ভালো বন্ধু পাবার জন্য ভালো বন্ধু হতে হয়

আনন্দময়ী মজুমদার:

পথশিশুরা মুকুট তৈরি করে বিক্রি করে। ওদের জন্য ভালোবাসা দিবস একটা রমরমা দিন। ওদের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসায় প্লাবিত হয় আমাদের বুক। খুব ভালোবাসে বলে ভালোবাসা দিবসে আড়ম্বর না করেও কেউ কেউ নিজের জন্য মুকুট কিনে পরে সেই পথশিশুর কাছ থেকে। আমার একজন শিক্ষক বললেন, ভালোবাসা দিবস সকলের আনন্দের দিন নয়। তাই আমি সেটা নিজেকে উদযাপন করার কাজে লাগাতে চাই।

কথাটা ভালো লাগলো বলে শেয়ার করছি। এই দিন আলসেমি করার দিন, নিজেকে একটু সময় দেবার দিন কি হতে পারে? কেউ হয়তো শুয়ে শুয়ে বই পড়তে ভালোবাসে, কেউ মন ভালো করে দেওয়া গান শোনে, অথবা নিজেকে খুশি করার মতো কিছু ভালো খাবার রান্না করে, অথবা একজন পরম আস্থাশীল মানুষের সঙ্গে কথা বলে, অথবা হয়তো স্মৃতির সুন্দর এলবাম মুছে গুছিয়ে রাখে, অনেকদিন লেখেনি যে, অথচ যে নিজের কথা লিখতে ভালোবাসে, সে ভালো রঙিন কলম দিয়ে এক আধটা কবিতা লিখতে পারে অথবা ডায়েরির পাতা — প্রত্যেকটা কাজ আমার কাছে স্বস্তিকর, আনন্দঘন। কাউকে দেখাবার জন্য আমাদের লেখার দরকার হয় না, গাওয়ার দরকার হয় না, নাচ করা বা রান্না করার দরকার হয় না। তাই সেইসব নিভৃতে আনন্দ করে উপভোগ করলে আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যায়।

নানা সামাজিক প্ল্যাটফর্ম আছে যেখানে আমরা অনেক কিছু শেয়ার করি। কিছু আমাদের খুশি করে। সবকিছু করে কি? সবকিছু আমাদের ভালোবাসার উদ্রেক না-ই করতে পারে। যা আমার জন্য নিরাময়ী চিন্তা ও স্পর্শ আনে না, তা আমার জন্য ভালোবাসা নয়।

রোজ বাজারে গিয়ে আমাদের দরদাম করতে হয়। অনেক সময় বাজারি স্তোক স্তবক আমাদের ক্লান্ত করে। এমন দোকান আর দোকানদারের কাছে যেতে ইচ্ছে করে যে আমাদের চেনে আর কদর করে। সব সময় কি আর মেলে? সেদিন দেখছিলাম গ্র্যামি এওয়ার্ড পাওয়া শিল্পী ইন্ডি আরি — তিনি তো ভুরি ভুরি এওয়ার্ড পেয়েছেন, আর সর্বাধিক নমিনেশনও পেয়েছেন। উনি বলছিলেন, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে উনি বিদায় নিয়েছিলেন, কারণ নিজের যা বলা-কওয়ার তা বলতে পারছিলেন না। পরে ভেবে দেখলেন, তিনি নিজের স্বর নিজের চাওয়াটুকু নিয়ে সংগীত লিখবেন, নিজের মতো থাকবেন, সৃষ্টি করবেন। তাই করেছিলেন। আর পেয়েছিলেন একাধিক গ্র্যামি। আমি ছোটবেলা থেকে যারা খুব সাধারণ কিন্তু অসাধারণ সাধন করছেন তাদের ব্যাপারে একটু উৎসাহী। জানতে ইচ্ছে করে তাদের অনুপ্রেরণার কথা, তাদের উঁচুনিচু পথের কথা। আমি ছোটবেলা থেকে কথা কইতে ভালোবাসতাম। আর মানুষকে ভালো লাগলে একেবারে জাপটে ধরতাম। এ হলো আমার সেই শিশুবেলার স্বভাব। আমি ইন্ডি আরির কথা শুনে ভাবলাম, তাহলে নিজের মতো নিজে থেকেও বড় হয় কেউ কেউ। নিজের সাচ্ছন্দ্য বজায় রেখেও কেউ কেউ মানুষের ভালোবাসা পায়!

ভালোবাসা দিবসের কথা হচ্ছিল। সাধারণত এইদিন আমরা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাই। বন্ধু তো আমরা সকলেই খুঁজি যেমন সব মানুষ সব প্রাণী — খোঁজে; আস্থা করার মতো পাত্র, মনের সুখ-দুঃখ নির্দ্বিধায় বলার মতো পাত্র। পাত্র কথাটা ইউনিজেন্ডার। এ কথা একজন বড়ো সংগীত শিল্পী আমাদের শিখিয়েছেন।

বন্ধুরা বিপদে ফেলে না, দুঃখ বাড়িয়ে তোলে না, তারা সত্যি সত্যি আমাদের নিয়ে গর্ব করে, আমাদের ভালো চায়, আমাদের কথা নিয়ে আরেকজনকে গিয়ে পেছনে পেছনে মন্দ গল্প করে না। আমাকে বিচার করতে বসে না। আমাদের রক্ষা করে, রক্ষা করে, আমাদের জন্য তারা সংবেদনশীল থাকে, আর ক্ষমা করে, ক্ষমা করে, ক্ষমা করে। যেমন আমরা করি তাদের। তেমন বন্ধু কই সকলের? থাকলে তারা তো ভাগ্যবান।

বড় হতে হতে আমরা জানি সকলের পরীক্ষার খাতা আলাদা। কেউ কেউ বড়ো বেশি কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছে। সেই পরীক্ষা দিচ্ছে বলে আমরা যদি তাদের পিঠে আলতো হাত রেখে ভালোবাসা জানাই তাহলেই বা মন্দ কী?

আমরা অকপটে শুধু ভালোবাসতে জানি, নিজেদের। সেটাই ভালোবাসা দিবসের কাজ। সেই ভালোবাসা ছাপিয়ে সকলকে স্পর্শ করুক, সকলকে নিরাময় দিক, এই তো চাই আমরা। নিরাময়ের হাসির মতো সুন্দর আর কী আছে?

এখন বুঝতে পারছি ভালো বন্ধু পাবার জন্য ভালো বন্ধু হতে হয়। চেষ্টা তো করি আমরা। কিন্তু নিজের বন্ধু না হলে কী করে হবে?

নিজেকে ভালোবাসলে শুনেছি অর্থ আপনি আসে। সুখ আপনি আসে। বন্ধুও আপনি আসে। আমাদের ঢাক পিটিয়ে ভালোবাসা দিবস উদযাপনের দরকার নেই। আমরা নিজের আরেকটু কাছের মানুষ হতে চাই। ভালোবাসা দিবসে সকলেই নিজেকে আরেকটু বেশি যত্ন নিক, নিজেকে আরেকটু শ্রদ্ধা করে, আস্থা করে, নিজের ঠিক কী চাই সেটা নিজেকে দিক। নিজের পাত্র ভরে উঠুক।

নিজের সবচেয়ে বড় বন্ধু আমরাই তো, কারণ আজন্ম এই আমিটুকু ছাড়া আমার ঠিক পাশে সবসময় কেইবা আছে বা ছিল বা থাকবে? কেউ কেউ ভাগ্যবান, তাদের আরো দেখেশুনে রাখার মতো মানুষ আছে! কিন্তু নিজের বন্ধুত্বটুকু একেবারে দরকার। আমি সেকথা মনে রাখার জন্য আমার শিশুবেলার ফটো এলবাম হাতড়াই। ওই শিশুটিকে কি সমালোচনা করতে পারি? ঘেন্না করতে পারি? দূরে ঠেলতে পারি? না তো!

আমরা তো এখন আর শিশু নই! কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিতে দিতে আমরা অনেকে ভুলে গেছি সেই ছোট্ট শিশুটির কথা। মানে আমাদের কথা! কিন্তু দেখা যায় না বনলেই কি সে নেই নাকি? খুব আছে। মনস্তত্ত্বে বলে শিশু বেলার সমস্ত অভিজ্ঞতাই বড়বেলায় এসে বারবার দেখা দেয়, আমাদের চাপা কষ্টগুলো নানাভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মনস্তাত্ত্বিককরা বলেন, আমরা আমাদের হিংসা, বিদ্বেষ, ভয়, ক্ষোভ, লোভ এগুলো কিছুই নই। যারা আরও অগ্রণী তারা বলেন, এগুলো আমাদের মধ্যে এক একটা স্বাভাবিক ও খুব জরুরি ইমোশনাল কম্পাস। এই কম্পাসগুলো আমাদের দিকনির্দেশনা দেয় — কিছু একটা সমস্যা হয়েছে ভিতরে, ভিতরে ডুব দিয়ে এটা বুঝে নিয়ে কিছু পাল্টাতে হবে, নিজের জন্য। আমাদের ইন্টিউশন অনেক আগে থেকেই আমাদের সাবধান করতে থাকে। কিন্তু আমরা অনেকে ইন্টিউশন ধরতে পারি না, পাত্তা দিই না। আমরা বেশির ভাগ মনে করি অন্যের সমালোচনা, বিরক্তি, রাগ এগুলো বুঝি আমাদের আসল মূল্য ঠিক করে দেবে।

কিন্তু বড় সব মানুষ ও মনীষীরা তো বলে গেছেন আমরা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। শুনেছি একজন বিখ্যাত ক্রিকেট তারকা সকালে উঠে ব্যাট হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তুমি একজন অসাধারণ খেলোয়াড়’। এতে কাজ হয়েছে জানি। শুধু ক্রিকেট বিশ্বে না, মানুষ হিসেবে তিনি যে শ্রদ্ধাটুকু পেয়েছেন তা অতুলনীয়।

স্পিরিচুয়াল আপা, দিদিরা বলেন, আয়নায় গোটা গোটা করে লিখে রাখো, ‘ভালোবাসি!’ ‘মেনে নিই’ ‘ক্ষমা করি সব সময়’, ‘শ্রদ্ধা করি’, ‘বুঝি’, ‘তুমি অনেক সুন্দর!’ অর্থাৎ যে কথা শুনলে আমাদের আনন্দ হয়, তেমন কথাগুলো নিজেদের জানাতে। প্রথম দিন করার পর আমার সন্তান ঘাবড়ে দিয়ে বলে, ‘মা, দেখো কে এসে কীসব লিখে রেখে গেছে, তাও অদ্ভুত কালিতে’। মানে অব্যবহৃত লিপস্টিক পেয়ে মনের আনন্দে সেদিন এক্সপেরিমেন্ট করেছি আয়নার ওপর নানা কিছু লিখে যা আমার শুনতে ইচ্ছে করে! আমি ওকে বললাম, ‘আরে না, অমুক তমুক (যারা বড়ো মানুষ) তারাও এমন করে। আমিও করলাম। নিজেকে নিজে প্রশংসা করলাম। একনলেজ করলাম!’

নির্জন থাকি, যখন কোলাহল আমাদের বিক্ষিপ্ত করে তখনই ডুবে থাকি নির্জনতার ভিতর, ফোন বন্ধ করে দিতে দেখেছি অনেককে এরকম সময়, তিনি দেশের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রফেশনাল মানুষ। নির্জনতার ভিতর আমাদের হৃদয় ফিসফিস করে যখন কথা বলে আমরা শুনতে পাই, কোলাহলে ডুবে থাকলে পাই না। নিজের এই একান্ত স্বরকে এখন আর অবহেলা করি না। যা মনে করি বেঠিক, চেষ্টা করি তা না করার, অভ্যেস পাল্টানো সহজ কাজ নয়, কিন্তু অনেক সময় নিজেকে ভালোবাসি বলেই, সেটা খুব জরুরি। যারা অনান্তরিক, তাদের সঙ্গে থাকি না। ভালোবাসি, ক্ষমা করি, কিন্তু দূর থেকে।

অন্য কেউ আমার চেয়ে আমার সম্পর্কে বেশি ভালো জানে, এ কথাও এখন আর মনে করি না। ইন্ডি আরি বলছিলেন, এখন নানা ভক্তের নানা সমালোচনা তিনি পড়েন, বিচলিত হন না। মিশেল ওবামা শুনেছি তাদের ক্যাম্পেনের সময় টিভির কোনো শো শুনতেন না। ‘যা মনের শান্তি নষ্ট করে, সময় অপচয় করে, তা আমার জন্য কেন? আমি তো আমাকে ভালোবাসি। তাই এই সময় আমার জন্য মূল্যবান’ এ-কথা বলেন।

যখন বাইরের অনেক কিছুতে আমাদের মন ভেঙে যায় তখন আমার মতো অনেকে আছে আমি জানি — যারা ভাবে, আমাদের সৃষ্টি করেছে যে মহাজাগতিক শক্তি, সে শক্তি আমাদের মধ্যে আছে, তাকে কি কেউ জানতে পেরেছে? যারা স্পিরিচুয়াল তারা বলে গেছেন এই শক্তি, আমাদের আত্মা সকলের মধ্যে বিদ্যমান। শুধু নানা বাহ্যিক পরিচয়ে ঢাকা পড়ে গেছে, আমরা সেই সব খোলসকে আমাদের পরিচয় বলে মনে করি। অতলে সকলেই সমান। সকলেই সৃষ্টির জীব। ‘আমি আলো, আমি শক্তির স্বরূপ’, কেউ কেউ বলে আমাদের আসল স্বরূপ নাকি ব্লিস বা আনন্দ। নামে কিছু আসে যায় না আমার, আবার আসে যায় অনেক কিছু যদি তার মধ্যে নিহিত থাকে আমাদের ভালোবাসা। সেই কারণে আমরা আমাদের সন্তানদের সুন্দর নাম দিতে চাই। যে নাম আমাদের মধ্যে খুশির ঝংকার তোলে!

আমরা অকপটে নিজেদের ভালোবাসি, এই অনুমতিটুকু দিতে দিতে আমাদের অনেক সময় চলে যায়। কিন্তু ধরা যাক ভালবাসা দিবস তো তাই। আমরা নিজেদের দিকে তাকাইনি বলে কতো স্বপ্নের বীজ ঘুরে ঘুরে পালকের মতো উড়ে চলে গেছে; আমরা নিজেদের ভালোবাসিনি বলে অবহেলা করেছি আর সবাইকে। সবাইয়ের মধ্যে আলোর বীজকে।

যখন অকপটে শ্রদ্ধা জানাই নিজেকে তখন মহাজগতের সুরভি ভেসে আসে, দেখি, আদরে মুকুলিত হচ্ছে বসন্ত। প্রকৃতি নিজেকে ভালোবেসে উন্মীল  হচ্ছে। এমন তো না-ও হতে পারতো। মহাজগতের পরতে পরতে আনন্দ আর প্রেম আছে বলেই তো হচ্ছে। সেই আনন্দ আর প্রেমের ভাগীদার আমরা, যেহেতু আমরা সেই মহাজগতের অংশ।

এসব কথা বড়ো বড়ো শোনাচ্ছে, তো কী হলো? ধরা যাক এটাই সত্যি! ধরে নিলেই সেটা সত্যি হবে। আর না হলে আমাদের বোধের কাছে অধরাই থেকে যাবে!

শেয়ার করুন: