বিয়ে নিয়ে কেন এতো সামাজিক সুড়সুড়ি?

দিনা ফেরদৌস:

জীব হিসেবে জৈবিক সব ধরনের চাহিদার সাথে সাথে বংশবিস্তারের চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তা সুন্দরভাবে পূরণের জন্যে বিয়ে একটি মাধ্যম। এর বাইরেও বিয়ে একটি ধর্মীয়, আইনানুগ ও সামাজিক একটি পরিচিত। বিয়ে একটি চুক্তি। চুক্তি যেখানে থাকবে হিসাবনিকাশের বিষয় চলেই আসবে। সবার সবাইকে পছন্দ হবে না, এটাও মাথায় রাখতে হবে। আবার যাকে অনেকের পছন্দ হবে না, তাকেও কেউ না কেউ খুঁজে নিয়ে যাবে। সবাই চায় তার পছন্দের মানুষ মনের মতো হবে, এর মধ্যে সৌন্দর্য (সৌন্দর্য আপেক্ষিক ব্যাপার। যার চোখে যাকে সুন্দর বলে মনে হয়), কাছাকাছি সামাজিক স্ট্যাটাস, শিক্ষাদীক্ষা, বয়স, আর্থিক অবস্থা, মানসিক চিন্তাভাবনার অনেক কিছুই চলে আসে। কেউ যদি মনের মতো সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পায় সেখানে দোষের তো কিছু নেই। কিন্তু নিজের সাথে শতভাগ মিল ও সমাজের সকলের ভাবনার সাথে শতভাগ মিলিয়ে যদি বিয়ে করতে হয়, তো বিয়ে না করেই থাকতে হবে আজীবন।

কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির বিয়ে পূর্ববর্তী কিছু আনুষ্ঠানিকতার ভিডিও। তা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। কেউ কেউ অভিনন্দন জানালেও বেশিরভাগই তার ওজন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন যেটা সরাসরি বর্ণবাদিতার পর্যায়ে পড়ে। কেউ কেউ বলছে সুন্দরী মেয়ে টাকার জন্যে তাকে বিয়ে করতে চলেছেন। যদিও সেই মেয়ের পরিবার আম্বানিদের থেকে কোন অংশেই অর্থনৈতিক, সামাজিক দিক দিয়ে কম নয় বলে জানা যায়। রাধিকা মার্চেন্ট আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে গিয়ে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। তাছাড়াও শাস্ত্রীয় নৃত্যে তার দখল আছে বলে জানা গেছে। সেই মেয়ের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল অনন্তের, যখন অনন্ত অনেক ফিট ছিলেন। আজ যদি রাধিকা অনন্তের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে না চাইতেন, তাও মানুষজন বলতো যে খারাপ সময়ে দাগা দিয়ে ছেড়ে চলে গেছে।

বিয়ে এমন এক সহজ বিষয় চাইলেই করা যায়। লম্বা লিস্ট নিয়ে বসে থাকবেন নিজের কোন যোগ্যতা ছাড়াই, আর ভাববেন, আমারে নেয় না কেন, দেখে না কেন, তা হয় না। বাংলা সিনেমার মতো রিক্সা ড্রাইভারকে কোটিপতির মেয়ে বিয়ে করবে না, কিংবা ‘কাজের বেটি রহিমা’কে কোটিপতির ছেলেও বিয়ে করবে না। সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এডজাস্ট করে চলাটাও একটা বিষয়। ভালোবাসা বাতাসে আসে না যদি সঙ্গীর সাথে চলতে গিয়ে সবকিছুতে গড়মিল থাকে।

ভালোবাসা হচ্ছে লেনদেনের ব্যাপার। যদি বলেন, কী লেনদেন? বলতে হয়, ‘চাহিদা অনুযায়ী যোগান’। অনেককে বলতে শুনি, মেয়েরা টাকা দেখে বিয়ে করে। সব পরিবারের স্বপ্ন থাকে; নিজেদের মেয়েকে আদর যত্নে বড় করে, পড়াশোনা করিয়ে যোগ্য করে তুলে; পড়াশোনা জানা বেকার (যাতে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে গৃহকর্মি হতে পারে) বা পড়াশোনা না জানা রিকশা চালকের কাছে বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখে না। অন্যদিকে পুরুষদেরও বদনাম করা হয়, তারা নাকি কচি মেয়ে পছন্দ করেন, বাচ্চাকাচ্চা পেতে চান। কচি মেয়ে (নাবালিকা না হলে) পছন্দ করা কি দোষের কিছু? যোগ্যতা থাকলে কম বয়সী ছেলেও তো বিয়ে করা যায় ফারাহ খান, ক্যাটরিনা, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথা বাদ দিলেও আমাদের দেশের সুবর্ণা মুস্তাফার বরও উনার থেকে বয়সে ছোট। সুন্দর বর পেতে হলে সুন্দরী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। সালমান খানের পালক বোন অর্পিতা খানের বরও তার থেকে অনেক সুন্দর, আর অর্পিতার প্রতি যত্নশীলও। কারণ সেই বর পাওয়ার যোগ্যতা বা ক্ষমতা তারা রাখেন।

