সিলেবাসের বাইরে অন্য এক সমাজের কথা

ঈহিতা জলিল:

আজ এসএসসি’র রেজাল্ট হলো।
জিপিএ পাওয়া, না পাওয়া, সকলকে অভিনন্দন।
সার্টিফিকেট জরুরি, কিন্তু সার্টিফিকেটই জীবনের সবকিছু নয়। সার্টিফিকেটের ভালো রেজাল্ট অবশ্যই আত্মবিশ্বাস দেয়। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিষয় আছে যা আমি আমার সন্তান ও সন্তানসমদের বলতে চাই।

আমার বাবা সবসময় বলতেন বসার মধ্যে ভদ্রতা আছে, খাবার মধ্যে ভদ্রতা আছে, হাঁটার মধ্যে ভদ্রতা আছে। ছোটবেলায় আব্বুর ঐ কথাগুলো শুনে আমার হাসি পেতো। মনে মনে ভাবতাম আব্বু যে কী বলে! হাঁটার ভদ্রতা আবার কী!
এখন যখন নিজে রাস্তায় চলি তখন বুঝি, হাঁটার ভদ্রতা আসলে কী!

ফুটপাথ হেলেদুলে চলার জায়গা নয়। বিশেষত যে ফুটপাথে বেচাবিক্রি চলে! হাঁটার একটা নির্দিষ্ট গতি আছে। আমরা যখন রাস্তায় চলি তখন মাথায় রাখতে হবে আমার আগে পরে আরো লোকজন চলছে। একেকজনের জীবনের গতি একেক রকম। হেলেদুলে বেড়াবার জায়গা রাস্তা বা ফুটপাথ নয়! এরজন্য নিজের বাড়ী। তা নাহলে পার্কে যাওয়া যেতে পারে! মাঝে মাঝে আমরা রাস্তায় এমনভাবে হাঁটি যেনো আমরা একেকজন স্বাধীনবাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা!

বসার ভদ্রতা হলো, কারো সামনে, গুরুজন স্থানীয় তো নয়ই, এমনিতেও এমনভাবে পায়ের উপর পা তুলে না বসা যেনো দেখতে অস্বস্তি হয়। একান্ত যদি বসতেই হয় তাহলে অনুমতি নিয়ে বসা। দুইপা দুইদিকে ছড়িয়ে না বসা। জুতা বা স্যান্ডেল ঘষে ঘষে না হাঁটা।

খাবার ভদ্রতা হলো, খাবার সময় শব্দ যত কম করে খাওয়া যায় সেটির খেয়াল রাখা, খাবার মুখে নিয়ে কোন কথা না বলা, একান্তই যদি বলতে হয় তাহলে মুখ হাত দিয়ে ঢেকে কথা বলা। প্লেট একবারে ভরতি করে খাবার না নেওয়া। প্রয়োজনে বার বার নেবো কিন্তু একবারে প্লেট উঁচু করে নয়।খাবার আগে শেষ হলে পাশেরজনের অনুমতি নিয়ে ওঠা।

কমনসেন্সের ব্যবহার খুব জরুরি। আমরা যখন দেখবো দুজন মানুষ কথা বলছেন, তখন হুট করেই এর ভিতর ঢুকে পরবো না। যদিবা ঢুকেও যাই, তাহলে কুশল বিনিময়ের পর যত দ্রুত সম্ভব সরে আসবো। আমাদের দেশে একটি খুব বাজে অফিস সংস্কৃতি আছে, আমরা অফিসের বড় কর্তার ঘরে একবার ঢুকতে পারলে আর বেরুতে চাই না। এটি যেনো আমরা কমিয়ে আনি। এতে যেটি হয় অন্য সহকর্মীরা কথা বলার সুযোগ পায় না। এখন এটি তো খুব সহজেই বোঝা যায় ঊর্ধ্বতনের কাছে তাঁর অধস্তন যে ব্যক্তিগত কথা বলবেন, সেটি নিশ্চয়ই তাঁর সহকর্মীদের সামনে বলবেন না!

এবারে যে বিষয়টি বলবো বলেই এতো কথা বললাম। সেটি হলো, একটা সময় আমাদের দেশে একটি সংস্কৃতি ছিলো, বোর্ড পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীকে আত্মীয়-পরিজন দেখতে আসতেন। এরপর হলো পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে একটা দিন রাখতেন ঘুরে ঘুরে সব মুরুব্বীদের দোয়া নেবার জন্য। মোবাইল আসায় সেটি আরো সহজ হয়েছে। মোবাইলে দোয়া চাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু খুব সম্প্রতি আমাকে কিছু বিষয় খুব নাড়া দিয়েছে।
আসলে আমি বেশ কয়েকবছর ধরেই এটি খেয়াল করেছি। আমাদের সময়ও যে এমনটা ছিলো না তা নয়। সংখ্যায় কম ছিলো। কিন্তু আমাদের শিশুদের মধ্যে আদাব/সালাম/নমস্কার/হ্যালো বলার, কুশল বিনিময় করার প্রবনতা একদম কমে গেছে।

কোন মানুষ অন্তর্মুখী, কোন মানুষ বহির্মুখী আবার কোন মানুষ এই দুটোর সমন্বয়ে তৈরি। কিন্তু গুরুজনকে সম্মান দেওয়া এবং ছোটকে স্নেহ করা এটি একেবারেই বেসিক শিক্ষা। আমরা বেশিরভাগ এখন মোবাইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপসহ বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করি। সেখানে টুক করে একটা মেসেজ দেওয়াই যায়। কিন্তু এর বাইরেও একটা জেনারেশন এখনও রয়ে গেছেন, যারা এতে অভ্যস্ত নন। তাদের কাছে গিয়ে দোয়া নিতে হয়! আমরা যেন এটি খেয়াল করি। আমি এমনও শুনেছি, পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে বের হয়েছে, পাশে একজন আত্মীয় মুরুব্বী দাঁড়িয়ে আছেন। পরীক্ষার্থী সালাম তো অনেক পরের বিষয়, একবার বলারও প্রয়োজন মনে করেনি, “আমার জন্য দোয়া করবেন”! এটি কিন্তু অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে! আমরা আধুনিক হয়েছি, তার মানে এই নয় আমরা আমাদের গুরুজনদের অসম্মান করার লাইসেন্স পেয়ে গেছি!

বডিল্যাংগুয়েজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয়তো মুখে কিছু বললাম না কিন্তু আমার চেহারা, হাঁটাচলা, বসা দিয়ে আমাদের সামনের জনকে অপমান করতে পারি। আপাতদৃষ্টিতে এটা হয়তো বোঝা যাবে না। কিন্তু এর প্রতিফলন দেখা যাবে কাজের ক্ষেত্রে যেয়ে। আমরা যেমন হাত কচলে বিগলিত হবো না আবার আমাদের ড্যামকেয়ার এটিটিউড যেনো কারও অমর্যাদার কারণ না হয়!

আমি একজন সদ্য বয়ো:সন্ধিতে যাওয়া সন্তানের মা। আমার মা একবার আমার কাছে আমার সাথে পড়া একজন মেধাবী ছাত্রের কথা বলেছিলেন, “এ্যই তোদের কেমন ভালো ছাত্ররে রাস্তায় দেখা হলে সালাম দেয় না”! এটি আমার মাথায় রয়ে গেছিলো। আমার সন্তানের শুরু আমি করেছিলাম, বাসার সাহায্যকারী, দারোয়ান, ড্রাইভারসহ রাস্তায় যাকে যাকে সে চেনে, তাদের সব্বাইকে সালাম দিতে হবে। এখন ওর এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অভিভাবকেরা এটা ট্রাই করতে পারেন!

আমাদের সমাজের অনেক পচে যাওয়া জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু সৌন্দর্যও আছে। যা এককে অপরের সাথে জুড়ে রাখে। বিভিন্ন কারণে-অকারণে আমাদের মধ্যে একা হয়ে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের পরের প্রজন্মকে যেমন সমাজের পঁচে যাওয়া জায়গাকে ডাক্তার হয়ে কেটে বাদ দিতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া, অপারেশন করতে হবে, আবার আমাদের সমাজের আলোকিত অংশকেও ধরে রাখতে হবে। আমরা তো চলে যাবো। আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সম্প্রীতি বেঁচে থাকবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্য দিয়ে। আমাদের দায়িত্ব তাদের প্রত্যেকের হাতে সেই আলোর মশাল ধরিয়ে দেয়া। যার আলোয় আলোকিত হবে আমাদের সমাজ।

নতুন বছর সকলের জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনুক।

ঈহিতা জলিল
লেখক ও সাংবাদিক
৩০.১২.২১
বৃহস্পতিবার
বিকাল-০৩.৫৫ মিনিট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.