সাজু বিশ্বাস:
‘হে বধু! তুমি উৎকৃষ্ট কল্যাণসম্পন্ন হয়ে পতিগৃহে অবস্থান করো। আমাদের দাসদাসী ও পশুদের মঙ্গল বিধান করো। তুমি বীরপুত্র প্রসবিনী ও দেবতাদের প্রতি ভক্ত হও”—- ঋগ্বেদ, দশম মণ্ডল, ৮৫ সূক্ত, ৪৩-৪৪ শ্লোক। ১০|৮৫|৪৩-৪৪.
এই শ্লোকের মধ্যে আদর্শ হিন্দু নারীর মোটামুটি একটা পূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া আছে বলা যায়। মেয়ে, তুমি স্বামীর ঘরের মধ্যেই থাকবে, দাস-দাসী গৃহস্থালি দেখাশুনা করবে এবং পুত্র সন্তান জন্ম দেবে। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি হলো,— পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা “অর্থাৎ, পুত্র সন্তানের জন্যই বিয়ে করা হলো…
নারীর মোটামুটি সংসারের আর সব ভোগের জিনিসের মতোই ভোগ্যবস্তুর তালিকায় রাখা হয়েছে গৌতম ধর্মসূত্রে
‘পশু-ভূমি-স্ত্রীনাম্ অনতিভোগ্যঃ— ১২/৩৯.
অর্থাৎ পশু নারী বা স্ত্রী অতিভোগ্য নয়। তারামনে ভোগের বস্তু নিঃসন্দেহে।
অন্যে জায়াং পরি মৃশন্ত্যস্য যস্যাগৃধদ্বেদনে বাজ্যক্ষঃ”
ঋগ্বেদ, দশম মণ্ডল, ৩৪ সূক্ত, ৪ শ্লোক।
এখানে বলছে, যে লোক পাশা খেলায় লোভিত হয়, তার স্ত্রীকে অন্যে স্পর্শ করে। ঠিক এর আগের শ্লোকটিতে আছে, কেবলমাত্র পাশার অনুরোধে আমি আমার পরম অনুগামিনী ভার্যাকে ত্যাগ করলাম…..
আমরা মহাভারতে দেখেছি, পাণ্ডব জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র হয়েও নিজের স্ত্রীকে পাশা খেলায় বাজি ধরেছিলেন। এবং এই কাজ করার জন্য তিনি স্ত্রীর অনুমতি নেননি। অর্থাৎ স্ত্রীকে অন্যান্য সম্পদের মতোই বাজি ধরা চলতো আর্য সমাজের প্রথম থেকেই।
যে সমাজে মেয়েরা নিজেই একটি সম্পদ। এবং বিনিময়যোগ্য সম্পদ, সেই সমাজে মেয়েদেরকে আবার সম্পত্তির ভাগ কে দেবে! শতপথ ব্রাক্ষণে বলে,
— নারীকে কৈশোরে পিতা রক্ষা করবে, যৌবনে স্বামী এবং বৃদ্ধ বয়সে পুত্র”। যাকে রক্ষা করার জন্য সামাজিকভাবে এমন সুসজ্জিত আয়োজন, তার হাতে সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দেওয়া চলে! সে নিজেই তো সারাজীবন পুরুষের মালিকানাধীন!
এখনকার যারা হিন্দু সম্পত্তি আইন সংশোধন নিয়ে বিরোধিতা করছেন, তারাও ঠিক এইরকম সুরে কথা বলেন। নারী হলো ঘরের জিনিস, কূলবধু। তাকেই সমাজের সবাই মিলে ঘরের মধ্যে রেখে রক্ষা করতে হবে, তার আবার আলাদা করে সম্পত্তির ভাগ লাগবে কেন! অনেকে কারণ হিসেবে সরাসরি বলেন,
‘মেয়েরা সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে না। বিক্রি করে দেবে।’ অনেক বড় বড় শিক্ষিত মানুষেরা নির্লজ্জভাবে এই যুক্তিটি ব্যবহার করেন। মেয়ে প্লেন চালাতে পারে, মেয়ে নভোচারী হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, সৈনিক হতে পারে, আর মেয়ে বাপের সম্পত্তির ভাগ পেলে তা রক্ষা করতে পারবে না!
নারীর সৈনিক হবার প্রসঙ্গে আবার একবার ঋগ্বেদে ফিরতে হলো। বৈদিক যুগের একেবারে প্রথমদিকে নারী যোদ্ধাও ছিল। যতদিন আর্যরা যাযাবর ছিল, ততদিন তাদের মধ্যে কৌম বা গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। এবং সেই সমাজে নারীরা যুদ্ধ বা শিকারের পুরুষের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতো। বিশপলা নামে এক নারী যুদ্ধে পায়ে আঘাত পেয়ে আহত হলে তার পায়ে লোহার আবরণ লাগানো হয়। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে এই সংক্রান্ত শ্লোক আছে।
প্রসঙ্গত, লোহা ভারতবর্ষে প্রথম নিয়ে আসে আর্যরা। এই অঞ্চলের স্হানীয় লোকেদের তামা ও টিনের অস্ত্রের তুলনায় ইন্দ্রর লোহার অস্ত্রটি ছিল মারাত্মক আর অব্যর্থ। সেইজন্যই পুরো ঋগ্বেদ জুড়ে ইন্দ্র, তার লোহার অস্ত্র এবং আগুনের কাছে আত্মরক্ষার জন্য প্রার্থনা ও প্রশংসা করা হয়েছে বারবার।
যাই হোক, কৃষিভিত্তিক জীবনে থিতু হবার পর আর্যরা দ্রুত কৌম থেকে কুলভিত্তিক সমাজে বদলে যেতে থাকে। কুল হল বংশ। সহজ কথায়, ছেলে তার বাবা তার পিতামহ এগুলো নিয়ে হলো বংশপরম্পরা। যখনি পুরুষের বংশ পরম্পরা শুরু হলো তখনই নারী কুলবধূ হয়ে উঠলো। মানে তখন থেকেই পশু, খাদ্য এবং অলংকারের মতন মেয়েও ঘরের সম্পদ হয়ে গেল।
সম্পদ বলতে যে খুব যে মূল্যবান সম্পদ, তা কিন্তু না।
পিতা যাকে পুরোপুরি বংশ পরিচয় টরিচয় ছাড়িয়ে একেবারে মন্তর পড়ে দান করে দেয়, সেকি খুব বেশি দামি কোনো সম্পদ হতে পারে কখনো?
এইখানে বিরাট একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। পিতা মন্ত্রপাঠ করে মেয়েকে কুল ত্যাগ করিয়ে দিলে তাতে সুবিধে হলো ঐ মেয়ে আর বাপের সম্পত্তির ভাগ চাইতে পারবে না। সে তো আর ঐ বংশেরই রইলো না! তার আবার বাপের সম্পত্তির ভাগ কীসের! এইজন্য বেদ থেকে শুরু করে তৈত্তিরীয় বা বিভিন্ন ধর্মসূত্রে কন্যাকে সালংকারা হিসেবে সাজিয়ে-গুছিয়ে দান করার কথা বলা আছে। অর্থাৎ গহনাপাতি যা দিতে চাও মেয়েকে ঐ বিয়ের সময়ই দিয়ে দাও, এবং মেয়েকে যাতে ভালোভাবে ভরণপোষণ করে তাই জামাইকে খুশি করার জন্য তাকেও কিছু পণ ও সম্পদ দিয়ে দাও। এই যে মেয়েকে দিয়ে-থুয়ে বিদায় করা হলো, এরপরে আক্ষরিক অর্থেই সে আর বাপের কাছে কোনোদিনও কিছু চাইতে পারে না। সে অন্যের কুলবধূ তো তখন!
কন্যার কোনো শারীরিক ত্রুটি থাকলে বরপণের কথা একাধিক বার আছে ঋগ্বেদে। ৬|২৮|৫.
তাহলে মূল কথা দাঁড়ালো, বাবা যাকে পণ টন শুদ্ধ সম্প্রদান করে দিয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে তার আর বেশি কিছু পাওনা কী! এদিকে মেয়ের জামাইকে পণ দেবার পর মেয়ের জন্ম সম্পর্কে বাবারও একরকম বীতশ্রদ্ধা জন্মে যায়, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তাই বলতে শোনা যায়,
মেয়ে হলো অভিশাপ! ৬|৩|৭|১৩.
এদিকে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের জায়গা কি হলো?
—“যজ্ঞকালে নারী, শূদ্র, কুকুর, কালো পাখি এদের দিকে তাকিও না” — তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬|৫|৮|২.
বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। এখনও হিন্দু বিধবার সম্পত্তি মামলার নিষ্পত্তি হয় ১৯৩৭ সালের এক আইন দিয়ে! কী বলা আছে সেই আইনে?
বিধবা কেবল স্বামীর সম্পত্তি জীবনকাল ভোগদখল করতে পারবে। কিন্তু বিপদে বা চিকিৎসা বা তীর্থ করার জন্যও সেই সম্পদ বিক্রয় করার অধিকার তার নেই। কেবলমাত্র জীবনসত্ত্ব ভোগ করার অধিকার!
আর বাবা তো কন্যাকে দানই করে দিল! সেখানে আবার সম্পদের অধিকার কীসের। এদিকে স্বামীর জন্য বিয়ে করার পুরাতন রীতি রয়েছে। তিনি বিয়ে করতে যাবার আগে তার মাকে বলেন, — মা, অনুমতি দাও, তোমার জন্য দাসী আনতে যাই। ব্যস, মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি এসে সেই সংসারের সবার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলো। এবং কপাল মন্দ হলে যদি বিধবা হয়, তখন সেই সংসারের বাকি সবাই সমস্বরে বলে উঠবে, এখানে তোমার আর ঠাঁই নেই।
যদিও ঋগ্বেদে বিয়ের আশীর্বাদে কন্যাকে বলা হয়েছে,
— স্বামীর সংসারের রাজরানী হইও। শ্বশুর-শাশুড়ি সবার অধিশ্বরী হইও। যে বাপে মন্তর পড়ে হাত ঝেড়ে আপনাকে বংশ পরিচয় থেকে বের করে দিল, সে এমন বড় বড় ভালো ভালো আশীর্বাদ করবে না তো আর কী করবে! যদিও সুকুমারী ভট্টাচার্য বলছেন, রাজরানী বা সম্রাজ্ঞী দুর্লভ বস্তু বলেই আশীর্বাদে এমন কথা বলা হয়েছে।