সুগারকোটেড লাইন দিয়ে মায়ের কষ্ট কমে না

ফারজানা নীলা:

একজন অসুস্থ মানুষের কাছে কী আশা করেন আপনারা? সে নিজের যত্ন নিবে। সে যদি এই অসুস্থতার কোনো ভুল করে তাহলে ভুল হিসেবেই দেখা হয় সাধারণত। আহা বেচারি অসুস্থ! তাহলে একজন সদ্যজাত মায়ের কাছে তেমন আশা করি না কেন?

সন্তান কীভাবে পালতে হবে মায়েরা মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না। কাটা পেট নিয়ে, কাটা ভিন নিয়ে বাথ যন্ত্রণা নিয়ে একজন সদ্য জন্মানো শিশুর দায়িত্ব নিতে হয়। সে তখন থাকে জীবনের সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায়, মানসিক আর শারীরিক দুটোই।
তাকে শেখানো হয়, শিখতে হয়। এবং এই শিক্ষার কাজটা হয় ধীরে। আজ থেকেই যে কাজ আমাকে করতে হবে,সেই কাজ ভুল হবেই। ভুল হতে গিয়ে মায়েরা শিখে কোনটা তার বাচ্চার জন্য ভালো কোনটা ভালো না। কিন্তু মায়েদের যদি চুন থেকে পান খশে, তবে সবাই তেড়ে আসে মাকেই কথা শুনাতে।
মা কেন শুয়ে শুয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে?
অথচ মা তখন বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতাও রাখে না। মা তখন জানেই না শুয়ে দুধ খাওয়ানো উচিত না।
মা কেন রাতে ডায়পার বা কাঁথা চেঞ্জ করে দেয়নি? ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলেছে বাচ্চার!
অথচ বেচারি তখন ঘুম যেতে না পারার যন্ত্রণায় কোন ফাঁকে বেহুশের মতো ঘুমিয়েছে বলতেও পারে না।
মা কেন বাচ্চাকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ দিতে পারছে না?
অথচ বেচারি জানেই না কেন কী অপরাধে তার শরীরে দুধ উৎপাদন কম হচ্ছে!
কাটা ভেজাইনা নিয়ে প্রস্রাব করতে কলুর বলদের মত পরিশ্রম করতে হয়। যন্ত্রণায় মনে হয় যেন জীবনেও প্রস্রাব না বের হোক! অথচ শুনতে হয় বাথরুমে এতোক্ষণ থাকলে হবে? বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে না?
এতো আস্তে আস্তে খেলে হবে? বাচ্চা কাঁদবে তো!
অথচ পেট কাটা আর ভ্যাজাইনা কাটার পর থেকে সে শান্তিতে দুইটা ভাত খেতে পারে নাই।
সারাদিন বাচ্চা নিয়ে থাকলে হবে? আমরা তো এক হাতে বাচ্চা পালছি, আরেক হাতে সংসার সামলিয়েছি। তোমার মতো এতো ননাই করিনি!
যাকে ভাত খাওয়ার আর বাথরুম করার সময় দিতেও নারাজ, তাকে আবার বাচ্চাকে সময় দেওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয়। কিরকম কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার ভেতর দিয়ে যেতে হয় একজন নতুন মাকে!
যে কথাগুলো বলে সেও কোনোদিন এই পজিশনে এই অবস্থায় ছিল, তবুও বলে। কারণ তাকেও কেউ এভাবেই শুনিয়েছে। সেও নতুন মা হওয়ার বিমূঢ়তা সহ্য করেছে, শারীরিক মানসিক যাতনা চেপে গেছে, কিন্তু সে জেনেছে, বুঝেছে, মেনেছে যে মেয়েমাত্রই এসবের সম্মুখীন হতে হয়। একবার দুইবার নয়, ছয়, সাত, দ,শ এগারো, যতগুলো জন্ম হয়, ততবারই সহ্য করতে হবে।
এবং তারা সহ্য করে দিন শেষে নিজেকে জয়ী ভেবেছে। কারণ এগুলো সহ্য করতে না পারলে মা হওয়া আর কীসের!
যে সহ্য করতে পারবে না সে আসলে নাটক করে! বেশি ননাই। মেয়েদের এতো ননাই হলে হয় না।

