নূরজাহানের কথা কি মনে আছে?

গালিব চৌধুরী:

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ছাতকছড়া গ্রামের সেই নূরজাহানের কথা বলছি।
১৯৯২ সালের ১০ জানুয়ারি – গ্রামের মাতবর ও মসজিদের ইমামের দেওয়া এক ফতোয়া মোতাবেক (দেশের সংবিধান মতে যা অবৈধ) জেনা করার অভিযোগ এনে নূরজাহানকে কোমর সমান মাটির গর্তে পুঁতে ১০১টি কাঁকড় ছোঁড়া হয়েছিল।
ফতোয়াবাজরা প্রথমে তাকে গলা পর্যন্ত পুঁতার নির্দেশ দিয়েছিল। পরে গ্রামবাসীর অনুরোধে দয়া করে তারা গর্তের গভীরতা গলা থেকে কোমর পর্যন্ত কমিয়ে আনে। তারপর দেশের সকল আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই নির্দেশ পালনও করা হয় একেবারে নিখুঁতভাবে। কিন্তু নূরজাহান তখনও বেঁচে ছিলেন।
তাই রায় কার্যকর করার পর উপস্থিত গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়া নূরজাহানের উদ্দেশ্যে বলে “এতোকিছুর পর তোর বেঁচে থাকা উচিত নয়। তোর বিষ পানে মরে যাওয়া উচিত”।

এই গর্তে পুঁতেই নূরজাহানকে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল- ছবিটি বিডিনিউজ২৪ডটকম থেকে নেয়া

সেই ১০১টি পাথরের আঘাত নূরজাহান সহ্য করে নিতে পারলেও, নিজের অপমান মেনে নিতে পারেননি। তাই বিষপানে আত্মহত্যা করেন ২২ বছরের ওই তরুণী।
ক্ষমতাবানদের ছুঁড়ে মারা পাথর নূরজাহানের মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল সেদিন, কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার আত্মসম্মানবোধকে।
মানুষ হিসেবে তার পরিচিতিকে এবং সমাজ, মানুষ ও ধর্মের ওপর তার বিশ্বাসকে। তাই এক বিশাল অবিশ্বাস এবং অপমানের ভার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল।

সালিশ বিচার করতে এসে গৃহবধূ সুন্দরী নূরজাহানকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইমাম আবদুল মান্নান। নূরজাহানের পিতা এ প্রস্তাবে রাজী না হয়ে একই গ্রামের মতলিব মিয়ার সঙ্গে নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে দেন।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর অনেক কাল পেরিয়ে গেছে। দেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। অনেক উন্নয়ন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সব ধরনের ক্ষমতাশালীদের দৌরাত্ম্য কোথাও কমেনি। বরং সর্বত্রই বেড়েছে। ধর্ম আর রাজনীতিতে তারা এখনো সক্রিয় এবঙ দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়েও বেশি।
ইদানিং এই চরিত্রগুলো জনগণ ও রাষ্ট্র সব মহলের আশকারায় নিজেদের অপ্রতিরোধ্য মনে করছে। তারা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, তেমনটাই মনে করছেন তারা।

তাই বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায়, তাদের কেউ পরাজিত করা তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সেরকম তারা এখন আর ভাবতে পারছেন না।
সেই ফতোয়ার রায়ে তাই নূরজাহানের বাবা আশ্রব উল্যা ও মা সায়েরা বেগমসহ বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরকেও কানে ধরে উঠবস করার শাস্তিও দেওয়া হয়।

আজ যারা নিরাপদে বিদেশে বসে বা দেশের শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৃত্তের ভিতরে বসে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নিঃশঙ্ক ও অতি আত্মবিশ্বাসী, যাদের ধারণা তারা এই আগ্রাসী শক্তির ধরাছোঁয়ার বাইরে – ঘটনার ক্ষীণ পরিবর্তনেই তারা কিন্তু নূরজাহানের বিয়ের অতিথিদের ভূমিকায় নেমে যেতে পারেন।
বিদেশে যারা আছেন তারা নাহয় বেঁচে যাবেন, কিন্তু দেশে থেকে যারা বুঝে এবং না বুঝে এই প্রসেসের অংশ হয়েছেন, পরিস্থিতি বদলালে তখনও কিন্তু ক্ষমতাশালীরা জেনাহ হোক বা অন্য যে কোনো অপরাধ – তারা সব করেও পার পেয়ে যাবে।

কিছু না করেও – শুধুমাত্র দর্শকের ভূমিকা পালন করার জন‍্য, কানে ধরে উঠ বস করার শাস্তি মাথা পেতে নিতে বাকিরা প্রস্তুত আছেন তো?

উইমেন চ্যাপ্টার নোট: ছাতকছড়ার নূরজাহানের দোষ কী ছিল? দীর্ঘদিন তার স্বামী ঘরে না ফেরায় তার বাবা-মা তাকে আবার বিয়ে দিয়েছিল। একদিন সেই স্বামী ফিরে এলে গ্রামের মৌলভী ও মুরুব্বীরা মিলে এ বিয়েকে হারাম ঘোষণা দেয় ও সালিশ বসায়। সালিশে ফতোয়া দেয়া হয় যে নূরজাহান দ্বিতীয় স্বামীর সাথে থাকতে পারবে না। সেইসঙ্গে তাকে ১০১টি পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। পাথরে ক্ষতবিক্ষত নূরজাহান এই অপমান ও অবমাননা সইতে না পেরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। 

 

শেয়ার করুন: