মায়ার জবানবন্দী (গল্প)

দিলু দিলারা:

আমি রওশন আরা বেগম মায়া। বুঝ হবার বয়স থেকেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার ছোট মামার সংসারে। কুড়িগ্রামের উলিপুরে আমার নানার বাড়ি। আমার দুই মামা, বড় মামা জহুরুল ইসলাম। ছোট মামা নজরুল ইসলাম। ছোট মামার জমিজমা বেশি। বিশাল পানের বরজ, কয়েকটা সুপারির বাগ, কয়েকটা পুকুর, আর বড় মামা একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তিনি ঠিকমতো বেতন পান না। পাচঁজন ছেলেমেয়ে। অল্প কিছু জমি। তাই হয়তো আমার জায়গা হয় ছোট মামার সংসারে। ছোট মামার চার ছেলে।

আমি শিশুকাল থেকে শুনে এসেছি আমার বাবা শামসুল হুদা ঢাকায় বিশাল একটা কোম্পানিতে বড় অফিসার। আমার মা মারা যাবার পর আমার সেই বাবা আমাকে মামা বাড়িতে রেখে গিয়ে নতুন করে সংসার পাতেন। মাঝে মাঝে আমার নামে কিছু মানিঅর্ডার করেন, ওই পর্যন্তই।

মামাদের মুখে শুনেছি আমার বাবা এই বাড়িতে লজিং মাস্টার ছিলেন। উনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন, তবে অনেক মেধাবী ছিলেন। নানা ইচ্ছে করেই ওনার একমাত্র মেয়েকে আমার বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি কখনোই বাবাকে দেখি নাই, তবে মা-বাবার পুরনো একটা বাঁধাই করা স্টুডিওতে তোলা ছবি আমার কাছে আছে। আমার টিনের ট্রাঙ্ক থেকে মাঝে মাঝে বের করে দেখি।

আমি মামীর সাথে ঘরের সব কাজে সাহায্য করি। মামা আমাকে পড়ার বই এনে দিয়েছে, আমি ঘরেই পড়ি, কারণ আমার স্কুল ভালো লাগে না। কয়েকদিন স্কুলে গিয়ে আর যাইনি। মামী আমাকে ভালবাসেন। ছোট মামাও অনেক ভালবাসেন। মামা প্রতিদিন দেওয়ানি শেষ করে ঘরে ফিরে আমাকেই আগে ডাক দেন, “কই রে মা, কোনটে গেলু? বদনা খ্যান ভরে দেতো মা”। আমি মনের আনন্দে টিউবওয়েল চেপে পানি দিয়ে বদনা ভরে দেই।

সময় কাল ১৯৭৮।
আমি তখন ১৭ বছরের। আমার ইদানিং মাঝে মাঝে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। ওহ! বলা হয়নি আমার একটা চোখ একটু ট্যারা ছিল বলে বাড়ির অনেকেই আমাকে টেরপি বলে ডাকে, আমার এই ডাক শুনে খারাপ লাগলেও কিছু বলি না। অনেকেই বলতো আমি নাকি বুগদি, মানে বোকা। আবার এটাও বলতো হাসলে আমাকে নাকি দেখতে নায়িকা কবরীর মতো লাগে। যখন আমরা সবাই মিলে কুড়িগ্রামে মুক্তা হলে “সুজন সখি” সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম তখন আমিও খেয়াল করেছি কথা সত্যি।

একদিন সন্ধ্যায় রব উঠলো, আমার আব্বা শামসুল হুদা গ্রামে এসেছেন। আমি এই কথা শুনে আনন্দে একবার ঘর একবার বারান্দা একবার সুপারি বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। আমার আব্বা কখন আমাদের বাড়িতে আসবেন অপেক্ষা করতে থাকি। রাতের বেলা আমার আব্বা এই বাড়িতে এসে হাজির হন, সাথে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন উৎসাহী মানুষ।আমি ফড়িং এর মত উড়ে দরজার ফাঁক দিকে হেরিকেনের আলোতে আমার সুদর্শন আব্বাকে দেখি। উনি একবারও আমাকে দেখতে চান না, আমাকে কাছে ডকেন না।
চোখ ভরতি পানি নিয়ে আমি উনার জন্য যত্ন করে ঘন দুধের শেমাই রান্না করি।

পরদিন বাবা আমাকে কাছে ডেকে ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চলে যান এবং আমার জন্যে আনা বিয়ের কথা পাকা করে যান। মামা এ ব্যাপারে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাবার কথার উপর কথা বলতে পারেন নাই। তাছাড়া আমার বিয়েও হচ্ছিল না।
দেড় মাসের মাথায় এক শীতের রাতে আমার বিয়ে হয়ে যায়, বর যাত্রী মাত্র পাঁচজন। বরের মামা, দুই বোন আর এক ভাই। দূরের রাস্তা বলে তেমন কেউ আসে নাই। আমরা রাতের ট্রেনেই রওনা দিলাম। মামা-মামী অনেক কান্নাকাটি করলেন, সাথে আমিও।

ট্রেন ভোরবেলা গাইবান্ধা বোনার পাড়া রেল স্টেশনে পৌঁছুলো।
এরপর রিক্সা করে শ্বশুর বাড়ি।
নতুন বউ আসার খবর শুনে আশে পাশের বাড়ির অনেকেই ভিড় করে আমাকে দেখতে এলো।
আমি উঠোনে চেয়ারে বসা আমার স্বামীকে দেখি। আমি অনেক খুশি। আমার স্বামীর জন্যে কেমন মায়া জন্মে যায়।
আমার বাসর।
আজ অনেক শীত পড়েছে। স্বামীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কোন সময় ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ কীসের ধাক্কায় ধরফর করে উঠে বসি, দেখি আমার স্বামী। আমি আনন্দে কেঁপে উঠি, কিন্তু কোন কিছু বোঝার আগেই উনি বলতে থাকেন, “এই পা টিপ”। সারা রাত আমি এই লোকটার পা টিপেছি। থেমে গেলেই লাত্থি। এই লোকটার প্রতি ঘৃণায় আমার মুখে এক দলা থুতু আসে, কিন্তু গিলে ফেলি।

আমার স্বামী ঢাকাতে থাকতেন, উনি যে কয়দিন ছুটিতে ছিলেন আমার সাথে প্রতিরাতে এই আচরণ করেছেন, আমার শরীরটাকে নিয়ে বিকৃত খেলায় মেতেছেন। আর দিনের বেলা মা-ভাইবোন দের সামনে আমাকে বিভিন্নভাবে অপদস্থ করেছেন। ভাইবোন-মা সবাই তার সাথে সুর মিলেয়েছে।
আমি মুখ বুঁজে অপমান সহ্য করেছি।

আমার স্বামী কর্মস্থলে চলে যাবার পর শুরু হয় উঠতি বয়সের দেবরদের উৎপাত। গভীর রাতে আমার দরজায় তাদের ধাক্কাধাক্কি। শাশুড়ি পান থেকে চুন খসলেই চুলের মুঠি ধরতেন। আমি প্রতিবাদ করলেই স্বামীর কাছে চিঠি চলে যেত। আর চিঠি পাওয়ার পর সে উত্তরে লিখতো, আমাকে যেন ইচ্ছেমতো শাসন করা হয়।
আমি মাত্র তিন মাস সংসার করেছিলাম। অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমার বাবাকে জানালেই হতো! আর মামারা তো ছিলই। আমার বাবা? ওনার জন্যেও আমি একদলা থু থু রেডি করে রেখেছি। মামাকে কেমন করে জানাবো, তখন না ছিল টেলিফোন, না ছিল মোবাইল। চিঠি লিখবো কাগজ কই? কলম কই? খাম কই?

একদিন ভাত পুড়িয়ে ফেলার কারণে আমাকে ছোট দেবর, শাশুড়ি দরজা বন্ধ করে এমন মারলেন আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। হুঁশ হবার পর আমি এমন পাগলামো আর চিৎকার শুরু করলাম যে আশেপাশের মানুষজন এসে এই বাড়ি ঘিরে ফেললো।

তাদের বলা হলো আমার মাথায় ছিট আছে। আমি পাগল বলে সাব্যস্ত হলাম। আমাকে সেইদিনই বাড়ির গরুর রাখালের সাথে মামা বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
আমার স্থান হলো আবার মামার বাড়ি। মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার আর কেউ খোঁজ করেনি। আমার বাবা মাঝে একবার এসে আমাকেই উল্টো দোষারোপ করে গিয়েছে। আমি নাকি আমার মায়ের মতো বদরাগী।
আমি মামা বাড়িতে ভাইয়ের বাচ্চাদের দেখাশোনা করি। এখন চুলে পাক ধরেছে, শুধু কবরীর মতো হাসিটা অটুট আছে। ইদানিং কেন জানি খুব ইচ্ছে করছে আবার বোনার পাড়ায় আমার শ্বশুর বাড়ি যাই।

সময় ২০১১।
আজ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের এলাকার ভ্যানওয়ালা রব্বানি আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসে। আমি ট্রেনে চেপে বসি, গন্তব্য বোনার পাড়া। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে পিছিয়ে যাওয়া গাছপালা, বিল, ধানক্ষেত দেখি। একটা সময় গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে যাই।
আমি ট্রেন থেকে নেমেই হাঁটতে থাকি। একটা সময় বাড়িটা খুঁজে খুঁজে বের করি। বাড়ি খুব একটা বদলায় নাই। দরজায় লেখা, লতিফা মঞ্জিল, দেখেই চিনে ফেলি।
টিনের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আমার চোখে পড়লো, উঠোনের চারিদিকে নতুন কয়েকটা ঘর উঠেছে।
চারদিকে শুনশান। কাউকে দেখলাম না। শাশুড়িকেও না। বুড়িটা মরেটরে গিয়েছে মনে হয়!

এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলাম দূরে কাঁঠাল গাছের নিচে একটা হুইল চেয়ারে কে যেন বসে আছে। পায়ে পায়ে সেইদিকে এগিয়ে যাই। হুইল চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি আমার সেই জানোয়ার স্বামীটা।
প্যারালাইসড, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। সামনে সকালের আধ খাওয়া বাসি ভাত। পিঁপড়া লাইন দিয়েছে।
আমি করলাম কী! ওর দিকে তাকিয়ে কবরীর সেই বিখ্যাত হাসি দিলাম। দেখলাম ভয়ে তার চোখের মনি কেঁপে উঠলো, সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি একদলা থুথু ওর মুখে ছুঁড়ে মারলাম, জানোয়ারটা মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগলো, আর আমি হুইল চেয়ারটা টানতে টানতে নিয়ে গেলাম বাড়ির পিছনে ময়লা ফেলার পাগারের কাছে (ময়লা ফেলার মজা পুকুর)। নিয়ে গিয়ে দিলাম সজোরে ধাক্কা। ঝপাৎ করে একটু শব্দ হলো।
কিছুক্ষণ পর হয়তো খোঁজাখুঁজি শুরু হবে।
কাল সকালের আগে পর্যন্ত এই জানোয়ারটাকে কেউ খুঁজে পাবে না।

আচ্ছা এখন তাহলে আসি আমাকে পরবর্তী ট্রেনটা ধরতে হবে।
এবার বাড়ি ফিরে শামসুল হুদার ঠিকানাটা যোগাড় করতে হবে। ওনার সাথেও আমার কিছু হিশেব নিকাশ বাকি আছে।

শেয়ার করুন: