সুপ্রীতি ধর:
১৯ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’। দিবসটি উদযাপনের ক্ষেত্রে পুরুষের অর্জন, অবদান, বিশেষ করে কমিউনিটি, পরিবার, বিয়ে এবং সন্তান লালন-পালনের দিকগুলি তুলে ধরাই ছিল মূল লক্ষ্য। আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে মৌলিক মানবিক গুণাবলীগুলোকে উন্নীত করাই ছিল দিবসটি উদযাপনের আসল উদ্দেশ্য। বিশ্বের আশিটিরও বেশি দেশে ১৯ নভেম্বর দিবসটি পালিত হয়। এবারের পুরুষ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ” নারী পুরুষের আরও ভালো সম্পর্ক।”
৮ মার্চ যেমন আন্তর্জাতিক নারী দিবস, নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপের দিন, তেমনিভাবেই বিশ্ব পুরুষ দিবসেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু চোখে পড়েনি। অথচ খুব বেশি করে হওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই আলোচনাটা জারি করা উচিত খুব জোরেশোরেই।
অনেক আগে একবার একুশে টেলিভিশনের এক সাক্ষাতকারে বলেছিলাম যে, গত তিন-চার দশকে বাংলাদেশে তথা সমগ্র বিশ্বেই যেভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর উন্নয়ন নিয়ে কাজ হয়েছে, তার বিন্দুমাত্রও হয়নি পুরুষের জন্য। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে বিদ্যমান অধিকাংশ ব্যবস্থাই পুরুষবান্ধব, তাই আলাদা করে তাদের জন্য ভাবা হয় না। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, এটা সম্পূর্ণই ভুল।
একটা উদাহরণের কথা গতকালই শুনছিলাম যে সংসারে ছেলেমেয়ে দুই সন্তানের মধ্যে একজনকে আপনি ছেড়ে দিলেন দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা করার স্বাধীনতা দিয়ে, আরেকজনের পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখলেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে দুজনকেই একসাথে দৌড় দিতে বললেন। তাহলে কী হবে? যার পায়ে এতোগুলো বছর বেড়ি পরানো ছিল, স্বাভাবিকভাবেই সে দৌড়াতে পারবে না। পিছিয়ে থাকবে দৌড়ে, জীবনের দৌড়ে শুরুতেই পিছিয়ে থেকে খুব বেশিদূর তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না, হয়ও না।
এখন এই গল্পটাই যদি একটু অন্যরকম করে বলি! ধরুন, যাকে আপনি অপার স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দিলেন, সে মাঠে-ঘাটে-জঙ্গলে দৌড়ালো, দৌড় শিখলো। কিন্তু অপরজনকে আপনি একটা নিয়মের মধ্যে কতগুলো টেকনিক শেখালেন, কীভাবে কয় পা ফেলে, কতদূর যেতে পারবে, কীভাবে যেতে পারবে, কীভাবে গেলে তার লক্ষ্যে সে পৌঁছাতে পারবে, আরও শেখালেন, কীভাবে নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতে হয়, কোনটা তার অধিকার, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। অত:পর দুজনকে আবারও দাঁড় করালেন। এখন কী হবে? একজন বন্য হিসেবে গড়ে উঠেছে অতিরিক্ত স্বাধীনতা পেয়ে, আরেকজন কতগুলো সুশিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছে। তাহলে চলার পথ কি দুজনের একইরকম মসৃণ হবে? হবে না। মেয়েটি তখন এগিয়ে যাবে নানাভাবেই। স্বভাবতই তখন সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে, ছেলেরা কোণঠাসা হয়ে যাবে। আর এতে করে নারী নির্যাতনের হারও বাড়বে। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে হেরে গিয়ে তখন শারীরিক শক্তির ওপরই তারা ভরসা করবে পুরুষ। সাম্য, সুশিক্ষা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
