কানামাছি সংসার

কাকলী তালুকদার:

আজ সরলার সাধ, বাড়িভর্তি মানুষ। সরলার মা, ছোট বোন, ছোট ভাই এসেছে সরলার বাড়িতে সাধ খাওয়াবে বলে। নিত্য খেটে খাওয়া সংসার হলেও বড় মেয়ে সরলা এই প্রথম মা হতে যাচ্ছে তাই সরলার মা মেয়ের জন্য নিজ হাতে করা মুড়ি, চিড়া, খই, ফলমূল আর দুইটা হাঁস নিয়ে এসেছেন। মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের জন্য কাপড়ও এনেছেন। সরলার মা এই প্রথম এলো মেয়ের বাড়িতে।

তপনের সাথে সরলার ছয় বছর সংসার জীবন।

তপনের বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই এই গোপন কথাটি সবাই জানে, শুধুমাত্র সরলার জানতে সময় লেগেছে তিন বছর। সরলার আগে তপনের আরও দুইটি বিয়ে আছে, এই কথা সরলা প্রথম জানতো না। এখন সবই জানে সরলা, প্রথম প্রথম এই সব নিয়ে তপনের সাথে ঝগড়াও হয়েছে। আগের দুই জনের একজনও আজ যেহেতু সংসারে নাই, তাই সরলা শেষপর্যন্ত সব মেনে নিয়েছে। এইসব কথা আশেপাশের মানুষজন সরলাকে বলেছে, তপন কোনোদিন বলেনি।

তবে তপন এর যে বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই এই কথাটি সরলার পাশের বাড়ির এক জা বলেছে। সরলা প্রথমে কথাটি বিশ্বাস করতে পারেনি, তবে তিন বছরের বিবাহিত জীবনে যেহেতু কোন বাচ্চা তার পেটে আসেনি কথাটি অবিশ্বাসও করতে পারছে না সরলা।
আজ সরলার পেটে যে বাচ্চা তার জন্য সবার মনে গোপন প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকলেও সরলাকে কেউ জিজ্ঞেস করার সাহস নেই।

সরলার শাশুড়ি মন্দাকিনী খুব খুশি মনে সাধের আয়োজন করছেন। ছেলে কোনোরকমে সংসারটা চালায়, তবে আজ  মন্দাকিনীর খুশির দিন, ছেলের ঘরে প্রথম নাতির মুখ দেখবে এর চেয়ে আনন্দের খবর মন্দাকিনীর কাছে আর কিছুই নেই। বাড়িতে তপনের দুই বোনও এসেছে।

সমাজের অনেককেই নিমন্ত্রণ করেছেন মন্দাকিনী।
তপন তার ভুলের মাশুল কীভাবে গুণবে সেই ব্যাপারে কোনোদিন চিন্তা করেনি, তাই সরলার পেটের বাচ্চা নিয়েও আজ সে খুশির অভিনয় করে যাচ্ছে নীরবে। তপনও খেটে খাওয়া মানুষ, ভাটি এলাকায় সব সময় কাজও মিলে না। তাই বর্ষাকালে সে মাছ ধরে বাকি সময় কৃষি কাজ করে।

নিজের জমি নেই, তাই কয়েক জনের একটা দল আছে তপনের, বোরো ফসলের সময় এই দল নিয়েই তপন ধান লাগায়, ক্ষেত বাছা, ধান কাটার কাজ করে। সারা বছর যা কাজ করে মা-সহ তিন জনের সংসার কোন রকমে চলে। মাঝে মাঝে টান পড়লে ধার দেনা করতে হয় তপনের। সাধের খরচের জন্য গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে সুদে পাঁচ হাজার টাকা এনেছে তপন।

ছোট ঘরটিতে আজকে অনেক আনন্দ, কিন্তু তপন শুধু জানে এই সন্তান তার না, ভিতরে তার যন্ত্রণা, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না।

সরলা তপনের তিন নম্বর বউ, আগের দুই বউও তপনকে ছেড়ে চলে গেছে, তারাও জেনে গেছিলো তারা কোনদিন মা হতে পারবে না। কিন্তু সরলা তপনকে ছেড়ে যায়নি এতোটুকু ভেবে তপন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। আর ভাবতে থাকে কয়েকটি টাকার লোভ আজ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করলো।

এরশাদ সরকারের আমলে কেউ একজন তপনকে এসে জানালো একটা ছোট অপারেশন করলে ১২০০ টাকা আর একটা লুঙ্গি দেয় সরকার। তখন ১২০০ টাকাকে অনেক টাকা মনে হয়েছিল তপনের। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আর দুই বোনকে নিয়ে কত দুর্দিন কাটাতে হয়েছে তপনের। সেই সময় তপন চিন্তা করে নাই এই  ছোট্ট অপারেশন তার জীবনটাকে বিষময় করে তুলবে একদিন।

সেইদিন ১২০০ টাকা আর একটা লুঙ্গির জন্য গ্রামের অনেক পুরুষই অপারেশন করেছিল, তবে তাদের সবারই দুই থেকে ছয়জন করে বাচ্চা ছিল। শুধুমাত্র তপন আর ফটিক ছিল অবিবাহিতদের দলে। সেদিন তপন যদি জানতো তার ঘরেও একটা বউ আসবে একদিন, তার নিজেরও বাবা হবার সাধ হবে, তবে সেই অপারেশন সে করতো না।
এতো কিছু চিন্তা করার মতো বয়সও তপনের ছিল না তখন, তার বয়স একুশ কী বাইশ হবে! যিনি অপারেশন করেছিলেন তিনি বারবার তপনকে বলছিলেন, তোমার জন্য না এই অপারেশন। কিন্তু সেদিন তপন এর ১২০০টাকা বেশি দামি মনে হয়েছিল। সেই সময় কোনোরকম ঘরে একবেলা খাবার জুটাতে পারতো না তপন।

সরলার প্রথম তিন বছর সুখ-দুঃখ, ঝগড়া-বিবাদ নিয়েই তপনের সাথে সংসারটা চলছিল। যখন সরলা নিশ্চিত হলো তপন তাকে কোনোদিন বাচ্চা দিতে পারবে না তখন সে নিজেকে আরও সাহসী করে ভাবতে লাগলো।
তপনের এক বন্ধু হরহামেশাই তাদের ঘরে আসে। তপনের দলে অনেকেই কাজ করে, তারা সবাই আসে ঘরে তপনের খোঁজে। মাঝে মাঝে তপন ঘরে থাকে, মাঝে মাঝে থাকে না। তবে তপনের একজন বন্ধুকে সরলা বিশেষ পছন্দ করে। সরলার এই পছন্দ গত তিন বছরে আরও মাথা চাড়া দিয়েছে যখন তপনের অক্ষমতা সম্পর্কে সরলা জেনেছে।

আজকাল তপনের সেই বন্ধু ঘন ঘনই আসে, তপন টের পায়। প্রথম প্রথম এই নিয়ে সংসারে ঝগড়াঝাঁটি চলতেই লাগলো। এখন আর তপন কিছু বলে না সরলাকে, কোন মুখে বলবে? সরলা  তো তাকে জানিয়ে দিয়েছে,  ‘বেশি অশান্তি করলে আগের দুই বউয়ের মতো আমিও বাবার বাড়িত যাইয়াম গা’।

মহাজন তপনকে বলল, দেরা সুদে টাকা পাবি। ৫০০০ টাকায় ৭৫০০ দিবি তিন মাস পর। টাকা ঠিক সময়ে না দিলে তোর কামলা দেয়ার টেকা থাইকা কাইটা রাখবাম। তপন এই সুদের টাকা সারা বছরই গুনে, বিপদে পড়লে ভাটি অঞ্চলে সবাই মহাজনের কাছে হাজির হয়। আজকাল মহাজনের সংখ্যাও বেড়ে চলছে গ্রামে। তপনের মতো গ্রহিতার সংখ্যাও বাড়ছে গ্রামে।

তপন মনে মনে ভাবে, সেদিন ১২০০ টাকার লোভ না করলে আজ মহাজনের কাছ থাইকা পাঁচ হাজারে সাত হাজার দিতে হতো না। নিজের বউয়ের পেটে অন্তত নিজের একটা সন্তানও থাকতো।
সাধের দুই মাস পরই সরলার মেয়ের জন্ম। সরলা মেয়ের নাম রাখে পরীমনি। পরীমনি চোখের সামনে বড় হচ্ছে, তপনও মেয়েকে আদর করে, কোলে নিয়ে ছোট্ট বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। একসময় তপনকে বাবা বলে ডাকতেও শিখে। তপনের বুকে ক্ষত সারতে থাকে মেয়ের ‘বাবা’ ডাক শুনে।

মেয়ের বয়স এখন তিন বছর, তপনের সাথে পরীমনির খুব ভাব। বাবার সাথে পরীমনির সবখানে যাওয়া চাই, এটাই পরীমনির বায়না।

তপন পরীমনিকে নিয়ে উঠানে খেলছে কানামাছি খেলা। সরলা বমি করতে করতে দরজায় এসে আস্তে করে নিচে পড়ে গেল। তপন দৌঁড়ে গিয়ে সরলাকে ধরে, মুখে বলতে থাকে, পানি দেও পানি।

পাশের বাড়ির কেউ একজন দৌঁড়ে পানি নিয়ে আসে। সরলার মাথায়, চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। সরলা চোখ খুলে তাকায়, তপন চেয়ে আছে সরলার মুখের দিকে। কী হইছে সরলা? ডাক্তার লইয়া আই? সরলা তপনকে বলে, ‘ডাক্তার ডাকুন লাগদো না। এক মাস ধইরা খাইতে পারি না, খালি বমি বমি লাগে, পরীমনির সময়ও এমন হইছিল’।

তপনের বুকের ভিতর কে যেন খামচি দিয়ে ধরে, আস্তে করে উঠে তপন উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। পরীমনি একটা গামছা নিয়ে দৌঁড়ে তপনের কাছে আসে আর বলতে থাকে, ‘বাবা গামতাটা তোকে বান্ধ, আমলা কানামাতি কেলি। পরীমনির মুখের আদর আদর কথা শুনে তপন পরীমনিকে বুকের কাছে টেনে নেয়।

শেয়ার করুন: