পরিবেশ দূষণের সাথে স্যানিটারি প্যাডের কী সম্পর্ক!

নাহিদ দিপা:

স্যানিটারি প্যাডের একটি বিরূপ ছায়া আছে পরিবেশ ও মানব শরীরের উপর। গতকাল ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস, তাই কিছু তথ্য জানানোর জন্যই এই লেখা। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয়েছে, স্যানিটারি প্যাডের কারণে প্রতি বছর ৯ হাজার টন (প্রায় ৮২ লাখ কেজি) প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে। আর এসব প্লাস্টিক মাটিতে বিলীন হতে সময় নেয় পাঁচশ বছর।

স্যানিটারি প্যাডগুলোকে লিকপ্রুফ আর আরামদায়ক করতে যা যা করা হয় তার সবই ক্ষতিকর। কীভাবে তা একে একে ব্যাখ্যা করছি..

প্যাডগুলিকে লিকপ্রুফ করার জন্য ও অধিক আর্দ্রতা শোষণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এ কারণেই প্রাকৃতিক তুলার বদলে এগুলিতে সিনথেটিক ফাইবার বা রেয়ন ব্যবহার করা হয়, যাতে রয়েছে ডাইঅক্সিন। যে প্যাড যত বেশি সাদা তাতে তত বেশি ডাইঅক্সিন। কেন? রেয়ন বা প্রাকৃতিক তুলা যা-ই হোক তাকে সাদা করার জন্য ব্লিচ করা হয়। আর ব্লিচ করলেই ডাইঅক্সিন তৈরি হয়। খেয়াল করবেন, স্যানিটারি প্যাডের কারণে শরিরের যেখানে আপনার র‍্যাশ হয়, সে জায়গাটা কালো হয়ে যায়। সেটা হয় এই ডাইঅক্সিনের কারণে। যদিও স্যানিটারি প্যাডগুলির মাধ্যমে ডাইঅক্সিনের সংস্পর্শকে পণ্য নির্মাতারা তুচ্ছ বলে মনে করেন। তারপরও ডাইঅক্সিনযুক্ত প্যাড বছরের পর বছর ব্যবহার করলে তা আপনার ভ্যাজাইনা, সার্ভিক্স এরিয়ায় জমে থাকতে পারে, আর হতে পারে সার্ভিকাল ক্যান্সার এবং ওভারিয়ান ক্যান্সার। বিশ্বে প্রতিবছর যত নারী সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে মারা যায় তার ৯০% মারা যায় বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আর যত প্রকার ক্যান্সার আছে আর যত মানুষ তাতে মারা যায়, এই দুই মাপকাঠিতেই সার্ভিকাল ক্যান্সার চার নাম্বারে।

বেশিরভাগ স্যানিটারি প্যাড যে প্লাস্টিকে তৈরি হয় তা বিপিএ যুক্ত এবং রয়েছে সিনথেটিক লাইনিং যা পিরিয়ড ব্লাডের আর্দ্রতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যকটেরিয়া এবং ইস্ট তৈরির প্রজননক্ষেত্র তৈরি করে। আর্দ্র পরিবেশ যেকোন জীবাণুকে দ্রুত বংশবিস্তারে সাহায্য করে এবং যোনিতে সংক্রমণ ঘটায়। একটা ভালো মানের প্যাডকে লিকপ্রুফ করার জন্য চারটি প্রমান সাইজের পলিব্যাগের সমান প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। যা আপনি একবার ব্যবহার করার পর ফেলে দেন প্রতিদিনের ময়লার ঝুড়িতে। কিন্তু এটিকে মেডিকেল বর্জ্য হিসাবে তুলনা করা উচিৎ এবং এর ব্যবস্থাপনাও তেমন হবার কথা। এগুলো না মিশছে মাটিতে, না মিশতে পানিতে। বরং যে যে ক্যামিকেল গুলো আপনাকে আরাম দেয়ার নামে ক্ষতি করছে সেই ক্যামিকেল গুলো একই ভাবে ক্ষতি করছে পৃথিবীর মাটি, পানি আর অন্যান্য জীবজন্তুকে।

প্যাডে জমা হওয়া রক্তের গন্ধ কারোরই পছন্দ নয়। প্যাড নির্মাতা কোম্পানিও তা জানে। সেজন্য তারা এই গন্ধকে নির্মূল করতে একধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে, সাথে ব্যবহার করে বাড়তি মিষ্টি গন্ধ যা প্যাকেট খুললেই আপনাকে মুগ্ধ করে। আসলে এটা যতই সুন্দর গন্ধের ততই খারাপ আপনার প্রজনন অংগের জন্য। এই রাসায়নিক উপাদানগুলি মারাত্মক জ্বালা এবং অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। এই রাসায়নিকগুলি বন্ধ্যাত্বের জন্য এবং প্রজনন প্রকৃয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

স্যানিটারি প্যাডে ব্যবহৃত সুপার শোষণকারী পলিমারগুলি বেশিরভাগ পেট্রোলিয়াম জাত পণ্য যা তাদের ওজনের ত্রিশ গুণ রক্ত শোষণের দাবি করে। অতি-পাতলা স্যানিটারি ন্যাপকিনের এই গুণটি আপনার খুবই কাংখিত। কারণ পিরিয়ডের ভেজা ভাব আপনি অনুভব করতে চান না, আবার খুব জলদি সেটা পাল্টাতেও চান না। এই গুণটিই ওই প্যাডের বিশেষত্ব, আর আপনার জন্য ডেকে আনতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। এটি আপনার ভি এরিয়াতে ফুসকুড়ি, অ্যালার্জি, প্রজনন সমস্যা এবং টক্সিক শক সিনড্রোমের কারণ হতে পারে। অনেকেরই ভি এরিয়াতে প্রচণ্ড চুলকানি, জ্বলুনি সাথে গা গরম হয়। এগুলোই টক্সিক শক সিনড্রোম।

উপরে উল্লেখিত সবগুলো বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে মেন্সট্রুয়াল কাপ (এপ্রুভড, অথেনটিক, মেডিকেল গ্রেডেড সিলিকনের ব্র‍্যান্ডেড কাপ) বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বা বায়ো ডিগ্রেডেবল স্যানিটারি প্যাড। দিনে দিনে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছি আমরা, সবকিছুতেই স্মার্টনেস খুঁজি। কেবল এই মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে আমরা পুরাতন প্রযুক্তি থেকে বের হতে পারি না কেবল ভয় আর ট্যাবুর জন্য। নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রকৃতির কথা চিন্তা করে, আধুনিক মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার চ্যালেঞ্জ নেয়া যেতেই পারে।

প্রতিদিনই কত কত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই আমরা। ভয়কে পাশ কাটিয়ে এই ছোট্ট, কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা-চওড়া একটা মেডিকেল গ্রেডেড সিলিকন কাপের ব্যবহার পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে কোটি কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে, আপনাকে বাঁচাতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক সমস্যা থেকে।

 

লেখার সূত্র: উইকিপিডিয়া, WHO, PACII, www.textileengineers.org

নাহিদ দিপা,
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.