রাতে নারীর চলাচল, সময় কি পাল্টালো কিছু?

নাছিমা মুন্নী:

বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা। রাত আটটা। সুনসান নীরবতা। বাসের জন্য অপেক্ষারত আমি। কোনো বাস আসা যাওয়া নেই বললেই চলে। দেখলাম সোনাইমুড়ির দিকে একটা বাস যাবে। অল্প কিছু যাত্রী বাসে বসে আছে। যাত্রীদের জন্যে অপেক্ষারত বাস। যাত্রীদের আনাগোনাও কম। তখন এসব রুটে রাত আটটা সাড়ে আটটায় দুই একটা বাস চলাচল করতো।

লক্ষ্মীপুর যাওয়ার মতো তেমন কোনো বাস দেখতে পেলাম না। কিভাবে লক্ষ্মীপুর পৌঁছাবো? এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার পাশে যাত্রীদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাগুলোর দিকে। প্রতিটি রিকশায় একজন করে ছেলে বসে আছে। তাদের প্রত্যেকের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে । তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিই ছিল আমার দিকে।

ভুল করে আমি নেমে গিয়েছিলাম চৌরাস্তায়। আমার সাথের সংবাদকর্মীরা কেউ লক্ষ্মীপুর যাবে, কেউ রামগতি। আমিও লক্ষ্মীপুরে যাবো। এই পথে তখন যাত্রা পথে চলাচলে এতো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি আমি। ভেবেছিলাম সবাই এখানে নেমে অন্য বাস ধরবে। সামনের সিটে বসা ছিলাম আমি। যাত্রীদের ভিড় ছিল অনেক। নেমে দেখি আমার সাথের কেউ এখানে নামেনি।

একা নেমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। যে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলাম, সে গাড়ি চৌমুহনী বাসস্ট্যান্ড হয়ে আবার এ পথ দিয়েই যাবে। কিন্তু সে গাড়িও আসার নাম নেই। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিক তাকাচ্ছি, আর হাতে থাকা পাক্ষিক লোকসংবাদ নেড়েচেড়ে দেখছি। আমার একটা লেখাও ছাপানো হয়েছে এতে। লেখালেখি তখন খুব আগ্রহের একটা জায়গা। যাই লিখছি ছাপা হয়ে যাচ্ছে। পাক্ষিক লোকসংবাদ খুব আপন একটা অনুভূতি তৈরি করেছে। ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) এর সেদিন তৃণমূল সংবাদকর্মীদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ করেছিল। ওয়ার্কশপ শেষে আমরা সবাই লেখার সম্মানি নিতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছিলাম।

সময় যতো যাচ্ছে ভয় ততো বাড়ছে। বাসের পথ চেয়ে আছি আর ক্ষণে ক্ষণে রিকশাগুলোর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে আমার। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেগুলোর চোখগুলো খুব ভয়ঙ্কর লাগছিল আমার।

ভাবছি কী করবো। আবার ভাবছি সংবাদকর্মীদের এতো ভয়ে পেলে কি চলে? আবার মনে হচ্ছিল, আমি একা একটা মেয়ে কিইবা করতে পারবো! যদি আর বাস না আসে! আমি কীভাবে পৌঁছাবো আমার গন্তব্যে। উহ্! আর ভাবতেই পারছি না। ভাবছি বিকল্প কিছুও।

হঠাৎ কোথা থেকে হাজির হলো বড় চাচার কলিগ রহমান চাচা। আমার বড় চাচা তখন লক্ষ্মীপুর কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। রহমান চাচা আমাকে দেখে আমার কুশলাদি নিচ্ছেন। আমার সাথে কথা বলছেন তিনি। এরই মাঝে রিকশায় বসে থাকা ছেলেগুলো ওনাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডেকে নিল। রহমান চাচাকে তারা জিজ্ঞেস করছিলো, আমি ওনার কী হই? কোথা থেকে এসেছি? উনাকে তারা হুমকি দিয়ে বলেছিল, তিনি যেন এই মুহূর্তে এ জায়গা ছেড়ে চলে যান। নইলে উনি আর এখান থেকে ফিরতে পারবে না। মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে উনাকে।

রহমান চাচা আমার কাছে এসে আমতা আমতা করে বললেন, মা, তোমাকে দ্রুত এ জায়গা ছাড়তে হবে। লক্ষ্মীপুরের যে বাসই আসুক, যতো ভীড় থাকুক, তোমাকে সে বাসে তুলে দেব। তোমাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে। নইলে তোমার কঠিন বিপদ হবে। আমি রহমান চাচার চোখেমুখে ভয় দেখছিলাম। সেই মুহূর্তে আমি কী বলবো ওনাকে বুঝতে পারছিলাম না। শুধু এ জায়গা প্রস্থান করতে হবে এতটুকু আমি বুঝেছিলাম।

আমার আর রহমান চাচার কথোপকথনের ঠিক সেই মুহূর্তে লক্ষ্মীপুরের দিকে যাবে এমন একটা বাস এসে আমার পাশেই থামলো। বাসে অনেক ভীড় ছিল। তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না। অনেক যাত্রী বাসে দাঁড়িয়েছিল। রহমান চাচা বাসের কন্ডাক্টরকে বললেন, একটা মহিলা সিট ম্যানেজ করে দেন ভাই। সাথে সাথে আমি বাসে উঠলাম। আর বাসের কন্ডাক্টর আমাকে বাসের দ্বিতীয় সিটে একটি সিট দেখিয়ে বসতে বললেন।

রহমান চাচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জানালার পাশে এসে হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানালেন। আমি জানালার বাইরে তখন তাকিয়েছিলাম। আমি তখন রহমান চাচার কথা ভাবছিলাম। অনেকটাই বিপদমুক্ত তখন। কিন্তু উনাকে বিপদে ফেলে আমি চলে যাচ্ছি।

বাস ছেড়ে দিল। আমি তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছি রহমান চাচাকে ঘিরে ধরেছে আট-দশজন ছেলে। তারা সবাই ওনাকে মারছে। পরে শুনেছি, পথচারীরা রহমান চাচাকে ছেলেগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করেছে।

আজ থেকে দুই দশক আগে রাত আটটায় বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় নিরাপত্তাহীনতায় ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম এই আমি। প্রতিদিনই কত মেয়ে রাতে রাস্তায় এমন কুঁকড়ে যায়। কত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। দুই দশক পরও ভাবছি, একজন মেয়ের রাতে একা নির্ভয়ে চলার, নিরাপত্তার কোনো কি পরিবর্তন হয়েছে?

বাংলাদেশে নারী যাত্রীরা রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে পরিবহন সংশ্লিষ্ট লোকজন বাসস্ট্যান্ড এলাকার বখাটে যুবক কিংবা পুরুষ যাত্রীদের দ্বারা শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন প্রতিনিয়ত। একদিকে নিরাপত্তাহীনতা অন্যদিকে সামাজিক অসচেতনতার কারণে দিন দিন নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা বাড়ছে।
নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃংখলা বাহিনীর দৃশ্যমাণ তৎপরতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে।

রাতে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের টহল গাড়ি আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে দূরপাল্লার বাসগুলোতে রাতের বেলায় যেসব নারী যাত্রী ভ্রমণ করেন তাদের জন্য কি কোনো নিরাপত্তা আছে? এসব পরিবহনে নিরাপত্তা বলতে সড়কে পুলিশের টহল আর বাসে কোম্পানি নিযুক্ত সুপারভাইজার। ফলে দিনের বেলা নারীদের স্বাভাবিক চলাচল দেখা গেলেও রাতে তা অনেকটাই কমে আসে। রাতে নারীদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আমাদের পুরুষদেরও মানসিকতা পরিবর্তন খুব জরুরি। কিন্তু গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তাবোধের এই অভাব দূর করার কি কোনো উপায় আছে ? আসলে পুরো দেশটাকেই নারীবান্ধব করতে হবে।

বাসের যারা হেলপার, ড্রাইভার আছেন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেন বিপদে পড়লে নারীরা তাদেরকে রিপোর্ট করতে পারে এবং তারাও নারীদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজ বা রাষ্ট্রের আচরণে মনে হয় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ অপাংক্তেয়। সমাজ জীবনের এমন একটি জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে নারী নিরাপদ, যেখানে নারীকে যৌন হয়রানীর শিকার হতে হয় না। একজন নারীকে জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় তার নিরাপত্তার কথা। তাকে প্রতিনিয়ত আতংকে দিন কাটাতে হয় ।

করোনা নামক মহামারি বাতাসের সাথে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার জীবনী শক্তি। মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুণছে ঠিক এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিও থামিয়ে দিতে পারেনি যৌন সহিংসতা নামক দানবদের। এমন বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি নারী। দেশের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীও সমানভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবুও হাজারখানেক বাধা অতিক্রম করতে হয় শুধু নারীকেই।

আগে বাংলাদেশে নারীদের এতোটা নিরাপত্তাহীনতা ছিল না। কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলছে নারীর চলাচলের প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশে নারীরা এখনও নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এখনও নারীরা সন্ধ্যার পর বা রাতে একা কোথাও যাওয়া আসা করতে ভয় পায়। একা দূরের ভ্রমনে নারীর রয়েছে এখনও হাজার প্রতিকূলতা। পরিবার থেকেও অনেক বাধা আসে নারীর একা চলাফেরায়। একা চলাফেরায় অভ্যস্ত নারীরাও রাতে খুব কমই রাস্তায় বের হন। বাংলাদেশে যেখানে সবক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার সেখানে গণপরিবহনে একা নারীর নিরাপত্তাহীনতা নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রশ্নবোধক!!

নাছিমা মুন্নী
উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.