আমেনা বেগম ছোটন:
আমার ধারণা ছিল, উন্নত দেশে রঙ ফর্সা করা ক্রিম পাওয়া যায় না। সেখানে সবাই নিজের গায়ের রঙ গর্বের সাথে এক্সেপ্ট করে নেয়। আমার ধারণা ভুল, ফার্মেসিতে স্কিন লাইটেনিং ক্রিম, স্কিন ফেডিং ক্রিম ইত্যাদি পাওয়া যায়। সানস্ক্রিন এর যে অধুনা জনপ্রিয়তা সেটি স্কিন ক্যান্সার থেকে, রোদপোড়া স্কিন থেকে, সানস্ক্রিন মাখা মুখ অপেক্ষাকৃত ফর্সা বলেই। নতুবা সেটি গ্রিন টি থেকে খুব একটা বেশি জনপ্রিয় হতো না।
মানুষের নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবার ঘটনা দুর্লভ। যে ফর্সা, তারও নানাবিধ খুঁত থাকে। তার ব্রন, মেছতা, ফেসিয়াল, হেয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি ঝামেলা থাকে। Body dysmorphic disorder নামক একটি রোগ আছে, তারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। শ্রীদেবী যে অত সুন্দর, তাও প্লাস্টিক সার্জারি করে করে চেহারার এয়সি কি তেয়সি করে ফেলেছে। ব্রেস্ট ইম্পল্যান্ট, কসমেটিক সার্জারি, লাইপোসাকশন ইত্যাদি বিউটিফিকেশন প্রসিডিউর লিগ্যাল, তাহলে কি স্মল ব্রেস্ট/ লিপ, বোঁচা নাক, সবই রেসিজমের মধ্যে পড়ে?
কালো, তবু সুন্দর – এ কথার মধ্যে আপত্তি করার যে মানসিকতা, তা এই দেশের কতজন মানুষের মধ্যে আছে? খুবই কম। যে কয়জন আছি, (ফর্সা মানুষ যখন বলবে কালোকে কালো বলা যাবে না, তখনও কালোরা বলবে ঢং দেখ, বেটি তুই নিজে ফর্সা, আইছস আমারে দয়া দেখাইতে, তোর কপালে ঝাঁটা মারি) তাও এটি মেনে নিতে আমাদের বয়স কমসে কম ২৫ বছর পার করতে হয়েছে। যারা কালো বলে অন্যদের বুলিয়িং করে, তারাও সমাজের বাই প্রোডাক্ট, সে দেখেছে তার পূর্বসুরীদের কাছে কালো নিয়ে কটুকথা বলতে, এইটাই তার মগজে ঢুকে গেছে।
এখন ১০ বছরের একটা বাচ্চা (ছেলে, মেয়ে যাই হোক, ছেলেদেরও কালো হলে বুলিং সহ্য করতে হয়) যদি পত্রিকার পাতা উলটে দেখে, কালো, তবুও সুন্দর, এবং সেটা কেন এবং কীভাবে – তার চিন্তায় একটা পরিবর্তন আসবে, তার গায়ের রঙ সে মেনে নিতে শিখবে। যে মেয়ে কালো বলে বিব্রত বলে তার পছন্দের রঙটা এড়িয়ে চলে, সেও হয়তো সাহস করে সেই রঙ গায়ে জড়িয়ে হাসবে। সে দেখবে, আসলে সে কালো বলে অসুন্দর ছিল না, গায়ের রঙ নিয়ে যে চাপা হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা তার চেহারায় ফুটে ওঠে সেটিই অসুন্দরের মূল। (এ ব্যাপারে আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। আমার দিকের মানুষ কালো হলেই নিজেকে নিয়ে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমার শাশুড়ির দিকের যারা আত্মীয়, তারা শ্যামলা হলেও এতো চমৎকার স্টাইল ক্যারি করেন, তাদের বয়স ৪০-৭০, ছেলেমেয়ে যাই হোক; তাদের সামনে আমি মনে মনে বলি আমার ফ্যাশন সেন্স একটু ভালো করা দরকার)
এখন অনেক বিউটি প্রোডাক্টে ট্রান্সভেস্ট মেল ব্যবহৃত হয়। তারা সুন্দর ফাউন্ডেশন, আইল্যাশ, লিপ গ্লস মেখে মোহনীয় অংগভংগী করে – অনভ্যস্ততা হেতু বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্য হিসেবে মনে সায় দেয় না। কিন্তু তারা একটা বড় সম্প্রদায়, তাদের ছেলে হয়ে মেয়ে সাজবার তীব্র আকাঙ্খাকে আইন করে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। ব্যয়বহুল ডিউটি প্রোডাক্টসের পটেনশিয়াল কনজিউমার তারা।
তাদের নিয়ে যদি প্রথম আলো লিখে, ট্রান্সভেস্ট তবু সুন্দর, এই আপনিই বাহবা দেবেন। বলবেন, দেখ, প্রথম আলো কত আধুনিক, এলজিবিটি রাইটসকে প্রমোট করছে, সেই খবর শেয়ারও দিতে পারেন।
প্রান্তিক অঞ্চল বা মফস্বলে যে দেশের কালো সমস্যা যে এখনো আপনার ট্রান্সভেস্ট মডেল এপ্রিসিয়েশনের পর্যায়ে আছে এটা বুঝলে ” কালো তবু সুন্দর ” এই দেখে এত অবাক হতেন না। যে কালো বলে নিজেকে জন্ম থেকে দোষারোপ করে আসছে, তার মনোবল বাড়ানোর প্রথম বাক্য কালো, তবু সুন্দর। এরপর একদিন সে প্রথম আলোর ভুল ধরতে পারবে যে বাক্যটি আপত্তিকর, তার আগে কালো মানে অসুন্দর এই চিন্তা থেকে বের হওয়া জরুরি।
সমাজ একদিনে বদলায় না। যারা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার জোরালো প্রতিবাদ অনেকের কাছে এ ধারণাটি পৌঁছে দিয়েছে – কালোকে প্রচ্ছন্নভাবে সান্ত্বনা দেয়াটাও একটা সামাজিক কুপ্রভাব। আমরা প্রতিনিয়তই শিখি। আমার আজকের আধুনিক মানসিকতা আমি সঙ্গে নিয়ে জন্মাইনি, আমি বেগম রোকেয়ার বংশধর নই, শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সুসঙ্গ, অভিজ্ঞতা সব মিলিয়েই মানসিকতা পাল্টেছে।
এক সময় কেউ ফর্সা হতে চাইলে তীব্র প্রতিবাদ করতাম, তাকে বুঝাতে চাইতাম যে ফর্সা হতে চাওয়া কোন কাজের কথা না। এখন আর বলি না। সে তার চেহারা কীভাবে দেখতে চায়, এটি নিয়ন্ত্রণ করার আমি কে? আমাকে সেই অধিকার কে দিয়েছে?
যে ছেলে ফর্সা বউ খোঁজে, তার প্রতিও বিরক্ত হই না, তার প্রেমিকার কেমন হওয়া উচিৎ, সেটা বলার এক্তিয়ার আমি রাখি না। একজন মানুষের সাথে সারাজীবন কাটাবে সেটি নিশ্চয়ই একটি বড় ব্যাপার। লোক দেখাতে কালো বিয়ে করে ফর্সা নারীদের পেছনে ছোক ছোক করলে কালো মেয়েটির জন্যে সেটি আরও বড় সমস্যা।
অনেক মেয়েকেই তার কালো, ভুঁড়িওয়ালা, টেকো স্বামীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে দেখেছি। শুধু ছেলেদের দোষ দিয়ে লাভ কী?