মুনিয়ার মৃত্যু কি প্রমাণ করে না যে নারী আজও উচ্ছিষ্ট?

জিনাত নেছা:

“হ, এখন তো তোর অনেক আছে, আমার সাথে কথা বলবি ক্যান” – প্রবাসী এক স্বামী তার বউকে বলছিলেন। এর পেছনের হেতু হলো তার স্বামী তার ফেইসবুক আইডি হ্যাক করেছে, তার বউয়ের মোবাইলের কল লিস্ট উঠিয়ে দেখেছে সে কার কার সাথে কতক্ষণ কথা বলে। তার স্বামী কিন্তু তাতে কিছুই পায়নি। বউ ভাবছে এটা তার জন্য সম্মান হানিকর, তাই সে তার স্বামীর সাথে আর কোন যোগাযোগ করছে না। তখন স্বামী তার স্ত্রীকে নানান বাজে শব্দ, ভাষা ব্যবহার করে এসএমএস করছে।

এটি শুধু একজন নারীর গল্প নয়। আমাদের সমাজে হাজারও নারীর গল্প। বউ যদি অফিস থেকে দেরিতে ফিরে, একবার ফোন ধরতে দেরি করে, কিংবা কল ওয়েটিং থাকে, তাহলেই এক নিমিষেই বউ হয়ে যায় বেশ্যা। কিন্তু পুরুষটি যদি এগুলো করে থাকে তাহলে যেন কিছুই হয়নি।

আমাদের সমাজে একজন নারী যখন আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায় তখন তার চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়। “নারীর চরিত্র” যেকোন ধরনের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য খুবই সহায়ক একটা উপাদান। সেটি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয়। আপনি রাজনৈতিকভাবে কাউকে হেয় করতে চান তার সাথে একজন নারীকে জুড়ে দেবেন, ব্যস হয়ে গেলো ষোলকলা পূর্ণ। আপনি পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে কাউকে হেয় করতে চান, তাহলেও জুড়ে দেবেন একজন নারীকে। আর আপনার অপর পাশে থাকা ব্যক্তি যদি নিজেই একজন নারী হয়, তাহলে তো কোন কথাই নাই। তার চরিত্র নিয়ে কথা তুলুন, আপনার উদ্দেশ্য সফল।

একজন বউ যখন ডিভোর্স চায়, তখন ধরেই নেয়া হয় ঐ নারীর অন্য কারো সাথে প্রেম আছে যে কারণে সে ডিভোর্স চাইছে। কিন্তু ডিভোর্স চাওয়া একজন নারীর আইনগত অধিকার। কিংবা একজন প্রেমিকা যদি তার প্রেমিকের সাথে একক সম্পর্কে আর থাকতে চায় না, তখন বলা হয়, হ্যা, এহন তো আর আমাকে ভালো লাগবোই না। নতুন নাগর জুটে গেছে না! কিন্তু অপরদিকে একজন স্বামী ডিভোর্স চাইলে তখন বলা হয় অবশ্যই তার বউয়ের চরিত্রে কোন সমস্যা আছে। কিংবা প্রেমিক সম্পর্ক থেকে ওয়াক আউট করতে চাইলে প্রেমিকার চরিত্র ভালো না বলেই প্রচার প্রচারণা চালায়। কিন্তু কেন?? একজন নারীর কি স্বাধীনভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার নাই? একজন নারীর কি বাঁচতে হলে একজন পুরুষ লাগবেই ? নারী কি একা বাঁচতে পারে না? কেন নারীর চরিত্র নিয়ে এতো কাটাছেঁড়া??

আসলে নারী হলো পুরুষতান্ত্রিক পুরুষদের ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এজেন্ট পুরুষ তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য নিজেদের হেডম দেখানোর জন্য নারীকে, নারীর চরিত্রকে, শরীরকে ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরেই। যার অন্যতম উপাদান হলো নারীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা, চরিত্র নিয়ে টানাটানি করা, ধর্ষণ করা। এসবের মাধ্যমে তারা এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে।

যার অন্যতম উদাহরণ আমরা সবসময় দেখতে পাই কোন নারীকে ধর্ষণ করা হলে আগেই সেই নারীটি কেমন ছিলো, তার চরিত্র কেমন ছিলো, সে প্রেম করতো কি করতো না, তার বয়ফ্রেন্ড ছিলো কি ছিলো না এসব নিয়ে উঠেপড়ে লাগি। যেনো ঐ নারীর চরিত্রে কালো দাগ লাগাতে পারলেই নারীটিকে ধর্ষণ করা বৈধ হয়ে যায়। কী হাস্যকর?? বাংলাদেশের আইনেও ধর্ষণের শিকার নারীকেই  প্রমাণ করতে হবে তার চরিত্র সাচ্চা, তার ভ্যাজাইনা সুরক্ষিত ছিল এতোদিন, সুতরাং তারে ধর্ষণ করা অন্যায়, অপরাধ। তখনই কেবল বিচার হতে পারে! কী অদ্ভুৎ! এর মাঝে কিন্তু সেই নারী টু ফিংগার টেস্ট, মামলার শুনানি, পরিবার, প্রতিবেশি, কোর্ট সব মিলিয়ে আরও মিনিমাম হাজার বার ধর্ষণের শিকার হয়ে গেছে। এসব যখন ভাবতে বসে বড্ড অসহায় লাগে। নারী হয়ে কেন জন্ম নিয়েছি, তাই নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে বারংবার।

বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া মুনিয়া হত্যা কিম্বা আত্মহত্যা বা হত্যা একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। মুনিয়া মরেও অশ্রাব্য গালিগালাজ থেকে মুক্তি পায়নি। মিডিয়া, ফেইসবুক, ইউটিউব সবকিছুতে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া, গালিগালাজ প্রমাণ করে দেয় আমরা জাতি হিসেবে কতটুকু পুরুষতান্ত্রিক! যা কিনা একজন মৃত মানুষকেও তাদের ক্ষমতার দাপট থেকে রেহাই দিচ্ছে না। মুনিয়া যদি লিভ টুগেদার করে অন্যায় করে থাকে তাহলে মুনিয়ার সাথে রাতে যিনি থাকতেন তিনি সমান অপরাধী। কিন্তু তাকে নিয়ে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের টুঁ শব্দটিও নেই। কারণ হলো তিনি এই পুরুষতান্ত্রিকতার এজেন্ট খোদ পুরুষ, তিনি পুঁজিবাদী সমাজের ধারক ও বাহক। এই সমাজের শ্রেণি কাঠামোতে তার অবস্থান ওপরে। সে ভূমিদস্যুই হোক, দুর্নীতিবাজই হোক, মিডিয়া তার কেনা গোলাম। সুতরাং তাকে স্পর্শ করে বোন বাপের বেটা!

মুনিয়ার ঘটনা বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে দিল যে সমাজ কতোটা অসহিষ্ণু নারীর প্রতি। কতোটা অসম্মান তারা করতে পারে একজন নারীকে। অথচ এই নারীই একজন পুরুষের মা, এই নারীই তার বোন, এই নারীই তার স্ত্রী, কন্যা। অথচ নারীর প্রতিই কত বিদ্বেষ! ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে সব জায়গাতেই দৃশ্য একই।  নারীর যৌনতা, কর্মদক্ষতা কিংবা যোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর বিপরীতে পুরুষের প্রতি তিরস্কারের শব্দভাণ্ডার তেমন ব্যবহার হয় না। এতে পরিস্কার বোঝা যায় যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজই এই এমন ঘৃণিত শব্দের জন্মদাতা, যোগানদাতা। তারা তাদের ইচ্ছেমতো, সুবিধামতো এই শব্দগুলো তৈরি করেছে যেন তাদের দাপট দেখাতে পারে। এমনকি কিছু নারী আছেন যারা মননে, মানসিকতায় পুরুষতান্ত্রিকতা বহন করে, তারা নিজেও অন্য নারীকে হেয় করার জন্য এসব ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যে নিত্যদিন সকালবেলা বাসি পানি, খাবার ফেলে দেবার মতো উচ্ছিষ্ট কিছু তা মুনিয়ার মৃত্যু নতুন করে সামনে এনে দিলো।

শেয়ার করুন: