(পুন:প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশকাল ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর)
সাকিনা হুদা:
জীবনের চলার পথে অনেকের সাথেই আমর বন্ধুত্ব হয়েছে। কোনো কোনো বন্ধুত্ব অনেক গভীরতায় পৌঁছে গেছে। আমি কখনো জাতি ধর্ম বিশ্লেষণ করে বন্ধুত্ব করিনি। আমার মনের গহীনে যে নিবিড়তার স্পর্শ রেখেছে, তাকেই বন্ধু ভেবেছি।
আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম ছন্দা ঘোষ। খুব শৈশবকাল থেকে ওর হাত ধরে আমি হেঁটেছি, লেখাপড়া করেছি। মনে পড়ে, ছোটবেলায় দুজনে মায়ের আচারের বয়াম থেকে আচার চুরি করে নিয়ে আসতাম। সেই আচার দুজনে মারামারি করে খেতাম। হিন্দু বাড়ির আচার নাকি মুসলমান বাড়ির আচার-আমাদের মনে কখনো প্রশ্ন জাগতো না। আমাদের সঙ্গে অনেক বান্ধবী এসে ভাগ বসাতো।
শুধু তাই নয়, দুজনে একসঙ্গে বসতাম, হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম, একজন স্কুলে না এলে অন্যজনের ভারী বিষন্ন লাগতো। ছন্দা কতদিন আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছে, আমিও খেয়েছি ওর মায়ের কাছে। পূজা-পার্বণে আমি ওদের বাড়িতে গেছি। ঈদ উৎসবে ও এসেছে আমাদের বাড়িতে।
সে তো অনেক অনেক দিন আগের কথা। এখন আমরা দুজনেই বার্ধক্যে পৌঁছে গেছি। ছন্দা রাজশাহীতে থাকে, আমি ঢাকায়। দুরালাপনীতে কথা বলি। এখনও হিন্দু বান্ধবী-মুসলিম বান্ধবীতে নিরবিচ্ছন্ন যোগাযোগ অক্ষুন্ন আছে। হয়তো শেষদিন পর্যন্ত থাকবে। আমরা দুজনে দুজনকে অনুভব করি- ধর্ম দিয়ে নয়, অনুভূতির মধ্য দিয়ে।
আমার ব্যক্তিগত জীবনের ছোট একটি গল্প বললাম। আমি মুসলিম। মানবধর্ম আমার বড় ধর্ম। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই- এরকম একটা উপলব্ধিতে বড় হয়েছি। সন্তানদেরও সেই উপলব্ধির আলোকে পথ চলতে শিখিয়েছি।
বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে যে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কিছু মানুষ আছে যাদের ধর্ম সম্পর্কে আদৌ কোন নির্ভুল যুক্তিযুক্ত ধারণা বা জ্ঞান নেই। সেই ধর্মান্ধতা থেকে তারা বেরিয়ে আসে না বা আসতে পারে না। ফলে ঘটে সংঘাত। পরিনাম মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়। কোন ধর্মেই খুনখারাপি বা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে জীবন ও মালামাল ধ্বংস করার কথা বলা হয়নি। প্রতিটি ধর্মেই সহিষ্ণুতার কথা বলা হয়েছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্মান করতে বলা হয়েছে। প্রতিটি ধর্মের মূলমন্ত্র মানবপ্রেম। যারা অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের আসলে নিজের ধর্ম সম্পর্কে ভাল ধারণা বা জ্ঞান নেই। নিজের ধর্ম মেনে চলতে হলে অন্য ধর্ম সম্পর্কেও শ্রদ্ধা ও জ্ঞান রাখতে হবে। ইসলাম ধর্মে আছে সহনশীলতা এবং অন্য ধর্মকে সম্মান করার শিক্ষা।

একটি শিশু যখন যখন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, আমরা তখন থেকেই তাকে শেখাতে শুরু করি পারিবারিক ধর্মের আচার ও কানুনগুলো। আমরা শিশুকে শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবধর্ম সম্পর্কে কোন ধারণা দিই না। কিন্তু শেখাতে শুরু করি আরবী উর্দু নয়তো সংস্কৃত, যাতে শিশুরা খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মগ্রন্থগুলো পড়তে পারে, তা সে তার মানে বুঝুক বা নাই বুঝুক। কিন্তু ভাষা শেখা একটি ব্যাপার, ধর্ম শিক্ষা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। আমরা মনে করি ধর্মশিক্ষা পেলেই একটি শিশু নৈতিকভাবে চরিত্রবান হবে। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় গ্রন্থের ভিতরে শিশুর নৈতিকতার শিক্ষা আবদ্ধ করে রাখলে তা কখনো তাকে বড় মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে না।
আমাদের মূল সমস্যা ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্য ধর্মকে অপছন্দ করা। এটি শিশুকাল থেকে জন্ম নেয়। এরজন্য শিশুরা দায়ী নয়, পারিপার্শ্বিকতা দায়ী। আমার মতে শিশুকে যদি আমরা তার উপযুক্ত বয়সে সব ধর্মের বই তার হাতে দিই এবং সেগুলো পড়ে বোঝার মত যোগ্যতা তৈরি করে দিই, তবে অবশ্যই তার সব ধর্ম সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হবে। এরই আলোকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি জন্মাবে সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসা। এভাবেই মানুষের মনে ধীরে ধীরে এসব ধর্মীয় গোঁড়ামি ও হীন মানসিকতা দূর হবে। মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে ধর্ম আসলে কী! তাহলেই হয়তো এইসব চরম অবমাননাকর ঘটনাগুলো থেমে যাবে।
সবশেষে একটা কথা বলবো। যারা ধর্মশিক্ষা দেন, ইমামতি করেন, ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে এর উপরে আলোকপাত করেন, তাদের উচ্চশিক্ষিত শুধু নয়, পৃথিবীর সব ধর্ম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা উচিত। ধর্ম একটি বিশাল ব্যপক স্তম্ভ। যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। সুতরাং সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে কেউ কখনো ধর্মের মূল শিকড়ে পৌঁছাতে পারে না। ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণের জন্য চাই অঘাত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার। তা না হলে সীমিত জ্ঞান এরকম একের পর এক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।