এক সুতোর ওপরে ঝুলে থাকে যে জীবন!

সাজু বিশ্বাস:

কিছুদিন ধরেই বিয়ে এবং ছাড়াছাড়ি নিয়ে একটা নতুন ট্রেন্ড চালু হচ্ছে। ‘বনিবনা হচ্ছে না, একটা যৌথ স্টেটমেন্ট দিয়ে দুজনে আলাদা হয়ে গেলাম।
আমরা দুজন এখনো খুব ভালো বন্ধু, ভবিষ্যতেও খুব ভালো বন্ধু থাকবো। আমরা আমাদের পরিবারের প্রতিও দায়িত্বশীল থাকবো, এমনকি একসাথে কাজ করতেও আমাদের অসুবিধে নেই। কিন্তু এখন থেকে আমরা আর স্বামী স্ত্রী নই’।
সবচেয়ে নিকটতম সময়ে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে এটাই মনে হয় সবচেয়ে আধুনিক বিবৃতি।
বিল- মেলিন্ডা, আমির- কিরণ, আমির- রিনা, সর্বশেষ অনুপম -প্রিয়া।

সামনাসামনি এই স্টেটমেন্ট ভালোই লাগে।
খুব ছোটবেলায় পড়া পুরনো সাময়িকীর কথা মনে আছে, — প্রিন্সেস ডায়ানা প্রিন্স চার্লসের সাথে প্রেম করার জন্য ক্যামিলা পার্কারকে গালগালি দিচ্ছিলেন ‘কালি কুত্তি’ বলে।
সেই অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে এসে… এই চিন্তা করেই আমি আনন্দিত ছিলাম।
কিন্তু পরপর দুইদিন আমার কাছাকাছিই দুটো মেয়েকে ঠিক বিপরীত অবস্থায় দেখতে পেলাম।

দুটো মেয়েরই বয়স চল্লিশের উপরে। দুজনেরই একটা করে বাচ্চা আছে, তারা বেশ বড়ও হয়ে গেছে। নারীরা সংসার গুছিয়ে উঠেছেন কেবল, এই পর্যায়ে তাদের স্বামীরা নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এদের মধ্যে প্রথম নারীর চেহারা বেশ সুন্দর – টানা চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ, চমৎকার চিকন দেখতে- বেশ পরিপাটি হয়ে থাকেন। তিনি নিঁখুত গৃহিণী ছিলেন। হঠাৎ একদিন স্বামী এসে বলছেন, ‘অমুকরে ছাড়া বাঁচতেছি না’। শ্বাশুড়ি বললেন, ‘এটাই তো স্বাভাবিক – পুরুষ মানুষ দুই বিয়ে অস্বাভাবিক কিছু না। মেনে নিয়ে সংসার সন্তান ঠিক রাখো’। কিন্তু মেয়েটির প্রচণ্ড আত্মসম্মানে লাগলো। সে ঘর-সংসার-বাচ্চা রেখে সেই পায়ে বের হয়ে পড়লো। আমি আগুনে ঘি ঢালার মতন একটা বেকুবি প্রশ্ন করে বসলাম তাকে।
‘আপনি বাচ্চা ছাড়লেন’?
এই প্রশ্নে সে নিজেই কেবল কষ্ট পেলো না, তার উত্তরে আমিও কষ্ট পেয়ে গেলাম।
‘আমার কাছে তখন নিজের খাবারও চারপয়সা নেই, আমি বাচ্চাকে খাওয়াবো কী! এরপর ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে জীবন বাঁচালাম’।

দ্বিতীয় দিন যার সাথে দেখা তিনি একদম ভেঙে পড়েছেন। তিনি গৃহিণী বলতে একদম ঘর থেকে না বের হওয়া গৃহিণী। তিনি হাউমাউ করছেন, আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার বাচ্চার কি হবে!
লোকটা আরেক জায়গায় বিয়ে করেছে লুকিয়ে।
টুকরো টুকরো কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বুঝলাম, ইনার বিয়ে হয়েছে ষোল বা আঠারো বছর বয়সে। এখন তার কুড়ি বাইশ বছরের ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া একটি মেয়ে আছে। এই কুড়ি বাইশ বছর তিনি কেবল মন দিয়ে সংসারই করেছেন। হঠাৎ দেখলেন, যে লোকটি সংসারের প্রধান অর্থনৈতিক উৎস, তিনি লুকিয়ে আরেকটি বিয়ে করে তার জীবন নিয়ে আরেকদিকে রওনা হচ্ছেন।
ইনাকে কী বলবো, ইনি এখন তার জীবন কোথা দিয়ে এনে কোথায় জুড়বেন, এমন কোনোও বুদ্ধি আমার মাথায় ঢুকলো না! না তিনি লেখাপড়া শেষ করেছেন, না তার বাইরে গিয়ে কিছু করার মতো মানসিক শক্তি আছে!

এখন নিজের মনে আবার পুরনো হিসেব কষতেছি।
বাইরের দুনিয়া যত চকচকে আধুনিকই হোক, যতই মানুষের চমৎকার যৌথ স্টেটমেন্ট দেখি না কেন, আমাদের দেশের মতন সমাজে ঐ জিনিস একেবারেই অকার্যকর! যে মেয়ের নিজের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই, যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সে নিজের জীবনের বিষয়ে ভাববে কেমন করে! আক্ষরিক অর্থেই স্বামী এখানে প্রভুর মতোই। দাসানুদাস হয়ে থাকতে পারো। সেটাও উপার্জনকারী লোকটার মর্জির উপর নির্ভর করে। এইবারে কোনো কায়দায় সেই লোক যদি পা পিছলায়ে যায়, মেয়েটি তার সংসারসুদ্ধ আছাড় খেয়ে পড়ে!

যে মেয়েটির ষোল বা সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় সে ওইটুকু বয়সে কতটুকু লেখাপড়া করার সুযোগ পায়! এসএসসি থেকে বড় জোর এইচএসসি। মোটামুটি একটি স্বচ্ছল পরিবার একজন কর্মজীবী মানুষ খুঁজে বের করা হয় তার জন্য। এইক্ষেত্রে ছেলেদের পছন্দের বিষয়টিও লক্ষ্য করার মতন।
ছেলের বয়স ধরার মধ্যে নয়। যে বয়সী পাত্রই হোক, সুন্দরী এবং কম বয়সী মেয়েই তার প্রথম পছন্দ।
আর বিয়ে বলতে তো আমাদের সমাজে পুরো পরিবারের সাথে বিয়ে। স্বামীর সাথে এই জীবনে বন্ধুত্ব হয় না। স্বামী হলেন শ্রদ্ধার মানুষ, ভালোবাসা হলো মনিব আর বিশ্বস্ত সহযোগীর মধ্যে ভালোবাসা– পার্টনারশিপ নয়।
পার্টনারশিপ হতে গেলে সমানে সমান হতে হয়।
মেয়েটি তো আগেই পিছনে পড়ে গেল! তার শিক্ষাজীবনই শেষ হতে পারলো না!
শিক্ষা জীবন যদিও বা শেষ হলো সংসারে ঢুকে তার সমস্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করে স্বামী লোকটির উপর।
তার কর্মস্হল কোথায় হবে, সেখানে কাজের পরিবেশ কেমন– সেগুলো বিবেচনা করার মালিক হলেন স্বামী। দুজনের সংসার হলে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। কিন্তু সেই কম্প্রোমাইজ সব সময় নারীরই হয়। সংসারে জটিলতা আসছে, তুমি চাকরি ছাড়ো। সন্তানদের বড় করতে হবে, তুমি সামলাও। মেয়েটি নিজেকে নিয়ে আর কখনোই ভাবার সময় পায় না। সে একটি চক্রব্যুহের মাঝখানে এগিয়ে যেতে থাকে। বিরাট বিরাট দায়িত্ব তার! সন্তানের মা, সমাজ বলে দিয়েছে মা হওয়া কী মুখের কথা! সে প্রাণপণ দৌড়ায়, তাকে শ্রেষ্ঠ মা হতেই হবে! বাচ্চার স্কুল- বাচ্চার টিউশন – বাচ্চার যত্ন… এরপরে আছেন স্বামী। তিনি তো তার পুরো সংসারটাই মেয়েটির উপরে ছেড়ে দিয়েছেন! এতো বড় আস্থার কোনোও তুলনা হয়! মেয়েটি আবার প্রাণপণে সামলায়, পাঁচ হাজার টাকায় অবশ্যই পুরো মাসের বাজার চালাতে হবে। ছেলেকে রিকশায় করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজে কিছুটা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। নিজের হাত-পা কিছুটা সচল হলো, পথে পাশ থেকে দৈনন্দিন টুকটাক বাজারও সারা হলো, নিজের সংসারের দুই পয়সা বাঁচলোও। মেয়েটি এইভাবে একটু একটু করে সংসার গোছায় আর নিজের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।

নিজে কে! নিজে আবার কী! যত্তসব স্বার্থপরতা! সে এখন এর মা ওর বউ। সে নিজে কেউ নয়। তারপর একদিন সবাই তাকে একঘেয়ে ভাবা শুরু করে। প্রতিদিনের চলতি ফিরতি একঘেয়ে মানুষ। অথবা সবার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, কারণ তার নিজের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। তার কাজ শুধু মেনে নেওয়া। বেচারা পার্টনার লোকটিও তাই একদিন আশা করে সে একটি প্রেমই তো করেছে, সে আর এমন কী দোষের… মেয়েটি মেনে নিক না! পুরুষ মানুষের এমন হতেই পারে। মেয়েটির এতোদিনের পরিশ্রম, এতোদিনের আত্মত্যাগ — একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসার.. সব হঠাৎই যেন ধ্বসে পড়ে। সে আবিষ্কার করে সে নিজে কেউ নয়! নিজে থাকা মানে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকা। তাহলেই অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, ‘ঠিক আছে, বনিবনা যখন হলো না আমরা তাহলে আমাদের নিজের পছন্দ মতন আলাদা আলাদা জীবন কাটাই। তবে আমরা অবশ্যই ভালো বন্ধুও থাকবো’।

আমাদের হয় উল্টো, মেয়েটি হঠাৎই নিজেকে বিপন্ন আর নিরাশ্রয় বোধ করে। কয়েকটা দেনমোহরের টাকা বা স্বামীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে আদালত বা নিকটবর্তীদের কাছে ছুটতে হয় সম্পর্ক ফয়সালা করার জন্য।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.