দেখুন, আমরা যখন নারীবাদ, নারী অধিকার নিয়ে এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলি, তখন কিছু পুরুষ লম্ফঝম্প শুরু করে দেয়, তারা অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করে বলেই এরকম আচরণটা করে বলে আমি মনে করি। তারা তখন চায় আমাদের দমিয়ে রাখতে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা যখন বাড়তে শুরু করেছে, সেই পুরুষেরা কিন্তু কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ক্রমেই। এটাকে মোটেও আমরা পুরুষের বিরুদ্ধে সাফল্য হিসেবে দেখছি না। আমরা সবাই মানুষ তো। পুরুষ আমার বাবা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক, স্বামী, সন্তান। এই পুরুষেরও ভয় করে অন্ধকার ঘরে, তেলাপোকা, মাকড়শা কিংবা সাপ দেখলে। পুরুষেরও ডিপ্রেশন হয়, মুড সুইং হয়।
পুরুষেরও লজ্জা লাগে, অস্বস্তি হয়। তারও হয়তো কিছুই হতে ইচ্ছা করে না জীবনে। সংসারের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা করে না, তার হয়তো সারাজীবন তার নিজস্ব ভালো লাগার মধ্যেই বসবাস করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের সেই ইচ্ছাকে থোড়াই কেয়ার করে। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় জগদ্দল পাথর। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের তখন দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেই পুরুষটাকে আমি অনুভব করতে পারি। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট পুরুষটি কি দিনশেষে কোথাও তার এই কষ্টের কথা বলতে পারে? কাঁদতে পারে একা একা? পারে না। আর এই না পারার কারণেই জন্ম নেয় হাজার হাজার হার্ট এটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আত্মহত্যা, নির্যাতন, শোষণ।
যেমনটা বলেছেন আমার একজন বন্ধু যে পুরুষতান্ত্রিকতা পুরুষদের ওপর প্রচণ্ড রকমের পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে যুগের পর যুগ। এই চাপ থেকেই তারা মাদকাসক্তি, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এই চাপ নিতে না পেরে ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিপীড়কও হয়ে ওঠে। এগুলো নিয়ে সোস্যাল অডিটিং বা রিসার্চ হওয়া এখন সময়ের দাবি। পুরুষের মুক্তি না মিললে নারীরও মুক্তি নেই। এটা একটা সরল হিসাব। পুরুষদের মুক্তির কথাও তাই জোরেশোরেই বলতে হবে, রেখে ঢেকে নয়।
আমরা তো একটা ইনক্লুসিভ সমাজব্যবস্থা চাই সবার সমান অংশগ্রহণে, সবার সমান অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে। যেন নারী-পুরুষ সবাই সমান দায়িত্ববান হয়, সবাই যেন তাদের নিজ নিজ কাজটা ঠিকমতো করতে শেখে। এ যাবতকাল আমরা মেয়েদের নানারকম শিক্ষা দিয়ে এসেছি এটা করো না, ওটা করো না, এখন সময় এসেছে ছেলেদের এই শিক্ষা দেয়ার, যাতে করে তারা জন্মের পর থেকেই বুঝতে পারে, আলাদা কোন স্পেসিস তারা নয়, একটুও বেশি অধিকার নিয়ে তারা জন্মায়নি। এই বোধটা জাগ্রত করতে পারলে সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য অনেকখানিই কমে আসতে বাধ্য। আমি এভাবেই দেখি বিষয়গুলো, ভুলও হতে পারে আমার দেখায়। কিন্তু একদম জন্মের পর থেকে যদি একইরকম বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলেমেয়ে উভয়ই বড় হয়, তবে ভবিষ্যতে এর সুফল ভোগ করবে সবাই। সবদিক থেকে লাভবান হবে সমাজ, এবং রাষ্ট্র। নারী-পুরুষ উভয়ের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা এখন অত্যন্ত জরুরি।
আসুন, পুরুষ দিবসে আমরা সকলেই এক ও অভিন্ন ‘মানুষ’ হওয়ার অঙ্গীকার করি। আর বেশি করে আলাপ করি দিবসটির তাৎপর্য নিয়ে, গুরুত্ব নিয়ে।