সুমনা সরকার:
প্রতিটি শিশুই দেহের বহিরঙ্গের কী কাজ তা বোঝে এবং বলতে জড়তা বোধ করে না। বহিরঙ্গের মধ্যে স্তনও একটি। স্তনের কী কাজ, সেটা টাটকা স্মৃতি বা কোন শিশুর তখনো মায়ের দুধ পান করার কারণে সে অবলীলায় নিঃসঙ্কোচে বলে দিতে পারে।
নিজ অভিজ্ঞতায় দেখেছি শিশু যখন বড় হতে থাকে মানে, বয়সটা শৈশব বা কৈশোরে উঠি উঠি করে তখন তার ভিতরে স্তন বিষয়ে সাবলীলতা কমে আসে, তবে স্তন থেকে দুধ পান না করলে সে যে বেঁচে থাকতে পারতো না , সেটা তখনও ভোলে না। তবে আস্তে আস্তে মানব/মানবী যতো পরিণত হতে থাকে ততোই স্তন নিয়ে তার ভিতরে এক ধরনের আড়ষ্টতা তৈরি হয়। এই আড়ষ্টতার কারণ তখন সে স্তনের সাথে যৌনতার সর্ম্পক নির্মাণের চক্করে পড়ে।
অথচ স্তনের সাথে যৌনতার কোন সর্ম্পক নেই। এটি পুঁজিবাদের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর নির্মাণ। এটি কৃত্রিম এবং আরোপিত। পুঁজিবাদ দেহের অন্য অঙ্গ রেখে স্তনকে যৌনতার সাথে জুড়ে দেবার রাজনৈতিক-অর্থনীতির উদ্দেশ্য নিয়ে পরে আলোচনা করছি। শুরুতে আলোচনা করছি কেন এটি নির্মিত, সহজাত নয়।
প্রথমত যৌনতার সাথে স্তনের সম্বন্ধ যদি প্রাকৃতিক হতো তবে সকল সমাজেই স্তন দেখে যৌনতাড়িত হবার প্রবণতা প্রকাশ পেতো। কিন্তু যৌনাকাঙ্খা দেশ-কাল- পাত্র ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। কোন সমাজে নারীর খোলা পা, খোলা চুল, স্লিভলেস হাত দেখলেও যৌনাকাঙ্খা জেগে উঠে। আবার পশ্চিমে শীতের শেষে সামারে প্রায় নগ্ন অবস্থায় এমনকি কোন কোন সমুদ্র সৈকতে নর-নারীরা উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। এতে কেউ ভ্রক্ষেপ করে না বা এতে করে ঐ সমাজগুলোতে যৌন অস্থিরতা বা অপরাধও বাড়ে না।
দ্বিতীয়ত নারীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে যদি যৌনতার সম্পর্ক আদিম বা প্রাকৃতিক হতো তবে শরীরী প্রদর্শন শুধু নারীতেই বাঁধা থাকতো। কিন্তু এই সময়ে পুরুষরাও সস্তা শরীর উপস্থাপনে বাধ্য হচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে।
ছোটবেলায় দেখেছি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আজিম, জসিম, তাপস পালদের মতো ভুঁড়িসর্বস্ব ব্যক্তিও দাপটের সাথে খোদ নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে যেতে। কিন্তু হাল জামানায় এমন দৈহিক গড়নের কোন ব্যক্তি কি মূলধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারবে? আগে শুধু নারীরাই পণ্য হতো। নাটক- সিনেমা –বিজ্ঞাপনে তারাই উদোম হতেন আর দৈহিক সৌন্দর্য ধরে রাখার নানা কষ্টকর কসরত যেমন জিম, ডায়েট তাদেরকেই করে যেতে হতো। কিন্তু পুঁজি যেহেতু চোখ বাঁধা ছুটন্ত ষাঁড়ের মতো, সে শুধু মুনাফার পিছনে ছোটে। তার কাছে নারী, পুরুষ, টিনএজ, শিশু সবাই পণ্য। পুরুষ এবং টিনএজরা কম বিপদে নেই! পুরুষদের ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’ এই হিরোইজম ইমেজ এবং যৌন আবেদনযোগ্য করে উপস্থাপনার কারণে তাকেও স্লিম কিন্তু পেশিবহুল শরীর তৈরি করতে হয়। মনের আনন্দে কিছু খাওয়া, মা বা স্বজনের ভালোবাসামিশ্রিত খাবার মুখে তোলার উপায় নেই তাদের। প্রায় অভুক্ত ডায়েট এবং জিমেই শো-বিজদের এখন আসল ঠিকানা।
প্রযুক্তির চরম বিকাশের কারণে কল- কারখানায় যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের দৈহিক শ্রম আগের মতো তেমন প্রয়োজন হয় না। ফলে নারী ও শিশুরাও কারখানার গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে কারখানার মালিকও বনে যেতে পারছে। নারী এবং শিশুরা শ্রমিক হবার কারণে তাদের হাতে অর্থ আসছে, তারা বাজারে প্রবেশ করছে। পুরুষের মতো সংখ্যাটা অতো বিশাল না হলেও ভোক্তা হিসেবে নারী এবং শিশুর পরিমাণটা এখন মোটেও ফেলনা নয়। ভোক্তা নারী ও শিশুর কথা বিবেচনায় নিয়েই পুরুষ বা শিশুদেরকে যৌন আবেদনময়ী করে পরিবেশনের প্রবণতা বাড়ছে। পুরুষরাই এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই আজমেরী হক বাঁধনরা পিঠ-বুক খোলা পোশাক পরে কান উৎসবে উড়ন্ত চুমু (ফ্লায়িং কিস) দিতে দিতে লালগালিচায় হেঁটে যায়। পুঁজির মালিকানা বা ভোক্তায় যদি পরিবর্তন ঘটে মানে নারীরা যদি পুরুষের জায়গা নেয় তখন দেখা যাবে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদসহ কানে অংশগ্রহণ করা পুরুষরা শর্টস/জাঙ্গিয়ার সাথে পেশি প্রদর্শিত হয় এমন স্লিভলেস পোশাক পরে নারীদের উদ্দেশ্যে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়তে ছুঁড়তে লালগালিচায় হাঁটছে।
এখন আসি স্তনকে যৌনাঙ্গ হিসেবে প্রকাশের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়ে। পুঁজিবাদ কিন্তু সকল সমাজে একই আচরণ করে মুনাফা অর্জন করে না। কোন সমাজে কী ধরনের কর্তৃত্বের বোধ ক্রিয়াশীল তার ওপর নির্ভর এর আচরণ। কর্তৃত্বের বোধ ঢিলেঢালা বলেই পশ্চিমা বিশ্বের মেয়েরা পোশাকের ক্ষেত্রে বিপুল স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। এই স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য অবশ্য পশ্চিমা নারীদের বিভিন্ন লড়াই-সংগ্রাম এবং ভোক্তা ও পুঁজির মালিকানায় প্রবেশ করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা সেই জায়গাতে পৌঁছাতে পারিনি। সেই কারণে এখানে নারীর সকল কিছুই হয় পুরুষের সাপেক্ষে এবং আমাদের সমাজে পুরুষের চোখে আপাদমস্তক নারী মানেই ‘যৌনতার সাথে সংশ্লিষ্ট’।
আমাদের দেশসহ এমনও অনেক সমাজ বা রাষ্ট্র আছে যেখানে নারীদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেই যৌনতার নির্মিতি দেয় পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো। এ প্রসঙ্গগুলো হাজির করলাম এটা পরিষ্কার করতে যে, পুঁজিবাদের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো চাইলেই নারী দেহের যেকোনো অঙ্গের সাথে যৌনতার সম্পর্ক জুড়ে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে বা দেয়। সেটা প্রবল রক্ষণশীল এবং উদার যে সমাজ কাঠামোই হোক না কেন।
নারীর চোখ-কান-পা, হাতকে বাদ দিয়ে স্তনকে যৌনতার নির্মিতি দেবার পিছনে রয়েছে গভীর দুরভিসন্ধি। পুঁজিবাদ যে শ্রমিকের শ্রম চুরি করে সেটি এখন সর্বজনস্বীকৃত। কিন্ত সে যে গার্হস্থ্য নারীর শ্রমকেও শোষণ করছে এ নিয়ে কিছু কিছু নারীবাদী উচ্চকিত হলেও যৌনতা ঢেউয়ে তাদের স্বর সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যৌনতা ছাড়া শুধু দুগ্ধপানের মধ্যেই যদি স্তনের ভূমিকাকে আটকে রাখি তবে এক লহমায় নারীর শ্রম এবং প্রকৃতিকে শোষণের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
প্রথমে ব্যাখ্যা করি, নারীর শ্রম শোষণের বিষয়টি।
সন্তান ধারণ, লালন- পালনের মতো জটিল এবং পরিশ্রমের কাজটি নারী বিনা মজুরিতে, বিনা মূল্যায়নেই করে থাকে। মজুরিহীন, মূল্যায়নহীন এ হেন কষ্টসাধ্য কাজ নারী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে করে যাচ্ছে। এইজন্য সে কোন মজুরি কখনো দাবি করেনি। দাবি না করার অন্যতম কারণই হচ্ছে নারীকে কখনই বুঝতে দেয়া হয়নি তার অবদান বা ত্যাগকে। পুরুষের মতোই নারীও যৌনতার ফাঁদে বন্দি। যৌনতার মোড়কে স্তনের প্রকৃত ভূমিকাকে সবসময়ই আড়াল করে রাখা হচ্ছে। নারীবাদীরা যে নারীদের নিয়ে লড়াই- সংগ্রাম করবেন সে নারী তো উপলব্ধিই করতেই পারছে না স্তনের সাথে জড়িয়ে আছে মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। শিশু জন্মের পর প্রথম এবং প্রধান খাবারের আধারই হচ্ছে বুকের দুধ। মানব সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বুকের দুধের বিকল্প চরম উন্নত বিশ্বের ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে না।
স্তনকে যৌনতার সাথে জড়ানোর একমাত্র উদ্দেশ্য শুধু নারীর শ্রমকে শোষণ করা না, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি, জাঙ্ক ফুড ইন্ডাস্ট্রির টিকে থাকবার এবং প্রকৃতির সাথে নারীর আদি ঐক্যের ভাঙ্গনের প্রশ্নও। বক্ষযুগলকে কৃত্রিমভাবে স্ফীত, আর্কষণীয় করে তোলা এখন একটি রমরমা মুনাফার নাম। পশ্চিমা বিশ্বের মতো না হলেও প্রান্তিক পুঁজির দেশেও এই ইন্ডাস্ট্রির আঁচ লাগছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত শোবিজ আর সামর্থ্যবান নারীদের ভিতরে এটি সীমাবদ্ধ থাকলেও নিকট ভবিষ্যতে সমগ্র নারী সমাজকেই এর আওতায় নিয়ে আসবে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো। যেমন করে সে বিউটি পার্লারকে প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে গিয়ে নারীদের দোরগোড়াতে পৌঁছে দিয়েছে “এর সেবা”।
এছাড়া স্তনকে যৌনতার সাথে সংশ্লেষ কীভাবে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির মতোই জাঙ্ক ফুড ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ রক্ষা করে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করেই আমি আলোচনার ইতি টানবো। স্তনের প্রাকৃতিক ভূমিকা হচ্ছে দুধের মাধ্যমে নবজাতকের ভিতরে পুষ্টির সকল উপাদান পৌঁছে দেয়া। সেক্ষেত্রে মায়ের পুষ্টিই যে সদ্য জন্মানো শিশুটিরও পুষ্টি, এই বিষয়টি সাধারণ বুদ্ধির বাইরের বিষয় নয়। মায়ের দুধের পর্যাপ্ততা এবং প্রবাহ ঠিক রাখতে গেলে মাকে প্রচুর পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। এই সুষম খাদ্যের যোগানদাতাই হলো প্রকৃতি।
প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন, বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবারব্যতিত কোন মা’ই শিশুর দুধের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত খাবার বা জাঙ্কফুড খেলে প্রসূতি মায়ের স্তনে দুধ তো তৈরিই হয় না বরং দুগ্ধ আসার স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় বা শুকিয়ে যায়, এ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তো আমাদের হাতে অনেক আগেই ডাক্তারিবিদ্যা এবং প্রসূতি মা দিয়েছেন। ‘স্তন দুগ্ধ পানের জন্য’ এ বিষয়টিকে গুরুত্বহীন , কমজোরি করে প্রচারিত বা উচ্চারিত হচ্ছেই কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত খাবার বা জাঙ্কফুডের ভোক্তা বৃদ্ধি করার জন্য। স্তনের অকৃত্রিম ভূমিকা যতো সামনে আসবে ততোই প্রকৃতির সাথে মানুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হবে এবং তখন মানুষ তার খাদ্যের আধারকে পবিত্র জ্ঞান করবে বা এটিকে টিকে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই সে গ্রহণ করতে চাইবে। যদিও পুঁজিবাদে প্রকৃতির সাথে ঐক্য রক্ষা করা দুরূহ, কারণ এখানে মেহনতি মানুষের সাথে শ্রমের উপকরণের ভিতরে বিচ্ছিন্নতা এমনিতেই ঘটতে থাকে। কিন্তু প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাদ্য গ্রহণ করার জন্য প্রকৃতির সাথে ন্যুনতম যে একটা সর্ম্পক বিদ্যমান আছে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত খাবার প্রকৃতির সাথে মানুষের সামান্য সংযোগটিকেও আজ হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
করোনাকাল তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য যেমন বিউটি পার্লার, কোমল পানীয়, জাঙ্ক ফুড প্রত্যন্ত এলাকাতে সহজলভ্য হলেও বিভাগীয় শহরগুলোতেও অক্সিজেন সিলিন্ডার বা হাসপাতালের কী আকাল। এই বাস্তবতার উত্তরণ নারীই ঘটাতে পারবে। এখন থেকে স্তনকে যৌনাঙ্গ হিসেবে প্রদর্শনের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়ে বোঝাপড়া জারি রাখার সাথে সাথে নতুন সমাজ যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতির আদি ঐক্যের পুন:প্রতিষ্ঠা হয় এমন সমাজ নির্মাণের জন্য লড়াইও তাকে চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক- সুমনা সরকার
গবেষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাবি ।