বিষাক্ত দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কেন?

সালমা লুনা:

আবার একটা খুন। একজন নারী, একজন স্ত্রী, এক মা খুন হয়েছে।
শোনা যাচ্ছে অভিনেত্রী শিমুকে তার স্বামীই খুন করেছে।
তাদের প্রেমের বিয়ে ছিলো।
১৮ বছরের পরিণত দাম্পত্যজীবন। দুটি ছেলেমেয়ের জন্ম দেয়া। এতদিন কেউ কিচ্ছু জানত না অথচ খুন হবার পর জানা গেল, দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো ছিলো না।

পুলিশ বলছে, স্বামী স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তাদের দাম্পত্যজীবন ভালো যাচ্ছিল না নানাকারণে। সেটি নিয়েই বিরোধ চরমে উঠলে সেই রাতে গলাটিপে ধরায় খুন হলেন শিমু। তারপর স্বামী তার  একদার প্রেমিকা, স্ত্রী অথবা তাদের দুসন্তানের মায়ের লাশটি নিয়ে পথে পথে ঘুরে শহর থেকে দূরে ফেলে দিয়ে এলো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে।

ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে নিহতের বোন মানতেই পারছেন না বিষয়টা।

উনার একটা কথা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে । তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, আপনারা লাশের ছবি দেখেছেন? এমনভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে? তারা প্রেম করে বিয়ে করেছিল। আমি জিজ্ঞেস করবো আমার বোনজামাইকে, সে এমন করেছে কীনা! কেন করেছে? কী দোষ আমার বোনের?

আহা! এমন মানতে না পারা, বুঝতে না পারা মানুষ এখনও আছে এই সমাজে !

প্রেমের বিয়ে হলে, সেই ঘরে কয়েকটি সন্তান জন্মালে, হাসিমুখে ঘুরে বেড়ালে, ছবি তুলে আত্মীয়তা সামাজিকতা রক্ষা করলে অথবা ১৮, ২৮ কিংবা ৩৮ বছরের বিষাক্ত দাম্পত্যের খবর না পাওয়া গেলেই যে সবসময় সম্পর্ক ভালো থাকে না সেটা অবশ্য এখন আর কাউকে বলে দিতে হয় না।
তবু লোকে লুকিয়ে রাখে বলে কাছের মানুষরাও জানেনা কিংবা মানতে পারে না যে মানুষগুলো বিবাহিত জীবনে ভালো ছিলো না।

দাম্পত্যে রোজ অনেক রক্তপাতহীন খুনখারাপিও হয়। সেটা এমনকি অনেক দম্পতিও টের পান না। অতঃপর এভাবেই একদিন মানুষও খুন হয়ে যায়।

সবসময় মানুষের গলা টিপে কিংবা ছুরি কাঁচি দিয়ে জীবন নিকেশ করে দেয়াই খুন নয়।
অনেক রকম খুনই আছে।
সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা, পারস্পরিক সম্মান শ্রদ্ধা, মায়া এমনকি শেষ ভরসাস্থল – দ্বৈত জীবনযাপনের অভ্যাসটুকুও খুন হতে পারে।

অনেকেই বলে, দাম্পত্য নাকি স্রেফ দুজন মানুষের অভ্যাস। সেই অভ্যাসটুকুও যখন খুন হয়ে যায় দুজনের জেদ ক্রোধ পৈশাচিকতায়। তখন হয়ত আরেকজনকে শারীরিক ভাবে খুন করার মুহুর্ত আসে।

এখন প্রশ্ন আসে, কেন মানুষ লুকিয়ে রাখে বিষাক্ত সম্পর্ক? খুনের আগে কেউ কাউকে ত্যাগ করতে পারে না কেন? কেন সম্পর্ক নিয়ে কোন সম্মানজনক সমাধানে আসা যায়না! কেনই বা খুন পর্যন্ত যেতে হয়?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একঘেঁয়ে, বিরক্তিকর বিষাক্ত সম্পর্কে থাকতে বাধ্য হয় নানা কারণে। যার মধ্যে
সবচেয়ে বড় কারণ, সমাজের ভয়।
অভ্যাস আর সমাজের ভয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

অভ্যাসবশত একঘেয়ে দাম্পত্যে একরকম ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে, এমন দম্পতিই বেশি আমাদের চারপাশে।

এমনই অভ্যস্ততায় আমৃত্যু সুখী দম্পতির লেবেল লাগিয়ে কেউ কেউ স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন।

একজনের শারীরিক মৃত্যু হলে খুব গোপনে আরেকজন মুক্তির আনন্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন হয়তবা। সেকথা কেউ জানতেও পারে না। সুখী দম্পতির এক মিথ্যে উদাহরণ হয়ে রয়ে যান তারা।

এরকমটাই ঘটে বাঙালি সমাজে।
কারণ এই সমাজই শিখিয়েছে মানুষকে বিয়ে করতে হয়। এবং যেকোন মূল্যে সেই বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। এই সমাজই ঠিক করে দিয়েছে দাম্পত্যসঙ্গীর অন্যায় আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা নিষেধ।
সাক্ষী সাবুদের সাথে কয়েকটা কথা উচ্চারণ করিয়ে প্রচুর পানভোজন শেষে এই সমাজই প্রাপ্তবয়স্ক দুটি নরনারীকে একসাথে বসবাস করার অনুমতি দেয়।  বৈধ যৌনতা এবং বংশধারা চালু রাখার স্বীকৃতি দেয়।

আবার সমাজই এই ধারা ভেঙে কেউ বেরিয়ে এলে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, গালি দেয়, সমাজচ্যুত করার হুমকিতে রাখে।
সমাজের চোখে এক স্বামীর ঘর করা নারী সতী সাধ্বী পূণ্যবতী। আর এক নারী নিয়ে সংসার করা পুরুষ মহাত্মা, মহাপুরুষ।
আমি আমরা এমনটাই ভাবি। কারণ আমরাই এই সমাজ।

তাই সঙ্গীর প্রতি প্রেম নয়, সম্মান ভালোবাসা কিচ্ছু নয়, স্রেফ সমাজের ভয়েই দাম্পত্যসঙ্গীরা নিজেদের একটা অভ্যাসের দাসে পরিণত করে বিষময় জীবন যাপন করে। দাম্পত্য ম্যাড়মেড়ে হতে হতে বিষবৎ হয়ে সেটি খুন পর্যন্ত যাবার আগেই কিছু একটা করার চেষ্টাও কেউ করে না।

নিজের মতো করে দাম্পত্যে শান্তি রেখে মুক্তি খুঁজে নিতে পারলে অথবা দাম্পত্যকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, কার্যকারিতার মাধ্যমে কোন সুযোগ দেয়ার চেষ্টাটুকু করা দরকার।

হয়তো ব্যর্থই হবে।
হোক ব্যর্থ।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হতেই হবে কেন।
পড়ালেখায় ফেল করা, চাকরিক্ষেত্রে সঠিক সময়ে প্রমোশন না পাওয়া, প্রথম প্রেমে ব্যর্থতা, প্রেজেন্টেশন যথাসময়ে উপস্থাপন করতে না পারা, সম্পত্তি নিয়ে ভাইবোনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, ব্যবসায় ধ্বস, শেয়ারবাজারে ধরা খাওয়া এসবও তো ব্যর্থতা। এতো বড় বড়  ব্যর্থতার গল্পগুলো বলা গেলে দুজন মানুষ একসাথে থাকতে না পারার ব্যর্থতাই কেন গোপন রাখতে হয়! কেন সঙ্গীর হাতে খুন হতে হয়!!

বিবাহিত প্রতিটি মানুষের জানা উচিত দাম্পত্যে ব্যর্থ হলেই জীবন থেমে যায় না। লজ্জিত হবারও কারণ নেই।

বরং বিষাক্ত বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিয়ে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখাই মনুষ্যচিত কাজ।
কারণ বিয়ে যেমন ছেলেখেলা নয় তেমনি অত্যাচার করা কিংবা অত্যাচারিত হবার হাতিয়ারও নয়।
বিয়ের বৈধতা সমাজ দিলে সমাজেরও জানতে হবে সঙ্গী খারাপ হলে তাকে ত্যাগ করারও বৈধতা অবশ্যই আছে।
সমাজ নিয়ে ঢোলবাদ্য বাজিয়ে যদি বিয়ে করা যায় তবে খারাপ সঙ্গীকে ছাড়লে সমাজ বাহবা না দিক, খারাপ কেন বলবে!

অনেক তো হলো, এখন সমাজেরও এইসব ভাবা দরকার। তাহলে হয়তো সন্তানের সামনে মায়ের খুনি হিসেবে বাবা কিংবা বাবার খুনি হিসেবে মাকে দাঁড়াতে হবে না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.