নারীর জমি ধর্মেও খায়, সম্পর্কেও যায়

দিনা ফেরদৌস:

ঘটনাটা নিজের চোখে দেখা।

বোনদেরকে বিয়ে দেয়া হয়েছে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে। ভাইদের অবস্থাও সচ্ছল। সম্পত্তি ভাগাভাগির যখন সময় এলো তখন নিজের মা-বাবাই মেয়েদের বোঝালেন, তোমাদের তো আর অভাব অনটন নেই, আর বাপের বাড়ি সারাজীবন তো খোলাই রইলো তোমাদের জন্যে, ওইটুকু সম্পত্তি ভাগাভাগি হলে বাড়ি ছোট হয়ে যায়। তোমাদের ভাইদের বাচ্চারাও তো বড় হচ্ছে, তোমরা বরং নিজেদের অংশ ভাইদের দিয়ে দাও। এর মধ্যে এক বোন বিদেশে থাকেন, তাকে বোঝানো হলো, তুমি তো আর দেশে এসে থাকবে না, ওইটুকু জমি দিয়ে তোমার কিইবা হবে! আর সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের সাথে ভেজাল করলে সম্পর্কও ঠিক থাকবে না। কেউ কেউ বোনদের বোঝালেন, বাপের বাড়ির সম্পত্তির অংশ নিলে,ভাইদের ঘরে এক কাপ চা খাওয়ার অধিকারও থাকে না।

দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না, ওখানে সম্পত্তি কতটুকু ছিল! সম্পত্তি কতটুকু ছিল তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যা দুইয়েরই রয়েছে সমান অধিকার। মন থেকে কোন বোন যদি মনে করে তার ভাইকে কিছু দিবে, সেটা সে দিতেই পারে, দান অথবা উপহার হিসেবে। শুধু সম্পত্তি কেন, নিজের ব্যক্তিগত আরও বেশি কিছু থাকলে ভাইকে সে দিতেই পারে, কিন্তু বোনের অনেক আছে বলে ইমোশনালভাবে তাকে চাপে রেখে আদায় করা মোটেও যৌক্তিক নয়।

এখন আসি বোনদের ব্যাপারে, যারা ইচ্ছে করেই নিজেদের সম্পত্তির অংশ নিতে চায় না। স্বামীর সম্পত্তির অংশকে কেন বাবা-মায়ের অংশের সাথে যোগ করতে হবে? কার কী আছে, না আছে তার উপর তো অধিকার নির্ভর করে না। অধিকার মানেই যার যা পাওনা তাকে তাই দেয়া। যার ফলে দেখা যায়, যেইসব নারীদের সত্যিই সম্পত্তির দরকার আছে , তারা তা পাচ্ছেন না। ভাইদের সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হয়, এই প্রচলন পড়ে যাওয়ার ফলে অনেক ভাই মনে করেন বোনদের সম্পত্তি না দিলেও চলে। বোন পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে, তাকে সম্পত্তি না দিলেও কথা বলার সাহস করবে না। বোন গরীব, মামলা করে নিতে পারবে না, তাই তাকে না দিলেও চলবে। বিধবা বোনকে বহুদিন টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে , এখন সম্পত্তির অংশ আর না দিলেও চলবে। এটা যে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার অবৈধ অজুহাত তা না বোঝার কিছু নয়। ভাই বিপদে পড়লে কি এক ভাই অন্য ভাইকে সাহায্য করে না? তাই বলে কি ভাইয়ের সম্পত্তি মেরে দেয়ার চিন্তা এতো সহজে করা যায়? এই প্রশ্নগুলো তাদের উদ্দেশ্যে যারা বোনদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে অজুহাত বের করেন। যারা দেবার তারা ঠিকই দেন এবং দিচ্ছেন।

এখন আসি সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে। হিন্দু নারীরা বাবার সম্পত্তিতে যেমন ভাগ পান না, তেমনি স্বামীর সম্পত্তিতেও। কোন অধিকার ছাড়াই সম্পত্তি ভোগ করা এক বিষয়; আর নিজের প্রয়োজনে সম্পত্তি ব্যবহার করা ও ভোগের সাথে সাথে বিক্রয়ের অধিকার স্থাপন হওয়া অন্য বিষয়। সরকার সম্প্রতি মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ দেয়ার জন্যে আইনের একটা খসড়া তৈরি করেছেন। কিন্তু দেখা যায় সম্পর্কের প্রসঙ্গ ছাড়াও মেয়েদের সম্পত্তি দিতে ধর্মনাশের প্রশ্ন নিয়েও হাজির হয় মানুষ। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই আছেন। তাদের কথা, যদি হিন্দু সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার দেওয়া হয় তো হিন্দু মেয়েরা মুসলমান ছেলেদের সাথে প্রেম করে বিয়ে করবে। আর মুসলিম ছেলেরা লাভ জিহাদের মাধ্যমে হিন্দু মেয়েদের বাগিয়ে নেয়ার সাথে সাথে হিন্দুদের সম্পত্তিও আত্মসাৎ করবে। যুক্তি দিয়ে ভাবলে বলতে হয় , ধর্ম ব্যক্তির অধিকার সম্পত্তি থাকলেও সে তা ছাড়তে পারে , সম্পত্তি না থাকলেও পারে। অন্যদিকে ভাবলে সম্পত্তি দিয়ে জোর করে ধর্মকে চাপিয়ে দিতেই হবে কেন , যদি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নিয়ে ধর্মে না থাকা যায়?

হিন্দু মেয়েদের দেখা যায়, বিয়েতে প্রচুর যৌতুক দেয়া হয় বাবার বাড়ি থেকে, যাকে বলা হয় স্ত্রীধন (বিয়েতে পাওয়া টাকা, গহনা ও যে কোন উপহারই স্ত্রীধনের মধ্যে পড়ে)। যৌতুক এখন যেহেতু নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই একই যৌতুক উপহারের নাম করে লেনদেন কিন্তু ঠিকই চলছে। এইসবের উপর মেয়ের অধিকার থাকলেও বিয়ের পর দেখা যায়, সবই বরের অধিকারে চলে যায়। যেহেতু ঘর সংসার করা মেয়েদের কাজ হিসেবেই দেখা হয়, আর চাকরি বাকরি, ব্যবসা দেখা হয় পুরুষদের কাজ হিসেবে; সেহেতু বিয়েতে পাওয়া উপহার (স্ত্রীধন বা যৌতুকের টাকা পয়সা) সব পুরুষই খরচ করেন নিজের সুবিধামতো। তাদের যুক্তি, সংসারের জন্যেই তো সব করা। কিন্তু এই পুরুষ হঠাৎ করে মারা গেলে কিংবা মেয়ের উপর নির্যাতন করলে কিংবা আরেক বিয়ে করলে সেই নারী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে ব্যাপারে কোন সমাধান নেই। মেয়েকে তো যথেষ্ট উপহার (স্ত্রীধন) দিয়ে তার সংসারে পাঠানোই হয়েছে, বাপের বাড়িতে তার আর অধিকার কীসের! স্বামী মরে গেলে বা আরেক বিয়ে করলে সেখানেও তার জায়গা নেই, এর সমাধান কী হবে?

প্রশ্ন থেকেই যায়, মেয়েদের সম্পত্তি দিলে ভাইবোনের সম্পর্ক কি সত্যিই নষ্ট হয়ে যায়? সম্পত্তিতে অধিকার পেলে সব হিন্দু মেয়েই কি অন্য ধর্মের ছেলেদের বিয়ে করে হিন্দু সম্পত্তি বেহাত করে ফেলবে?

ধর্ম, রক্তের সম্পর্ক ও সম্পত্তিতে ব্যক্তির অধিকার সবই আলাদা আলাদা বিষয়। বরং অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এইসব দুর্বল যুক্তি উপস্থাপন করা হয় বলেই ধর্ম ও আইন দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষ, যা খুবই দুঃখজনক ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.