প্রসঙ্গ: এইজ শেমিং

রোখসানা চৌধুরী:

১.
বয়স হওয়ার অন্তত একটা সুবিধা আমি বলতে পারবো। বয়স মানেই কালের সাক্ষী হওয়া।
জয়া আহসান বয়স নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন কিনা জানি না। আমি আমার স্মৃতি থেকে যেটুকু মনে করতে পারি, তা হলো খুবই অল্প বয়সে সে অভিনয় আর মডেলিংয়ে এসেছিল। তাকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম তার নির্বোধ টাইপ অভিব্যক্তি আর ‘ক্ষ্যাত’ ফ্যাশন সেন্সের জন্য। জয়া নিজেই বলেছে, ‘প্রসন্ন পাষাণ’ নাটকে অভিনয় করার সময় সে জানতই না নাটকের কঠিন শিরোনামের অর্থ কী? ফয়সালের সঙ্গে তার যখন বিয়ে হয় সেই বিয়েটাও ছিল যথেষ্ট এইজ গ্যাপ থাকা বিয়ে। মিডিয়ায় এগুলো নিয়েও কথা হয়েছিল।

ঐ সময়ের জেনারেশন হিসেবে বলতে পারি, আমরা তখন টিভি আর মডেলিং তারকাদের দারুণভাবে ফলো করতাম, তাই বিপাশা-শমী-মৌসুমী আমাদের সমবয়সী নাকি দু চার বছরের ছোট বড়, এসব হিসাব আমাদের মধ্যে করা হতো। কথা আসলে এইটাও না, কথা হচ্ছে জয়া যদি বয়স লুকিয়ে থাকেনও (আমার হিসেবে তার বয়স ৩৮ ঠিকই আছে) তাতেই বা সমস্যা কোথায়?
তার অভিনয় নিয়ে কথা বলা যেতেই পারে। জয়াকে আমার শুককীট থেকে প্রজাপতি হওয়ার মতো পরিবর্তিত মনে হয়েছিল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সিক্সটি নাইন’ সিরিয়াল দেখার পর। অভিনয় আর সৌন্দর্য দু’দিকেই। পুরোপুরি সিনেমায় চলে যাওয়ার আগে সে বেশ কিছু দারুণ অভিনয়সমৃদ্ধ নাটক উপহার দিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি, তাকে নির্দিষ্ট একটা ঘরানার চরিত্রেই মানায়। সেই ঘরানার একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘দেবী’। কিন্তু এটাও অবাক করার মতো বিষয় যে, আমাদের প্রত্যাশা সাধারণত আকাশচুম্বী হয়ে থাকে। তাই সকল অভিনেতা অভিনেত্রীকেই আমরা ভার্সেটাইল না হতে পারলে নির্দয়ভাবে সমালোচনা করি। ব্যক্তি হিসেবে সমাজসেবামূলক নানা কাজ দেখালেও কেন তিনি বয়স লুকালেন এই মর্মে তাকে ছোটলোক বলে অভিহিত করে ফেলি!

২.
এইজ শেমিং প্রসঙ্গে আসি।জয়া আহসান পেশায় একজন মডেল, অভিনেত্রী। আর কে না জানে অভিনেতারাও বাচ্চাসহ বিয়ে লুকিয়ে ফেলে (ওপারে আমির খান,এপারে শাকিব খান) বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার ভয়ে। অভিনেত্রীদের কথা তো বলাই বাহুল্য।
এই সমাজেই সাধারণ একটি কন্যা সন্তান বেড়ে ওঠে বিয়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে। আর বিয়ে মানেই তো তাকে মাতৃত্ব ধারণ করতে হবে। বয়স বেশি হলে নাকি নারীর ম্যাটার্নিটি জটিলতা দেখা দেয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও এই তথ্যকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বিধায় দ্বিতীয় বিকল্প ভাববার অবকাশ থাকে না।

তাহলে পুরুষ কেন বয়স লুকায়? বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষের সার্টিফিকেট চেক করে দেখুন ১লা জানুয়ারি জন্ম কিনা। নানাবিধ কারণের মধ্যে প্রধানতমটি কি এই যে, সরকারি চাকুরি তো বটেই, নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে গেলে কোথাও নোকরি মেলা ভার হয়ে যায়। আর নোকরি না পেলে তো ছোকরিও মিলবে না। দেখা যাচ্ছে,আমরা আসলে একই পাকেচক্রে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছি। বিয়ের বাজার, চাকরির বাজার, দর্শক শ্রোতা তথা অডিয়েন্স বাজার।
এই বাজারের অংশ কারা? আপনি আমিই তো। আমাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করার দায় কাকে দেবেন,
রাষ্ট্র, আদালত, সমাজ নাকি পরিবার? আমার অন্তত জানা নাই।

৩.
সকল নারীই কি এইজ শেমিংয়ের শিকার হন?
নারী ও পুরুষের জন্য এইজ শেমিং কি একই রকম ইফেক্টিভ?

একজন নারী যতই শিক্ষা, সমাজসেবা, শিল্প-সংস্কৃতির ধারক বাহক পৃষ্ঠপোষক হোন না কেন, তার মূল দায়িত্ব সন্তান ধারণ এবং লালনপালনের কাজটি সঠিকভাবে আজীবন (নিজের জীবন উৎসর্গ করে) করে যাওয়া।
আমাদের আদর্শ সেই মা কখনো নিজের জন্য সাজেন না, নিজের জন্য টাকা জমান না, টাকা খরচও করেন না,
নিজের ভালো লাগার জন্য একা কোথাও বেড়াতে যান না, একার জন্য পছন্দের খাবার কোনটি এটিও তারা ভুলে যান হয়তো। সেই আদর্শ মা ছেলে-মেয়ের বিয়ে পরবর্তী সেবা দিতেও প্রস্তুত থাকেন।
এইজ শেমিং এই ত্যাগ তিতিক্ষাধারী নারীর জন্য নয়।

কিন্তু যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে, যে নারী বয়সকে মাথায় না রেখে ভালো থাকার চেষ্টা করে, ভালো থাকে, আনন্দে থাকে সেই নারীটি বয়সোচিত আচরণ না করার জন্য অভিযুক্ত হন, ট্রোলড হন, শেমিংয়ের শিকার হন তার নিজের সমাজ ও পরিবারে।
পুরুষও শেমিং ট্রোলিংয়ের শিকার হন বটে। আমাদের দু’জন রেলমন্ত্রীর অধিক বয়সে অল্পবয়সী পাত্রীকে বিয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেষ্ট হাস্যরসের সঞ্চার ঘটেছে। হ্যাঁ,একদম তাই। হাস্যরসই শুধু। সেইসব কৌতুকের আড়ালে বিষ থাকে না। কিঞ্চিৎ সহমর্মিতা থাকলেও থাকতে পারে। আমাদের প্রাক্তন একজন প্রেসিডেন্টের অশীতিপর বয়সেও নারীঘটিত কেলেঙ্কারির কাহিনী নিয়েও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যেত।তার সরকার পতনের পর প্রশাসনিক দুর্নীতির খবরের চাইতে চায়ের আসর সরগরম হতো এ্যাডাল্ট জোকস আর রিউমারে।

মূল তফাতটা হলো, নারীকে লজ্জা দেয়া হয় যাতে সে আর কখনো ভুলেও বয়সোচিত আচরণ করতে ভুল না করে। সমাজের অন্য মেয়েরা যেন শিক্ষা নেয় এসব শেমিং থেকে। পুরুষের বেলায় শেমিং একইরকম হলে রোকেয়ার লেখা প্রায় শতবর্ষ আগেকার এই ছড়াটাও কার্যকর হতে পারতো …

হুকুর হুকুর কাশে বুড়া,হুকুর হুকুর কাশে,
নিকার নামে হাসে বুড়া,ফুকুর ফুকুর হাসে।

৪.
শুরুতেই বলেছি, বয়স হওয়ার অনেক সুবিধাও আছে।বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন সৌন্দর্যও আছে। দরকারি কাজ হলো সেই সৌন্দর্যকে উপভোগ করা। আমরা বয়স বিষয়ক নানা ট্যাবুতে আক্রান্ত হয়ে ভুলে যাই, বয়সের সাথে যেসব প্রাপ্তি আসে, বয়স অস্বীকার করলে সেসব প্রাপ্তিকেও বাদ দিতে হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক আগেই এসব ভার্সেটালিটির মোহ পরিত্যাগ করতে পেরেছে। ম্যাডোনা,সোফিয়া লরেন,জুলিয়া রবার্টস, টম হ্যাংকস ছাড়াও অসংখ্য সত্তরোর্ধ তারকারা হলিউডে তাদের সেরা কাজগুলো দিয়ে চলেছেন এইজ শেমিং নামক ট্যাবু সেখানে কার্যকর নেই বলে।

বৃদ্ধাশ্রম নামটিও আমাদের কাছে ট্যাবু। কারণ বৃদ্ধ মানেই আমাদের কাছে অচল,অথর্ব, পরাশ্রিত কোন অস্তিত্বের নাম।অথচ নিজে ভালো না থাকলে, নিজের যত্ন না নিলে বেশি বয়সে সেই সন্তানেরই গলগ্রহ হতে হবে, যে সন্তানটিকে আপনি সকল বিপদ থেকে বাঁচিয়ে ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছেন, হয়তো বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেই ব্যস্ত সন্তানের সত্যিকার অর্থেই এখন হয়তো সময় নাই।
বয়সকে আতংক ভাবার সামাজিক ট্যাবু থেকে বের হয়ে এলেই এইজ শেমিং বিষয়টিও দূরীভূত হবে বলে আশা করা যায়।

শেয়ার করুন: