আমি জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে

রোকসানা বিন্তী:

সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় বলেছেন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নাকি বিয়ে হয় না, কেউ তাদের বিয়ে করতে চায় না, কারণ তারা সারারাত বাইরে ঘোরাঘুরি করে!
আমি একজন জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে! এবং ভিসি মহোদয়ের ভাষায় সফল কারণ কেউ একজন আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছেন! ভিসি মহোদয়ের বক্তব্য আমাকে যতোটা না রাগান্বিত করেছে, তার চাইতে বেশি করেছে নস্টালজিক!

কতকিছু মনে পড়ে গেলো সেসব সময়ের কথা!
জাহাঙ্গীরনগরে পড়া সময়টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়! সেই সময়টাতে আমি যে পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করেছি, তা আর বাকি পুরো জীবন মিলিয়ে ভোগ করতে পারবো বলে মনে হয় না!

একটা উদাহরণ দেই – সে সময় নয়টার বাসে গুলিস্তান থেকে রাত সাড়ে এগারোটায় সাভার পৌঁছানো ছিল বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার! ভার্সিটির বাসে যাচ্ছি, হলের সামনে নামিয়ে দিবে, তাই বাসায়ও চিন্তা বা টেনশনের কিছু নেই! কখনও কখনও জ্যাম থাকলে আরও ঘন্টাখানেক দেরি হতো! আমি বলছি ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের কথা! অথচ এখন, মানে ২০২২ সালে এসেও বাসায় ফেরার সময় ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই বাবা মায়ের, হাজবেন্ডের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়! খুবই স্বাভাবিক! কারণ আশেপাশের হায়েনাগুলো তো নিরীহ মানুষের রূপই ধরে থাকে! তাদের কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ রেখে পরিবারের কাছে যত দ্রুত ফেরা যায় ততই মঙ্গল! কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে একটা অদৃশ্য নিরাপত্তার চাদরের বেষ্টনী ছিল যা কিনা দূরে থেকেও আমাদের পরিবারের সদস্যরা অনুভব করতে পারতেন! তাই একবার ভার্সিটির বাসে উঠে যেতে পারলেই তারা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন!

টিভিতে কনসার্টের দৃশ্য দেখলে বা রাস্তায় কোথাও ড্রামের শব্দ শুনলে এখনও রক্তে নাচন ধরে! মুক্তমঞ্চে কতবার মধ্যরাত অবধি কনসার্ট দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই! শুধু কনসার্ট কেন, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র‌্যাগ (শিক্ষা সমাপনী) প্রোগ্রাম, আরও কতকিছু! কনসার্টে চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙে যেতো! পছন্দের গান লাইভ দেখার সুযোগ কয়জন পায়? আরও স্পেসিফিক করে বলতে গেলে বলতে হয়, কয়টা মেয়ে পায়, যারা খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে? আমি পেয়েছি! আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেজন্যই পেরেছি কনসার্ট উপভোগ করতে! সসম্মানে! কোনোরকম কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়েই! ভার্সিটি ছেড়েছি ২০১৪ এ! তারপরে আর কনসার্ট দেখতে পারিনি! এমনকি দেখার কথা চিন্তাও করতে পারিনি! মনে হয় আর কোনোদিন হবেও না এই জীবনে! বাঘ নাকি নরমাংসের স্বাদ পেয়ে গেলে আর কিছু খেতে পারে না, আমিও লাইভ কনসার্টে মজা পেয়ে কেন যেন আর টিভিতে বা মোবাইল ফোনে গান উপভোগ করতে পারি না!

ক্যাম্পাসের খুব পরিচিত একটা শব্দ ছিলো র‌্যালির ড্রাম পেটানোর শব্দ! যেকোনো উৎসবে র‌্যালি হতো! আর এতে হাঁটতে গেলে কীভাবে যেন তা নাচ হয়ে যেতো! মনের আনন্দ নিয়ে আমরা সবাই মিলে নাচানাচি করতাম! মেয়েরা খুব সহজে ছেলেদের চোখের খারাপ দৃষ্টি ধরতে পারে! কিন্তু আমি কখনোই দেখিনি সেই উৎসবে বা আনন্দ মিছিলে আমার দিকে কেউ খারাপভাবে তাকিয়ে আছে! বৃষ্টিতে ভিজে, রং মেখে বহুবার নাচানাচি করেছি! একবার তো ডিপার্টমেন্টের ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়ন হবার পর আমার জুনিয়ররা এক বালতি রং এনে আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছিলো! আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের স্মৃতি সেটা, যেসব স্মৃতি চরম কঠিন বাস্তবতায় বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগায়! এই ধরনের কর্মকাণ্ড জাহাঙ্গীরনগর ছাড়া আর কোথাও করার কথা চিন্তাও করতে পারি না!

জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েদের “মেয়ে” হিসেবে নয়, “মানুষ” হিসেবে গণ্য করা হয়! আমি আমার ভার্সিটি লাইফের পুরোটা সময় কখনোই এটা ফিল করিনি যে, “আমি মেয়ে, আমি সমাজের চোখে দুর্বল প্রজাতি!” বরং নিজের অধিকার, নিজের সম্মান নিয়ে মহাআনন্দে দিনযাপন করেছি! রূপকথার মত ছিল সে দিনগুলো! সেই অধিকারবোধ, সেই সম্মান এখন পাওয়া তো দূরে থাক, কল্পনাও করা যায় না! বাস্তব পৃথিবীতে একটা মেয়েকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়া হয়, “তোমার স্থান অনেক নিচুস্তরে, তা তুমি যতই ডিগ্রি অর্জন কর না কেন বা যতই উঁচুপদে আসীন হওনা কেন!” তার যোগ্যতাকে প্রতি মুহূর্তে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়!

জাহাঙ্গীরনগরে পড়ার সময়টা ছিলো অনেকটা অনিশ্চয়তায় ভরা! রেজাল্ট কেমন হবে, স্টুডেন্ট লাইফ শেষে কী করবো, কোথায় থাকবো, চাকরি-বাকরি পাবো কিনা, টিচিং এর জন্য ট্রাই করবো না ব্যাংক-বিসিএসের জন্য পড়বো, সবকিছু মিলিয়ে একটা হযবরল অবস্থা! সেই তুলনায় আমার এখনকার জীবন অনেক স্ট্যাবল! রুটিন লাইফ! কিন্তু তারপরও কেন জানি ছবির মেয়েটাকে অনেক মিস করি! সেই ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের বিন্তী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে!

আহা!
যদি সম্ভব হতো, আরও অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে আসতাম! জমা করে রেখে দিতাম মনের গোপন কুঠুরিতে…
যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে…..
আমার শতজন্মের ভাগ্য জাহাঙ্গীরনগরের মেয়ে হতে পেরেছিলাম!

রোকসানা বিন্তী
৩৭ তম ব্যাচ
নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন: