শিমুর মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

দিনা ফেরদৌস:

শিমু মেয়েটিকে গলা টিপে হত্যা করে বস্তাবন্দি করে ফেলে দিয়েছিল তার স্বামী, যেমনটি কিছুদিন আগে ইলমা চৌধুরী মেঘলাকেও অত্যাচার করে হত্যা করা করেছিল স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন মিলে। শিমুর স্বামী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, শিমুর কারও সাথে পরকীয়া ছিল, এদিকে ইলমার স্বামীও সন্দেহ করতেন তাকে। শিমু আর ইলমার মধ্যে মিল হচ্ছে দুজনেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। দুজনেই সংসার করতে চেয়েছিলেন। সংসার করতে না চাইলে তো ছেড়ে যাওয়াই যায়।

ধরে নিলাম রাইমা ইসলাম শিমুর পরকীয়া ছিল। তো সেই বউ নিয়ে সংসার না করলেই হতো। এখন বলবেন, বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার ভাঙার সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়া যায় না। তাইলে বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝি খুন করা যায় সহজেই? এখন তো শিমুর দুই বাচ্চা মা হারা হয়ে গেল, কে নেবে সেই দায়?

রাইমা ইসলাম শিমু ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে কিছু না কিছু করে খেতে হয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রিক্সা চালক, দিনমজুরও আমাদের সমাজের মানুষ। এই সমাজে কোন পেশার মানুষের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই যদি তাদের দ্বারা মানুষের কোন ক্ষতি না হয়। শিমু অভিনয় করতেন। আমরা বিনোদনের জন্যে নাটক, সিনেমা দেখি। শিমু এখন আর এই দুনিয়াতে নেই, কিন্তু কিছু কিছু ভিডিওর মন্তব্যে দেখলাম লোকজন বলছে, নাটক, সিনেমা ভালো না, এইসব উল্টাপাল্টা কাজ করলে সৃষ্টিকর্তা এই রকম শাস্তি-ই দেন।

প্রশ্ন হলো, যারা এইসব মন্তব্য করেছেন তারা নাটক, সিনেমা যেমন দেখেন, খোঁজ নিলে তাদের মোবাইলে পর্নোগ্রাফিও পাওয়া যাবে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন নায়িকা এখন দোযখে যাবেন, কবরে আজাব হবে। কোন মরা মানুষ উঠে এসে জীবনে কবরের বর্ণনা দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। এখন বলবেন কিতাবে লিখা আছে। কিতাব পড়ে এসে আপনারা কী জন্যে নায়িকারের গন্ধ খোঁজে বেড়ান সারাদিন? আপনাদের’তো মরার কথা ভেবে সারাদিন কিতাবের কাছাকাছিই থাকা উচিত।

আমরা মানুষকে নিয়ে মন্তব্য করে মনে করি নিজেরা পূতপবিত্র হয়ে স্বর্গের সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে গেছি। একদল প্রায়ই বলেন, নাটক, সিনেমায় যারা কাজ করে তারা খারাপ। মানুষ তার যোগ্যতা যেইদিকে আছে সেইদিকেই যাবে। ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে যেমন ডাক্তারি হবে না, তেমনি যিনি নায়ক/নায়িকা হতে চান তার দ্বারাও ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না। এখন বলবেন, ওইসব না করলেই হয়, পরপারে গিয়ে কী জবাব দেবেন? যারা নায়ক/ নায়িকা বা গায়ক/গায়িকা হন এটা তাদের পেশা, তারা এই করেই সংসার, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে খেয়ে পরে জীবন ধারণ করেন। ক্ষমতাময় সৃষ্টিকর্তা যদি আকাশ থেকে আলাদা করে টাকা পয়সা ফেলার ব্যবস্থা রাখতেন তো কাউকেই আর নাটক/ সিনেমা করে খেতে হতো না।

নাচ, গান, সিনেমা, নাটক, টিকটক ভিডিও সবই তো আপনারা দেখেন তৃপ্তি সহকারে, বিনোদন নেন। দেখা শেষে গালি দিয়ে নিজেদের ঈমান মজবুদ করতে করতে আরো একবার বিনোদন নিয়ে নিজেদের পরিচয় যেখানে পরিষ্কার করে তোলেন, ওইখানে অন্যদের কে স্বর্গে বা বেহেশতে যাবে্‌, কি যাবে না তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। কে কোথায় যেতে চায় প্রত্যেকেরই সেই টার্গেট আছে। ধরে বেঁধে গালি দিয়ে, নাচ, গানের পোস্টে গিয়ে, এমনকি মৃত মানুষের পোস্টে গিয়েও ধর্মের দাওয়াত না দিলেও চলবে । খুন হলে বলবেন পাপের শাস্তি, আর যে খুন করলো সে বুঝি স্বর্গ বা বেহেশতের টিকিট হাতে নিয়ে করেছে ? সব জায়গায় ধর্ম কপচাতে কপচাতে ধর্ম আর স্বর্গ বা বেহেশতকে এতো সস্তা না বানালেও চলবে। যারা ধর্ম করার তারা করবে, কেউ বলা না বলার ধার না।

আর সৃষ্টিকর্তা যদি শিমুকে শাস্তি দিতেই চাইতেন (ঈমানদারদের কথা মতো তো করোনা একটা গজব, যদিও বহু ঈমানদারও করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন), তাহলে আরও বহু রোগ দিয়ে গজব দিয়েই মারতে পারতেন, আরেকজনকে দিয়ে খুনের মতো পাপ করিয়ে মারার দরকার কী ছিল? ক্যান্সার দিয়ে তিলে তিলেও তো মারা যায়। যিনি সারা জাহান চালনা করেন, তিনি এক শিমু মারতে এতো নাটকই বা সাজাবেন কেন? আর ভুল জায়গায় ধর্মের রেফারেন্স টেনে ধর্মকে আর কলঙ্কিত না করলেও চলবে। যেকোন ধর্মই শান্তির জন্যে এসেছে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে আসেনি। যদি আইনবিরোধী কোন পেশা না হয়ে থাকে তো একজন মানুষ সেই পেশায় থাকতেই পারে, যেহেতু টুপ করে আকাশ থেকে টাকা পড়ে না। আর কেউ না খেয়ে থাকলে তার ঘরে আপনি খাবারও তুলেও দেবেন না। মরার পর বেহেশতে যাওয়ার আগে না খেয়ে খেয়ে কেউ মরলে দুনিয়ায়ই তার জন্যে নরক হয়ে উঠবে, তার শাস্তি আপনি ভোগ করবেন না । এখন বলবেন, সবাই রিজিক নিয়ে দুনিয়ায় আসে। কী রিজিক নিয়ে আসে তা আফ্রিকার কিছু দেশের মানুষের বের হয়ে আসা হাড় দেখলেই বোঝা যায়। এখন বলবেন, ওদের সিস্টেম ঠিক না। সারা দুনিয়া যার সিস্টেমে চলে, তিনি শুধু আফ্রিকার কিছু দেশকে সিস্টেমে রাখতে পারেন না, এইটা এই যুগে বসে বললে হাসির খোরাক হয়ে যায়।

কেউ পরকিয়াই বা কেন করবে, পার্টনারকে ভালো না লাগলে চলে গেলেই তো পারে। কিন্তু আপনারা তো আবার পছন্দ করেন না বিবাহবিচ্ছেদ। একসাথে সংসার করছে দেখলেই ধরে নেন সুখে আছে তারা। তাদেরকে দিয়েই এখন জোর করে সংসার করিয়ে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সামাজিক কাঠামো ধরে রাখবেন। যতোক্ষণ পর্যন্ত না কেউ না কেউ খুন হয় বা আত্মহত্যা না করে আমাদের ধরে নিতেই হবে তারা সুখী দম্পতি। পারলে যারা বনিবনা না হওয়ার জন্যে আলাদা হয়ে যায়, উল্টো তাদেরকেই উদাহরণ দেয়া হয় সেইসব অসুখী মানুষদের; যারা জোর করে সংসার করে। অভিনেত্রী শিমুর আপন বোন নিজেও কনফিউজড যে তার দুলাভাই এই কাজ করতে পারেন! কারণ শিমু নিজের পারিবারিক কলহের কথা গোপন রেখেছিলেন নিজের পরিবারের কাছেও।

অন্যায়’কে অন্যায় বলতে শিখুন। অন্যায়কারীর শাস্তি জন্যে আওয়াজ তুলুন। তা না হলে অন্যায়কারীরা প্রশ্রয় পেয়ে দ্বিগুণ সাহস নিয়ে সমাজে অন্যায় ঘটাবে শাস্তির ভয় না থাকায় আর পক্ষে লোকজন আছে দেখে। বলা তো যায় না কাল আপনার মা, বোন, মেয়ে, ভাতিজিও এর শিকার হতে পারে বিনাদোষে। হয়তো কাল আপনার বোনের উপর রেগে গিয়ে কিংবা নিজের পরকীয়া ঢাকতে মিনুকে যেইভাবে স্বামী ভাড়াটিয়া খুনীদের দিয়ে হত্যা করিয়েছিল কিংবা বহুকাল আগে, মুনির যেইভাবে নিজের পরকীয়ার জন্যে রীমাকে হত্যা করেছিল, আপনার কাছের মানুষটিও বিনাদোষে প্রাণ হারাতে পারে সেইভাবে ।

ভাবছেন আমাকে গালি দেবার ক্লু পেয়ে গেছেন, কোন নারীর সাথে পরকীয়া ছিল বলেই এমন হয়েছে বলবেন? তখন বলতে হবে নিজের মাথায় কি ঘিলু নেই যে, হত্যার মধ্যেই একমাত্র সমাধান খুঁজতে হবে? বউ পরকীয়া করলেও বউকে হত্যা করতে হবে, আবার স্বামী নিজে পরকীয়া করলেও বউকে হত্যা করতে হবে। এইসব যারা বলেন, মনে রাখবেন তারা কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কেউ প্রতারণা করলে কিংবা কাউকে ভালো না লাগলে যেতে দিন তার নিজের রাস্তায় অথবা বদলে ফেলুন নিজের রাস্তাও কাউকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়া কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.