মেয়েদের তাহলে কেমন হতে হয়?
ইস্পাতের মত কঠিন। সকল কাজ মায়ের পেট থেকে শিখে আসা কোনো অত্যাধুনিক রোবট। যার কোনো ভুল হতে পারে না, অন্তত সন্তানের বেলায় তো অবশ্যই না।
কেন মায়েদের ভুল কষ্ট আমরা মেনে নিতে পারি না? কারণ আমরা কিছু সুগার কোটেড কথাকে ধ্রুব সত্য ভাবি।

যে মুহূর্তে বাচ্চার চেহারা দেখবা সেই মুহূর্ত থেকে বাচ্চা হওয়ার সব কষ্ট ভুলে যাবা।
বাস্তবতা হলো, বাচ্চার চেহারা সাময়িকভাবে মাকে তৃপ্তি দেয়। কিন্তু মায়ের কাটা শরীরের যন্ত্রণা কোনো জাদুবলে গায়েব হয়ে যায় না।
বাচ্চা হলে রাতের ঘুম ভুলে যাও। দুই বছর একটু কষ্ট হবে আরকি! তোমার মাও করছে না? এখন তুমি করবা!
দুই বছরে কতগুলা রাত থাকে? অসুস্থ শরীর নিয়ে রাত জাগতে জোছনা দেখার ফিল হয় না। মাটি খুঁড়ে সেটার ভেতর লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। রাগের মাথায় বাচ্চাকেও মারতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু গোপন কান্নার ভেতর দিয়ে মুখ টিপে সয়ে যায়, যেমন আমাদের মা’রাও সহ্য করেছে আড়ালে। সেই আড়ালের নীরব কান্না কে দেখেছে? কে খোঁজ রেখেছে?

আমরা মেয়েরা মায়ের জাত। আমাদেরই তো ক্ষমতা আছে জন্ম দেওয়ার। আমাদেরই সহ্য ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে বেশি বলেই আমরা জন্ম দিতে পারি। ।
মেয়েরা জন্ম দিতে পারে বলেই তারা যে মিষ্টি মুখে নিয়ে জন্ম দেয় তা না। জন্মদানের ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করেই জন্ম দেয়। এই ভয়াবহ যন্ত্রণার সময় মনে হয় মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ!

শুধু কি প্রসব যন্ত্রণা ? এই দুর্বল আর অসুস্থ শরীর নিয়েই তাকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হয়। এবং সবাই আশা করে সন্তান মায়ের কাছে আছে মানে সব ঠিক।
অথচ ঐ অসুস্থ মানুষটার যে এখন শারীরিক, মানসিক শান্তি দরকার, সেটা কিন্তু ভুলে যাই। নতুন শিশুর আগমনের খুশিতে সবাই ব্যস্ত শুধু শিশুটিকে নিয়ে। খুব অদ্ভুত ভাবে আমরা ভুলে যাই যে এখন একটা দুর্বলতম শরীরের সর্বাত্মক যত্ন দরকার।
তার সাথে রাত জেগে তাকে একটু সাহায্য করা। তাকে বাথরুম আনা নেওয়া, বিছানা থেকে উঠানোর জন্য একজন আপন মানুষ হাসিমুখে পাশে থাকা, তার রক্তে ভেসে যাওয়া পোশাক দেখে বিরক্ত না হওয়া, দুধ খাওয়ানোর সময় বার বার না বলা, “দুধ পায় না কেন”, “বাচ্চার পেট ভরে না”, তার মানসিক সুখের কথা ভেবে তার পছন্দের খাবার দেওয়া, সে যে একটা প্রাণের আগমন ঘটিয়েছে তার জন্য তাকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ধন্যবাদ দেওয়া , তাকে ঘিরে আয়োজন উৎসব করা; সেই ক্ষতবিক্ষত নারীকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ করে তুলে দ্রুত।

কিন্তু না, আমরা এসব করতে চাই না। আমাদের মাথায় সেট করা নারীর কাজ জগতের সকল যন্ত্রণা হাসিমুখে অথবা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা। কারণ এটাই নারীর একমাত্র কাজ!
কেউ জানে না বুঝতেও পারে না একজন সদ্য প্রসূত মায়ের কেমন লাগে যখন সে বিছানা থেকে উঠতে পারেনা, কেউ থাকে না তাকে হাসিমুখে সাহায্য করার। যে বা আসে খুব বিরক্ত হয়, তখন সেই মায়ের বুকের ভেতর কেমন আগুন যন্ত্রণা হয়। সেটা বুঝতে পারে কেউ?

একজন সদ্য প্রসূত মায়ের সামনে যখন বার বার বলা হয় “বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না, তোমার থেকে কেন পায় না, আমাদের সময় তো এমন হয় নাই” তখন সে যে কী চরম হীনমন্যতায় ভুগে, সেটা একজন মা ছাড়া জগতে কারো বোঝার ক্ষমতা নাই।

একজন শিশুর জন্মের পর একজন নারীর জীবন আর কোনোভাবেই আগের মত থাকে না। আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। এই পরিবর্তন হবে জেনেই একজন নারী গর্ভবতী হয়। এই পরিবর্তনের সাথে সে কিন্তু এটা চায় না যে তার বাচ্চা আরেকজন পালন করে দিবে বা আরেকজন রাত জাগবে, দুধ খাওয়াবে।
সে শুধু এটা চায় যেন তার সবচেয়ে আপন মানুষজন তার এই অসুস্থতাকে কষ্টকে যন্ত্রণাকে আসলেই কষ্ট যন্ত্রণা অসুস্থতা মনে করে তাকে মন থেকে সাহায্য করুক।
তার সাথে কেউ রাত জেগে তাকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিক। সে নিজ থেকে বাথরুমে যেতে চাইলে তার প্রিয় মানুষটি নিজ থেকে এগিয়ে এসে বলুক ” আরে আমাকে ছাড়া বাথরুম যাচ্ছো কেন? আমার হাত ধরো”।
কেউ বলুক, “বাবুর জন্য তুমি তো খেতে পারছো না, আসো তোমাকে খাইয়ে দেই”।
বাচ্চা কাঁদলে, খেতে না পারলে মা’কেই দোষ না দিয়ে, কটু কথা না শুনিয়ে কেউ মাথায় হাত রেখে বলুক, “আরে চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে শিখে ফেলবে”।

ক্লান্তিতে নির্ঘুম থেকে থেকে যখন নিজেকে অসহ্য মনে হবে, চরম অসুখী মনে হবে, মনে হবে এই ক্লান্তি আর কোনোদিন শেষ হবে না, বা হুট করে ইচ্ছে করবে মরে যাই, তখন যেন প্রিয় স্বামীটি পাশ ফিরে নাক না ডেকে একটু সান্ত্বনা দিক। বলুক, ‘আমি তো আছি, তোমার সকল অসুখে, তোমার সকল যন্ত্রণায়’।
তার মা সমতুল্য শাশুড়ি যেন বুঝে এটা একটা কষ্টদায়ক অধ্যায়। এই কষ্টে সে যেন শাশুড়ি না হয়ে মা হয়। বলুক , তুমি শুধু নিজের যত্ন নাও, বাকি আর কিছু ভাবতে হবে না।
বাবুকে কেউ রেখে বলুক, যাও একটু ঘুরে আসো, নিদেনপক্ষে একটু ছাদে গিয়ে বসো। একটু চা’টা টিবি দেখতে দেখতে খাও, বা বসে আরাম করে ভাত খাও,বাবু আমি দেখছি।

এইটুকুই। আর কিছুই না। এর বেশি আর কিছুই চায় না মায়েরা।
একটু সহমর্মিতা, একটু সাহায্য, একটু ভালোবাসা, একটু কষ্টের ভাগীদার হওয়া।
এইটুকু পায় কয়জনে?

শেয়ার করুন: