জীবন একটাই, তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে যত্ন নিতে শিখুন

ইসাবেল রোজ:

আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় একটি মেয়ে উন্নত দেশে থাকে। (ও.সি.ডি) অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারে দীর্ঘদিন ধরে ভুগেছে। সম্প্রতি ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওর একটি মেয়েও আছে। বাবা মেয়েটির কাস্টডি চেয়েছে। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে অর্থাৎ বাচ্চা হওয়ার পর থেকেই ও.সি.ডিতে ভুগছে, কাজেই বাচ্চার কাস্টডি হারানোর সম্ভাবনা বেশি মেয়েটির। ও.সি.ডির কারণে বাসায় জিনিষপত্র ভাঙার রেকর্ড আছে ওর, সেখানে বাচ্চার সেইফটি নিয়ে অবশ্যই কোর্ট কনসার্ন হবে। মেয়েটি যেহেতু উন্নত দেশেই আছে, চিকিৎসার ত্রুটি সেখানে ছিল না। ডিভোর্স প্রসেস শুরু হতে না হতেই তার হাজবেন্ড অন্য একটি নারীর সন্ধান পেয়ে গেছে এবং সেখানেই বিয়ের আগ্রহ দেখিয়েছে। এসব কিছুই খুব স্মুদলি হয়েছে, কারণ মেয়েটির “মানসিক সমস্যা” আছে।

চৈতি চন্দ্রিকা, যার অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে।

চৈতি চন্দ্রিকার (চৈতি সাহা) মা এজাহারে লিখেছেন, চৈতির ‘মানসিক সমস্যা’ ছিল, তাই দরজা বাইরে দিয়ে আটকিয়ে তিনি ছাদে গিয়েছিলেন কাপড় আনতে, এসে দেখেছেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এই যে একটি লাইন “মানসিক সমস্যা” এইটুকু শুনেই মানুষ কনভিনসড হয়ে যায় যে তার পক্ষে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটানো সম্ভব।

গতকাল আমার এক বন্ধুর খালার সাথে কথা বলছিলাম। তার মেয়ে হাজবেন্ডের কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। মেয়ের বয়স ৩১। তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি সেই খালা একই কথা বারবার বলছে, তার মেয়ের ভালো তার থেকে কেউ বোঝে না, তার মেয়ের নাকি “মানসিক সমস্যা” আছে। তাকে জোর করে তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে চাচ্ছেন তিনি। কারণ মেয়ের জামাই কান্নাকাটি করে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসছে। মেয়ের জামাই লোকটি খারাপ না কিন্তু তাদের সমস্যা আছে (খারাপ না বলতে মেয়েটিকে ফিজিক্যালি বা মেন্টালি এবিউজ করে না), ছেলেটি মায়ের সাথে ঘুমায় এবং মায়ের কথামতো উঠাবসা করে বলে তাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে। যাই হোক বাস্তব অনেক আজব কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। এই দম্পতির মূল সমস্যা ডিটেইলে যাচ্ছি না, তবে তাদের মূল সমস্যা এতোটাই অদভুত যে আমার সম্পূর্ণ ধারণার বাইরে ছিল।

এখানেও মেয়েটির মায়ের দাবি তার মেয়ের “মানসিক সমস্যার” কারণে সে জামাইয়ের কাছে ফেরত যেতে চাচ্ছে না। সংসারে মেয়েদের অনেককিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মহিলাকে কিছুতেই বোঝানো গেল না যে তার মেয়ে কোন টিনএজার নয়, তাকে জোর করে পাঠিয়ে লাভ হবে না। মেয়েটির যেহেতু নিজের আয় রোজগাড় নেই, তাই তার মায়ের ধারণা, বাসায় ঠাঁই না দিলেই সে বাধ্য হয়ে ফেরত যাবে!

এতোসব কাহিনীর একটাই কমন লাইন, “মানসিক সমস্যা”, “মানসিকভাবে ঠিক নেই” “মাথা নষ্ট”, “মানসিক ভারসাম্য হারানো”। এই একটা লাইন বললেই সবাই ভাবে, ঠিক আছে. ঠিক বলতেছে. মানসিক সমস্যা মানে মাথায় গণ্ডগোল, পাগল, মেন্টাল, তার ছেঁড়া, মাথার নাট-বল্টু ঢিলা… আপনাদের মনমতোন প্রচলিত শব্দ বসিয়ে নিন।
এসব বলে যেকোনো কাজকে জাস্টিফায়েড করা যায়।
আত্মহত্যা করেছে? মাথায় সমস্যা ছিল।
ভাঙচুর করেছে? মেন্টাল পুরা।
মারধোর করেছে? খামচা-খামচি করেছে? পুরাই পাগল। মানসিক সমস্যার কারণে ডাক্তার দেখানো লাগে কি এমনি এমনি?