অন্যদিকে আজকাল প্রায়ই দেখা যায় বয়স্ক বরের সাথে কম বয়সী সুন্দরী বউ। অনেকে বলেন টাকার জন্যে। টাকার জন্যে যদি হয়ও, আর সেই লোকের তাতে কোন সমস্যা না থাকে, তো আমাদের সমস্যা কোথায়? একজন মানুষ যদি ‘কচি’ মেয়ে (সাবালিকা ও সম্মতি ক্রমে) বিয়ে করে বেশি বয়সে বাচ্চা চান ও তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারেন, সেখানে আদৌ কি বলার কিছু আছে? আর সমবয়সী বিয়ে করলেই সকলে সুখী হয়ে যাবেন, এমন নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবেন?

জানি, সবাই শুধু বলার জন্যে এইসব বলেন না, তাদের ব্যক্তি জীবন ঘাঁটাঘাঁটি করলেই বেরিয়ে আসবে তাদের একাকিত্ব ও অবহেলিত হওয়ার গল্প। একই সংসারে থেকেও বহু স্বামী-স্ত্রী আলাদা বিছানায় ঘুমান। একই সংসারে থেকেও শারীরিক সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত অনেক দম্পতি। বলবেন, তারা তো সকলেই সংসার করেন। ওই প্রেমহীন, কামহীন সংসার করে যাওয়াটাই সমস্যা। সংসার করে যাওয়া; আর সুখে, আরামে মিলেমিশে সংসার করে যাওয়া এক কথা নয়। ফেইসবুকের হাসিমাখা ছবি দেখে যদি সংসারের সুখ মাপেন, তবে এটাও একটা অসুখ (কারণ তখন নিজের সাথে তুলনায় চলে যান অনেকে। ওই দম্পতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছে, ওরা হাঙ্কি পাঙ্কি ছবি দিচ্ছে। আমার কিছুই নেই)। সুখে থাকলে অন্যের ভালো থাকা দেখে জ্বলবে কেন? সুখে থাকা মুখের কথায় নয়, বরং সুখ কিনতে হয় ( শান্তি মনের ব্যাপার। যদি যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যায়। যাদের মনে শান্তি থাকে তাদের চুলকানি ব্যামো থাকে না, সব জায়গায়)। কী দিয়ে কিনবেন তা নিজেকে খুঁজে বের করতে হবে। এমনি এমনি সুখী হওয়া যায় না।

যোগ্যতা থাকলে বেশি বেশি কাবিন দিয়ে, মেয়ে অযোগ্য হলে, সাথে দামি দামি উপহার দিয়ে, বিদেশি পাসপোর্ট দিয়ে, বিশাল স্ট্যাটাস দেখিয়ে, বিয়ে যে কেউ, যাকে ইচ্ছে তাকেই করতে পারেন। কিছু মানুষের জন্মই হয়েছে বিয়ে করার জন্যে, কিছু মানুষ সারাজীবন সব যোগ্যতা অর্জন করে শুধু বিয়ে করবে বলে। কিছু মানুষ বিয়ের অপেক্ষায় দিন-রাত অপেক্ষা করে। কিছু মানুষ বিয়ের অপেক্ষা করতে করতে সারা জীবনই পার করে দেয়। আর কিছু মানুষ কিছুই করতে না পেরে শুধু লেকচার মারে, লম্বা লিস্ট বানায়, নিজেকে হেনতেন ভাবে, কিন্তু বিয়ের পানি আর গায়ে পরে না। দিনশেষে সবজিওয়ালাও কিছু সবজি বাজারে ফেলে যায়, নিজের ঘরে নিয়ে যাবার অবস্থায়ও থাকে না, হয়তো এক সময় দাম দেখে কেউ কাছে ভেড়াবার সাহসও করেনি। বিয়েটাও ওই রকম কিছুটা, বেশি দাম দেখাতে গেলে, চাহিদার লিস্ট বেশি বড় হয়ে গেলে দিনশেষে একাই পড়ে থাকতে হয়।

তাই দূর থেকে যাদের নিয়ে সমালোচনা করা হয় কেন তারা এমন সঙ্গী বেছে নিল যা তাদের সাথে মানায়নি, বিশ্বাস করেন তারা সকলে ভালো করেই জানে, কেন তারা এই সঙ্গী বেছে নিয়েছে। নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে তারা জ্ঞাত। এমনকি যেই মানুষ একা জীবন যাপন করছেন এবং বলেন; একা আছি ভালো আছি, সেটা আগে বিশ্বাস করলেও এখন করি না। কারণ একা একা ভালো থাকা যায় না। তার প্রধান কারণ মানুষ সবসময় বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গ চায়। শুধু শারীরিক চাহিদার জন্যে নয়, মানসিক কিছু চাহিদাও থাকে প্রতিটি মানুষের। এমনকি মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে পাশে কেউ একজন আছে এটা ভাবার মধ্যেও এক ধরনের শান্তি আছে। বিকেলে একসাথে বসে চা খাওয়ার মধ্যেও শান্তি আছে। যারা এমনটি বলেন; তারা হয়তো জীবনে এমন কোন করুণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন কোন এক সময় যার কারণে ভীতি কাজ করে।

আমার কিছু বন্ধু আছেন, তাদের কাজই হচ্ছে সব সময় অন্যদের নিয়ে মন্তব্য করা, কে, কাকে, কেন বিয়ে করবে? মানুষ বিয়ের সময় কেন বাহ্যিক সৌন্দর্যকে মূল্যায়ন করে। মানুষের শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানই আসল, রূপে নয়; গুনেই পরিচয়, সুন্দর মুখ থেকে সুন্দর মনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক সময় তাদের প্রতি বিরক্ত হতাম। শেষে খেয়াল করলাম তারা তাদের জায়গায় ঠিক। যার বাহ্যিক সৌন্দর্য আছে সে যদি তার সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারে; তো যার শিক্ষা, দীক্ষা, জ্ঞান আছে তারও তো অধিকার আছে সেই সবের বিজ্ঞাপন করার। যার যা নেই সে তা দেখাতে পারবে না, কিন্তু যা আছে তা দেখিয়ে, বলে, কয়ে, যদি কাঙ্খিত লক্ষ্যে কেউ পৌঁছাতে পারে; তো খারাপ কোথায়!

তারপরেও সত্যটা হচ্ছে, মানুষ সুন্দরের পূজারি। সুন্দর মানুষ হলেই গুণ থাকে না, শিক্ষা- দীক্ষা থাকে না এমন তো নয়। যার যোগ্যতা আছে মানে সামর্থ্য আছে, সে সব গুণে গুণান্বিত মানুষ পেয়েও যায়। কিছু সত্য আমরা মানি কিংবা না মানি, অন্ধকার ঘরে কে জ্ঞানী আর কে মহান বিদ্বান, কে রাজা আর কে প্রজা তা দিয়ে কাজ চলে না (সেটা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই), ওইখানে শরীরটাই মুখ্য। আপনি যদি নিজের সঙ্গীকে শারীরিকভাবে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন ( নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই) বয়স, চেহারা, যোগ্যতায় কিছুই যায় আসে না। এই যে সাংসারিক বোঝাপড়ার বিষয় আসে, মূল জায়গায় সন্তুষ্ট থাকলে বা রাখলে বাকি সবকিছুর সমঝোতা করে নেয়া যায়।

আমাদের বেশিরভাগ দাম্পত্য সমস্যা শুরু হয় বিছানা থেকে। আর অন্যদের নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় নিজেদের অবদমন থেকে। আমি পাই না, সে পায়। অনেককে বলতে শোনা যায়, রঙ, ঢং করি না, এটা ওটা প্রকাশ করি না, তাই অন্যদের মতো সঙ্গী জুটাতে পারি না। তাদের বেশিরভাগকেই দেখেছি রঙ, ঢং করতে যেই উপাদান বা যোগ্যতা লাগে তা তাদের মধ্যে নেই। রঙ, ঢং করার চেষ্টা আজকাল সকলেই কম বেশ করে ; ওই যে আমি জ্ঞানী, শিক্ষিত, চাকরি করি, হেন- তেন করি। এইসব কি বিজ্ঞাপন নয়? আর আমি আমিটাই হচ্ছে সচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। তবে ভালোবাসা তো আর ভিক্ষে করে পাওয়ার জিনিস না। “ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর কাঁকড়া” ই হয়। কাঁড়া কাঁকড়া তো আর নেবেন না। প্রত্যাশা রাখবেন বড় বড়, কিন্তু নিজের যোগ্যতা কী সেটাও খেয়াল করবেন না, তা হয় না। সত্যরে সহজে নিতে পারলেই ৫০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, আফসোসও কমে আসে। আর অন্যদের বেডরুমের বিষয় নিয়ে এতো ফ্যান্টাসি কাজ করে না। আমি ভালো আছি এই কথাটা দুনিয়ার মানুষকে জানানোর আগে যদি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারেন, তো দেখবেন ,কারো কোন কিছু দেখে হতাশা বা কষ্ট কাজ করছে না। তখন অন্যদের সমালোচনা করতেও ইচ্ছে হবে না।

কেউ যদি অন্যের ক্ষতি না করে তার মতো করে ভালো থাকতে পারে, প্লিজ তাদের ভালো থাকতে দিন। নিজেও অন্যদের সমালোচনা ছাড়া কীভাবে ভালো থাকা যায়, সেই রাস্তাটাই খুঁজে বের করুন। যারা ভালো থাকে সমালোচনায় তাদের আসলে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আপনি/ আপনারা যে ভালো নেই তা কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যায় সকলের কাছে। হতাশা, না পাওয়ার কষ্ট সবারই কমবেশি আছে, কিন্তু অন্যদের আক্রমণ করে শান্তি খোঁজাটা মোটেও যৌক্তিক নয়।

শেয়ার করুন: