রুপন্তীর ঘরে ফেরা

সুমন্দভাষিণী:

ঈদের ছুটি হয়ে গেছে অফিসে। আগে থেকেই কাপড়চোপড় সব ধুয়ে ইস্ত্রি করে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছিল রুপন্তী। দিন পনের আগেই টিকেটও কাটা হয়ে গেছে। মাহতাবই একদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে কলাবাগানের শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জানালার ধারের সিট দেখে একটা টিকেট কেটে এনেছিল রুপন্তীর জন্য। মাহতাব রুপন্তীর বন্ধু। বয়ফ্রেন্ডও বলা চলে। অনেকদিন ধরেই পরিচয় তাদের। বিয়েটা করবো-করছি করেও শেষপর্যন্ত দুই পরিবারের টানাপোড়েনে হয়ে উঠছে না।

টিকেটটা হাতব্যাগের সামনের পকেটে রাখে রুপন্তী। আর ছোট্ট ট্রলিব্যাগটাতে কিছু কাপড় গুছিয়ে রাখে। একটা জলের বোতলও ঢুকায় সে হাতব্যাগের ভিতরের পকেটটাতে। রুপন্তী সাধারণত জার্নির সময় খুব সাধারণ কোন পোশাক পরে, যাতে দীর্ঘযাত্রায় আরাম বোধ হয়। প্রায়ই সে দেশ-বিদেশে যাত্রার সময় দেখে যে মানুষ অনেক সাজসজ্জা করে কোথাও যেতে হলে, দামি শাড়িটা পরে, অনেকে খুবই কটকটে রংয়ের সালোয়ার-কামিজ পরে, উঁচু জুতা পরে। রুপন্তী কখনও এসব করতে পারে না। সে দেশের ভিতরেই যাক, বা বিদেশে, সবসময় আরামদায়ক কোন একটা পোশাক পরে নেয়। এমনকি প্লেনে দীর্ঘ জার্নি থাকলে কখনও জিন্সও সে পরে না। মূলত আঁটোসাঁটো কোন পোশাক সে পছন্দ করে না। একদিন একজন বেশ পরিচিত নারী কথাচ্ছলে বলছিল যে, জার্নিটা হতে হয় উচ্ছল, বর্ণিল। রুপন্তী তার ধারেকাছেও নেই।

চুলটা কোনরকম আঁচড়ে নিয়ে ট্রলিব্যাগসহ নিচে নেমে এলো ছয়তলা থেকে। একটা রিকশা নিতে হবে। হাতে সময় আছে। রাত ১০টায় বাস ছাড়বে। এখন বাজে আটটা। পথে জ্যাম হতে পারে ভেবে একটু আগেভাগে যাচ্ছে সে। সাতটাতেই খেয়ে নিয়েছে, ঈদের জার্নিতে কখন, কয়টায় বাড়ি পৌঁছাবে, তার তো ঠিক নেই! তাই একটা টিফিন বক্সে সে কিছু বিস্কুট আর আপেল নিয়ে নেয়। ঘরে পেয়ারা ছিল না, সাধারণত সে পেয়ারাই নেয় একটু লবণ মাখিয়ে, এতে করে জার্নির ক্লান্তিতে যে বমি বমি ভাবটা হয়, এটা আর থাকে না।
আশ্চর্য যে খুব কম সময়েই সে মোহাম্মদপুর থেকে রিকশায় করে পৌঁছে গেল কলাবাগানে। শ্যামলী কাউন্টারের ভিতরে ঢুকে একটা সুবিধামতোন জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লো। যাত্রীরা আসছে, যাচ্ছে। সবাই বাড়ি যাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়িতে ছুটছে। এই দৃশ্যটা রুপন্তী খুব উপভোগ করে। কত মানুষের কতরকম স্বপ্ন খেলা করে এই বাড়ি যাওয়া নিয়ে। প্রতিবছরই এই ঈদ জার্নিটা একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হলেও সবাই এটা মেনেই আবারও পরের ঈদে বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আসলে দেশের পরিবহন খাতের নানান বিড়ম্বনা নিয়ে সবারই অভিযোগ সত্ত্বেও মেনে নেয়া ছাড়া আর কীইবা করার থাকে!

চোখে-মুখে জার্নির ক্লান্তি বাসস্ট্যান্ডেই পেয়ে বসে সবাইকে। বিশেষ করে ঈদের আগে আগে মার্কেটে ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতেই শরীরের অর্ধেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। তারপর আসে সেই কাঙ্খিত বাড়ি যাওয়ার পালা। ঈদ উপলক্ষে ব্যাগের সংখ্যা সবারই বেশি। প্রিয়জনদের জন্য হাজারও রকমের কেনাকাটা শেষে সবাই ঢাকা ছাড়ছে বেশ কয়েকদিনের জন্য। কতরকম ফরমায়েশি জিনিস যে কিনতে হয় লোকজনকে! ছোট ভাইবোনের আবদার থাকে, মা-বাবার তেমন কিছু চাওয়ার থাকে না বলেই তাদের জন্য কেনাকাটা একটু কঠিনই ঠেকে। রুপন্তী এগুলো জানে, তাই অন্যদের দেখে সে তা অনুভব করার চেষ্টা করে। একটা ভালোলাগা কাজ করে তার ভিতর।
রুপন্তীও একটু-আধটু কেনাকাটা করে বাড়ির সবার কথা মনে করে। যদিও তাদের সাথে সম্পর্কটা মৃতই বলা চলে, তারপরও এই মৃত সম্পর্কের লাশগুলো বহন করতে করতেই প্রতিবছর বাসস্ট্যান্ডে আসা, অপেক্ষা করা একটি বাস ছেড়ে যাওয়ার।