প্লিজ প্লিজ, মানসিক সমস্যা মানেই “মাথায় গণ্ডগোল” মনে করবেন না।
“সাইকোসিস” এবং “নিউরোসিস” এর পার্থক্য বুঝতে শিখুন। সব মানসিক সমস্যাকে এক পাল্লায় মাপা বন্ধ করুন।
নিউরোসিস মানে যারা নিজেদের আচরণ সম্পর্কে অবহিত থাকে, তারা কাউন্সেলিং করতে চায়, মেন্টাল হেলদ প্রফেশনাল এর শরণাপন্ন হতে চায়, তারা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সাইকোসিস পেশেন্টদের বেশিরভাগই ধারণা করতে পারে না যে তার কোন সমস্যা আছে, তার আচরণে অন্যের এবং নিজের সমস্যা হতে পারে, এসম্পর্কে তারা অবহিত থাকে না, তাদের নিজেদের করা কাজ তারা রেকগনাইজ করতে পারে না।

মনে রাখবেন উভয়ই আত্মহত্যা করতে পারে, এক্সট্রিম যেকোনো কিছু করতে পারে না এমন দাবি করছি না। শুধু বুঝতে হবে উভয়কে একই মানসিক সমস্যা বলে আখ্যায়িত করবেন না।
মানসিক সমস্যার প্রকার ভেদ আছে। মানসিক সমস্যা মানেই মাথা খারাপ নয়। মানসিক সমস্যার সব মানুষগুলোকে একই দলভুক্ত করবেন না। মানসিক সমস্যাটা কী ধরনের ছিল প্রশ্ন করতে শিখুন। ব্যক্তি নিজে অবহিত ছিল কিনা? নিজে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইতো কি না?? সব মানসিক সমস্যাকে গুলিয়ে ফেলবেন না।

আমাদের দেশে কেউ একজন মেন্টাল হেলদ প্রফেশনাল এর শরণাপন্ন হলে তাকে আমরা বিভিন্নভাবে উপহাস করি, আবার কিছুক্ষেত্রে সেই এডভান্টেজ নিতে দেখি।

যেমন – ওসিডিতে আক্রান্ত মেয়েটি বাচ্চার কাস্টডি নিয়ে মামলা কোর্টে উঠলে তার স্বামীর প্রমাণ করা সহজ হবে বাচ্চাটি মায়ের কাছে কতটা নিরাপদ।

আবার চৈতির ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করেছে দাবি করাটা এপ্রোপ্রিয়েট হয় যখন তার এন্টি ডিপ্রেসেন্ট প্রেস্ক্রিপশনগুলো পুলিশের সামনে প্রমাণস্বরূপ হাজির করা যায়, মানসিক সমস্যা ছিল বলে এজাহারে লিখে দিলেই সন্দেহের তালিকা থেকে নাম উঠানো সম্ভব।

তেমনি একজন মা যখন দাবি করে মেয়ের “মানসিক সমস্যা” আছে, সবাই মিলে চাপ প্রয়োগ করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে বলে, সবাই একবাক্যে মায়ের পক্ষেই দাঁড়ায়. এইখানে খুব সহজে টক্সিক প্যারেন্টিং মায়ের চোখের দু’ফোঁটা জলে ঢাকা পড়ে যায়।

সবশেষে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। একসময় হার্ট এটাক, ডায়বেটিস এসব নিয়ে এতো তথ্য মানুষ জানতো না। নিজেদের ভালো রাখার তাগিদে মানুষ এখন স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের চেষ্টা করে। অতিরিক্ত তেল, ঘি, লাল মাংস অনেকেই সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে নিজেদের প্রতি যত্নশীল হোন। নিয়মিত ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন। বেশি করে হেলদি খাবার খান, শরীরচর্চায় মন দিন। দিনশেষে একটাই জীবন। চাইলেও চিরদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই জীবনটা উপভোগ না করেই চলে যাবেন কেন?

শেয়ার করুন: