নাজরাতুন নাঈম:
শরৎচন্দ্রের বাংলাদেশ।
শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। স্বামী রেঙ্গুন গিয়ে আর ফিরে আসছে না। প্রবাসীর স্ত্রী দীর্ঘদিন স্বামীর কোন খবর না পেয়ে রওয়ানা দিয়েছিল, যাওয়ার পথে এক দয়াবান মানুষের সাহায্য পেয়েছিল, সেই তাকে ঠিকানা অনুযায়ী ঐ নারীকে তার স্বামীর কাছে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে স্বামী আরেকজন নারীকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে ঐখানে। স্ত্রী তাকে সরাসরি হাতেনাতে ধরায় সে রেগে গিয়ে বউকে দিল অপবাদ। বললো, সেই দয়াবান মানুষটিই নাকি তার প্রেমিক। শুধু অপবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, প্রচণ্ডভাবে মেরে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করলো।
শরৎচন্দ্রের যুগ কবেই শেষ হয়েছে, কিন্তু সমাজের যেন কোন পরিবর্তন হয়নি। পরিমণি যখন বিচার চাইলো তার কিছুদিন পরই শুরু হলো তাকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা। যে বিচার সে চেয়েছিল তা না করে তাকে বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে কোর্টে নেয়া হলো এবং আরও অনেক বিষয়ে জড়ানো হলো, মনে হলো পরিমণি যেন সমস্ত সমাজের একমাত্র উচ্ছৃঙ্খল মদ্যপানকারী, পুরুষ প্রলুব্ধকারী।
জাপানি দুই শিশুর ডাক্তার মা এই লকডাউনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে ভিনদেশে গিয়ে বাচ্চাদের উদ্ধার করতে এসেছে। সে পুরোপুরি বাংলাভাষা জানে না। এখন একদল সাংবাদিক তার চরিত্র স্খলনে উঠে পড়ে লেগেছেন। বলছেন, ওই নারী নষ্টা, ঢাকায় বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাঁটছে। একজন নারীর সাথে থাকতেও পারে কোন পুরুষসঙ্গী, বিদেশ বিভুঁইয়ে গেলে যে কেউ সঙ্গী রাখতেই পারে। একজন পুরুষের সাথে কোন নারী হাঁটলেই সে বয়ফ্রেন্ড বা জামাই হয়ে যায় না। আর যদি হয়ও তাতেও বাচ্চার অভিভাবকত্ব হারিয়ে যায় না। পৃথিবীর কোন আইন বাচ্চাকে মা থেকে আলাদা করে না।
বাচ্চাদের বাবা এখন বলছেন, বাচ্চাদের বাংলা শেখাতে চায় না ওদের মা। তা এতোই যদি বাংলা বাংলা করেন তাহলে কেন জাপানী নারীকে বিয়ে করলেন? বাংলাভাষা, ধর্ম যদি সত্যিই ভালবাসতেন তাহলে জাপানী নারীকে বিয়ে করার সময় ভাবা উচিত ছিল। বাচ্চাদের বাবাকে দেখলাম ইমোশনাল ইস্যু তুলে বিচারকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। ভাষা আন্দোলন, আরও অনেক কিছু বলে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের মতো বক্তব্য দিচ্ছেন। এই বাচ্চাগুলোর কাছে বাংলাদেশ, জাপান দুই সংস্কৃতিই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মা বা বাবা কেউই তাদের কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে পারেন না। এই বাচ্চাগুলো জাপানে বড় হয়েছে, তাই জাপানের সংস্কৃতির প্রভাব থাকবেই তাদের মাঝে।
কেউ কেউ বলছেন জাপানে না গিয়ে বাংলাদেশে থাকলে বাচ্চাগুলো ভালো থাকবে, নামাজ কালাম শিখবে, অথচ বাচ্চাগুলো জাপানের সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। কেউ বলছেন, বাবা তো কয়েকমাস পরে আরেক বিয়ে করবে, সৎ মা কি তাদেরকে নিজের মায়ের মতো লালন পালন করবে? মেয়ে বাচ্চাদুটো বয়োসন্ধিতে উপনীত হচ্ছে, এরকম সময়ে মা সাথে থাকাটা খুবই জরুরি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।
বাচ্চাগুলোর জন্য মা-বাবা দুজনেই সমান। তাই প্রত্যাশা করবো যেন বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে মা-বাবা সুন্দর একটি সমঝোতায় আসেন। আবেগের বিষয় আইন আদালত দিয়ে সমাধান করা যায় না। আইনি লড়াইয়ে মা অথবা বাবা একজন জয়ী হবে, কিন্তু সন্তানরা বঞ্চিত হবে মা অথবা বাবার ভালবাসা থেকে। এই দম্পতি উচ্চশিক্ষিত, উনারা যদি বাচ্চাদের জীবনকে দুর্বিষহ করেন, তাহলে সমাজের আম জনতা কী করবে? স্বামী, স্ত্রী শিক্ষিত, নিজেরাই তো সুন্দরভাবে বসে এই বিষয়ের সুরাহা করতে পারেন। উকিল, পুলিশ, সাংবাদিক, জনতা সবার মাঝখানে কোর্টে বাচ্চাদের এনে আইনি লড়াই চলছে, শিশুরা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের একান্তভাবে জেরাও করা হচ্ছে, তারা ভয়ে কাঁপছে, শিশুদের করুণ, কান্নাভেজা চোখ দেখে খুব কষ্ট লাগছে।
এ কেমন মা আর কেমন বাবা যারা বাচ্চাদের মানসিক দিকটির কথা একবারও চিন্তা করছেন না? বাচ্চা দুটোর কথা ভেবে এই দম্পতি যেন ক্ষান্ত হোন। আইনি জটিল পরিস্থিতি থেকে বাঁচান শিশুদের। আইনে যদি কোন সংশোধন দরকার হয় তাহলে ও করা দরকার, কারণ দিন দিন এই ধরনের পরিস্থিতি বেড়েই চলেছে দেশ-বিদেশে।
এখনও বিচ্ছেদপরবর্তী বাচ্চাদের নিরাপত্তা, স্নেহ-মমতা এসব ব্যাপারে খুব ভালো সমাধান আসেনি, আর কিভাবে হবে সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা এখনও সফল সমাধান দিতে পারেননি, আর এজন্য যে দেশই হোক না কেন, দাম্পত্য বিচ্ছেদ মানে হাহাকার , শিশুদের কান্না , সন্তানদের নিদারুণ কষ্টের জীবন ।
দাম্পত্য কলহে যখন স্বামী স্ত্রী পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে দুজনেই দুজনকে বেকায়দায় ফেলতে চান, যেকোনো পন্থা অবলম্বন করে ঘায়েল করতে চান, আইনি লড়াইয়ে যখন হারজিত খেলায় মেতে উঠেন, তখন সন্তানদের মনোজগতকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেন। দম্পতিরা যখন নিজের ইগোকে প্রাধান্য দেন তখন ভুলে যান সন্তানদের মানসিক অবস্থা। অনেক বুদ্ধিমান স্বামী-স্ত্রীও যখন কলহে লিপ্ত হন ভুলে যান সন্তানরা তো কোন দোষ করেননি। বেশিরভাগ দেখা যায় সন্তানদের কাছে কুৎসা রটিয়ে একজন আরেকজনকে সন্তানদের কাছে ঘৃণিত করে তুলেন। অথবা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সন্তানের আস্থা অর্জন করেন। ঝগড়ায় লিপ্ত মা-বাবা দুজনেই সন্তানদের ব্যবহার করেন পরস্পরের রেষারেষির মাঝখানে। এতে সন্তানরা হয় চরমভাবে বিব্রত, বিষন্ন, আতংকিত। দাম্পত্য কলহ সন্তানদের নিয়ে আসে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিভীষিকাময় অসুস্থ জীবন। জাপানি বাচ্চা দুটোর এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির জন্য তাদের মা বাবার দাম্পত্যকলহ, ইগো, জেদ, আগ্রাসী মনোভাব, পিতৃত্ব, মাতৃত্ব সবকিছু প্রভাব ফেলছে। দুজনেই বাচ্চাদের মানসিক অনুভূতিকে ক্ষত বিক্ষত করছেন, একটি বেসিক ব্যাপারে দম্পতি দুজনের মিল রয়েছে, যেটা হলো দুজনেই সন্তানদের সমপরিমাণ ভালবাসেন, আর এই ভালবাসা যদি কৃত্রিম না হয় তাহলে এই একটি ইস্যু মাথায় রেখে দুজনেই দুজনের দোষক্রটিকে ক্ষমা করে পুনরায় সংসার শুরু করতে পারেন অথবা একটা সমঝোতায় আসতে পারেন। এর জন্য পারিবারিক আদালত এই দম্পতিকে ম্যারেইজ কাউন্সিলিং এর আওতায় নিতে পারেন।
CEO, স্বদেশ বাংলাদেশ অনলাইন চ্যানেল
প্রাক্তন প্রভাষক
সিলেট মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় , কলেজ