর সাথে কথা বলার সময় তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাবা মায়েরা কেন তাদের ছেলে/মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়? অনেকগুলো উত্তরের মধ্যে মেয়েদের ক্ষেত্রে একটি কমন উত্তর ছিল, “বাবা-মায়ের দারিদ্রতার কারণে”। তবে ছেলেদের বেলায় একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উত্তর করেছিল, ছেলেকে খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনতে, মাদকাসক্তি থেকে বের করে আনতে।

যে দরিদ্র বাবাটি তার আদরের মেয়েকে এক মাদকাসক্ত ছেলের হাতে তুলে দিলো, আপনাদের কি মনে হয় বিয়ের পর সেই ছেলেটি ভালো হয়ে যাবে? বরং মেয়েকে সাবলম্বী করলে নিজের দারিদ্রতা যেমন দূর হবে , মেয়ে আত্মনির্ভরশীল হবে, এমনকি পিঠ পেতে দিয়ে একটা ছেলেকে ভালো করা না , সে হাজারটা মানুষকে ভালো করার দায়িত্ব নেয়ার মতো আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে।

ফারহানা আফরোজ রেইনী
গবেষণাকর্মী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.