মাহতাব ঘড়ি দেখে। ১০টা প্রায় বাজতে চললো। রুপন্তীর জন্য নির্ধারিত বাসটি এখনই ছেড়ে যাবে। তারপর সে ঢুকবে ভ্রমণার্থীদের রুমটিতে। সেখানে যথারীতি বসে থাকবে রুপন্তী, বুকের ভিতরে একরাশ বেদনা নিয়ে। মাহতাব এটা দেখে আসছে আজ বেশ কবছর ধরেই। তাই সে রুপন্তীকে ছেড়ে যায় না, সে বরং তাকে উৎসাহ দিতে প্রতিবছরই টিকেট কিনে আনে। যথারীতি ওর সাথে শপিংয়েও যায়। এটা-ওটা পছন্দের কথা বলে। অনেক সময় সেও কিছু কেনাকাটা করে রুপন্তীর আদরের কারও জন্য। এই একটুকরো সুখ রুপন্তীকে সে দিতে পেরে খুশি হয়।

রুপন্তী আসলে কোথাও যায় না। ওর যাওয়া হয় না কোথাও। ‘ঈদে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ’, ‘শেকড়ে ফিরছে মানুষ’, ‘ঈদে বাড়ি ফিরছে সবাই’, পত্রিকার পাতার এসব খবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে রুপন্তী, প্রতিবছরই। শিরোনামগুলো ওর মুখস্ত। ভিতরে কী লেখা থাকবে, তাও সে জানে। এই যে স্বজন, প্রিয়জনদের কাছে ফেরার তাগিদ, এটা রুপন্তীকে বিমর্ষ করে তোলে। ওর শেকড় কই? কোথায়ই বা প্রিয়জন, স্বজন? আজ এতো বছর সে ঢাকায় বসবাস করে, গত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে মাহতাব তার জীবনে, ও ছাড়া তো আর কোন প্রিয়জন নেই রুপন্তীর। যাওয়ারও জায়গা নেই।

অনেক অনেক বছর আগে, তখন সবে তারুণ্যে পা দিয়েছে রুপন্তী, একটা ভুল করে ফেলেছিল সে। একটা বিয়ে করে ফেলেছিল শুধুমাত্র খামখেয়ালি করে। সেই একটা ঘটনা ওর পুরো জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। সেই যে শেকড়চ্যুত হয়েছিল, আর ফিরতে পারেনি। মা যতদিন বেঁচেছিল, বলতো, আমি যতদিন আছি, তুই অবশ্যই বাড়ি আসবি, আমার কাছে আসবি’। মা এখন নেই। তাই তার আর ফেরা হয় না সেখানে। কেউ কোথাও আর তার অপেক্ষাতেও থাকে না। রুপন্তীর নামটা ডিলিট হয়ে গেছে সেই বাড়ির ইতিহাস থেকে।
রুপন্তী তাই প্রতিবছর প্রতি ছুটিতে একটা করে টিকেট কাটে বাড়ি ফেরার। কখনও বাসের, কখনও বা ট্রেনের। অনেকক্ষণ ধরে যাত্রীদের যাওয়া-আসা সে দেখে। অধিকাংশই তার নিজ জেলার ভাষায় কথা বলে। বেশ মজা লাগে এটা রুপন্তীর। কীভাবে বদলে যায় পুরো পরিবেশ। অনেকে বলাবলি করতে থাকে, কার জন্য কী কিনেছে, কে কী পছন্দ করে, আম্মা-আব্বার জন্য কী কিনেছে, বাড়ির সবার ছোট মানুষটার জন্য কী কিনেছে। এসব কথা বলার সময় সবার চোখেমুখে যে প্রশান্তির ছায়া খেলা করে, রুপন্তী সেটা অনুভব করতেই বছরের পর বছর এই কাজটি করে আসছে। তারপর বাসটা অথবা ট্রেনটি দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাওয়ার পর সে ধীরে ধীরে শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহতাব এসে ওর হাতটি ধরে একহাতে, আরেক হাতে ব্যাগটি উঠিয়ে নেয়। তারপর একটা রিকশা নিয়ে ফিরে আসে তার চেনা পরিচিত, গোছানো সংসারে। পুরো এই রিকশা জার্নিটাতে দুজনের মাঝে একটি কথাও হয় না। মাহতাব শুধু একহাত দিয়ে ওর পিঠের পিছনটা একটু কাছে টেনে নিয়ে এসে ধরে থাকে। রুপন্তী হালকা করে মাথাটা রেখে দেয় মাহতাবের কাঁধে। মাহতাব জানে রুপন্তী এখন কাঁদবে, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে তার শার্ট ভিজে যাবে। এমনটাই যে হয়ে আসছে গেল কতগুলো বছর ধরে।

(ফিচারে ব্যবহৃত ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.