
আরণ্যক ঋষি:
কাশিমপুর কারাগারে মারা গেছেন লেখক মুশতাক আহমেদ ভাই। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে তিনি আমার শ্বশুরের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। ঢাকায় তার বাসা ও আমার বাসা অনেকটা কাছাকাছি। মুশতাক ভাই শুধু লেখক নন; তিনি একজন আলোচিত উদ্যোক্তাও। দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম কুমির চাষ শুরু করেন তিনি। মুশতাক ভাই কতোটা মেধাবী ছিলেন, পরিশ্রমী ছিলেন তা তার উদ্যোগ দেখলেই বোঝা যায়।
নিজের মেধার উপর যাদের বিশ্বাস আছে তারা সাহসী হয়। মুশতাক ভাই সাহসী ছিলেন তা প্রমাণিত হলো তার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। শুধুমাত্র লেখালেখি করার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ছয়বার জামিন চেয়েও তিনি জামিন পাননি। মুশতাক ভাই মুক্তির জন্য হয়তো অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। শেষমেষ চিরমুক্তি জুটলো তার কপালে।
মুশতাক ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে ইতোমধ্যে নানা মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেমন তরুণরা আওয়াজ দিচ্ছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তেমনি রাজপথেও অনেকে নামছে। এসব দেখে সাধারণ মানুষ খানিকটা আশায় বুক বাঁধলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর সে আশার বেলুনে সুঁচ ফোঁটাবে নতুন কোন ইস্যু। নতুন কোন নাসির- তামীমার বিয়ের খবরে মুশতাক ভাইয়ের মৃত্যু ঢাকা পড়ে যাবে। এখন আমরা যারা তাকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি, লাইক কমেন্ট করছি, তারাই ব্যস্ত হয়ে যাবো নতুন তামীমার বিয়ে ‘শুদ্ধ’ হয়েছে নাকি হয়নি সে তর্কে।
লেখাটি লিখতে বসেছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে উদ্দেশ্য করে। সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “লেখক মুশতাক অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে লিখতেন”। হ্যাঁ মন্ত্রী মহোদয়, আমরা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করার জন্যই লিখি। মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করাই আমাদের কাজ। ঔপনিবেশিক মানসিকতায় লালিত ব্যক্তিবাদ, আধিপত্যবাদের মুখে লাথি মারাই আমাদের কাজ। অধিকাংশ মানুষ যে বিশ্বাসকে পূজো করে, আমরা লেখকরা সে বিশ্বাসকে পদদলিত করি। আমাদের চিন্তা, আমাদের লেখা যখন মানুষের গতানুগতিক বিশ্বাসে আঘাত হানে, তখনই আমরা বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাই। যে লেখা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করে না সে লেখার কোন সার্থকতা নেই। পুতুপুতু মার্কা প্রেমের গল্প, কবিতা সবাই লিখবে, সেটা আপনি বা আপনারা আশা করছেন কেন?
যুগে যুগে কালে কালে অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে করেই সভ্যতা এগিয়ে গেছে৷ আপনি যা বিশ্বাস হিসেবে লালন করছেন, অন্যের কাছে সেটাই হবে অবিশ্বাস। রাস্তার সন্ত্রাসীরা গায়ের জোরে সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু লেখকরা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করে যুক্তি দিয়ে। সে যুক্তি খণ্ডানোর জ্ঞান বা ক্ষমতা যখন কারও থাকে না, তখনই লেখকদের টুঁটি চেপে ধরা হয়।
আসুন, আমরা চৌদ্দশত বছর আগে যাই। ইসলামের নবী মুহাম্মদ যখন একেশ্বরবাদের দাওয়াত দিলেন, বললেন ” আল্লাহ এক ও আমি তার প্রেরিত রাসূল ” তখনও কিন্তু পৌত্তলিকদের বিশ্বাসে আঘাত এসেছিল। কাবা ঘরে রাখা মূর্তিগুলো যখন ভাঙ্গা হচ্ছিল, তখনও ইসলামের শত্রুদের বিশ্বাসে আঘাত এসেছে। সেই আঘাতের ভেতর দিয়েই ইসলামি সভ্যতার উত্থান ঘটেছিল।
সক্রেটিস মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করছেন- এমন অভিযোগে তাকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছে। পৃথিবী নয়, সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্র- এমন বক্তব্যের অপরাধে বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করছেন। ধর্ম ও বাইবেলকে অবমাননা করছেন। আট বছর কারাগারের অন্ধকারে ধুঁকে মারা গেছেন গ্যালিলিও। তাঁরও একই অপরাধ। মানুষের বিশ্বাসে আঘাত।
মীর মশাররফ হোসেন – এর লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’র বিভিন্ন চরিত্র ইসলামের ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি যদি আজকের দিনে বিষাদ সিন্ধু লিখতেন, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাকেও গ্রেফতার করা হতো। গ্রেফতার হতে হতো মাইকেল মধুসূদন দত্তকে রামায়ন অবমাননার দায়ে। মেঘনাদ বধ কাব্যে রাবনকে বীর হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয় যা সনাতন ধর্মের অনেকের বিশ্বাসে আঘাত। ভাগ্যিস, মীর মশাররফ হোসেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম আজ বেঁচে নেই।
‘মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করে লেখা যাবে না’- এমন সুবিধাবাদী কথা যদি আরো দু’শ বছর আগে আইন আকারে আসতো, তাহলে ভারত উপমহাদেশে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে পারতেন না। কারণ সেটা ছিল গোঁড়া হিন্দুদের বিশ্বাসে অনেক বড় আঘাত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিয়ের প্রচলন করতে সক্ষম হতেন না। কট্টর, মৌলবাদী, গোঁড়াবাদী যাই বলি না কেন- তারা এখন যেমন আছে তেমনি তখনও ছিল। বিধবা বিয়ে চালু হওয়া সেই হিন্দু মৌলবাদীদের গালেও চপেটাঘাত ছিল। ছিল তাদের সমর্থকদের বিশ্বাসে আঘাত।
যে লেখায় মানুষের বিশ্বাসে আঘাত আসে না, যে লেখা মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয় না সে লেখার স্বার্থকতা কী? ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের বিরুদ্ধে যখন আব্রাহাম লিংকন বিল পাস করছিলেন তখনো অনেকের বিশ্বাসে আঘাত এসেছিল। বেগম রোকেয়া যখন মেয়েদেরকে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাক দিলেন, তখন দীর্ঘদিন সযত্নে আগলে রাখা পুরুষতন্ত্রের মুখে চপেটাঘাত পড়েছিল। মানুষের বিশ্বাসকে আঘাতের কথা বলছেন? বেগম রোকেয়ার চেয়ে সাহসী আঘাতকারী আর কেউ আসেনি।
আজ যদি লেখকদের কোন লেখায় বিশ্বাসে আঘাত আসলে তাকে কারারুদ্ধ হতে হয় তাহলে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়াকেও কারারুদ্ধ করা উচিত। অবশ্য ওনারা এ সময়ের মানুষ হলে রেহাই পেতেন না। একদিকে মৌলবাদীদের আঘাতের ভয় অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- দুটোই তাদের হুমকিতে ফেলত।
লেখকরা স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে পারবেন না, বলতে পারবেন না, নির্মাণ করতে পারবেন না। কথার জন্য, ছবির জন্য, গানের জন্য, নাটকের জন্য সৃষ্টিশীল মানুষের কণ্ঠরোধ করা হবে। প্রশ্ন এসে যায় তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর সাথে আপনাদের পার্থক্য কী? ১৪ ডিসেম্বর রাতে যতো বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা তো আর অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে যাননি। বরং তাদের লেখা, তাদের নির্মাণ, তাদের চিন্তাকে পাকজান্তা হুমকি হিসেবে নিয়েছিল। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাকে তারা পাকিস্তানের প্রেমের বিশ্বাসে আঘাত হিসেবে নিয়েছিল। যেমনটি এখন আপনারা লেখকদের, ব্লগারদের, অ্যাক্টিভিস্টদের চিন্তাকে আপনাদের বিশ্বাসে আঘাত হিসেবে নিচ্ছেন।
ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলবে। দমন পীড়ন চালিয়ে কারো গতি বেশীদিন রোধ করা যায় না।
যেটা সত্য সেটা প্রতিষ্ঠিত হবেই। একজন মুশতাক হয়তো চলে গেছেন। কিন্তু অসংখ্য মুশতাক এ জনপদে আছে। সবার মুখ আপনারা বন্ধ করতে পারবেন? বা কয়দিন করবেন? তারুণ্যের চিন্তা দিয়েই পথ চলবে আগামী দিনের বাংলাদেশ।
৩০ লক্ষ লোক হত্যা করেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী টিকে থাকতে পারেনি। স্বৈরাচার এরশাদ অনেক তান্ডব চালিয়েও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারেনি। আপনি ইতিহাস সচেতন হলে আপনি নিজেও তা বুঝতে পারছেন। ব্লগার হত্যা করে, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অ্যাক্টিভিস্টদের রোধ করে, দমন পীড়ন চালিয়ে, নানা ধরনের কালা কানুন করে বেশীক্ষণ স্বার্থ হাসিল করা যাবে না। সভ্যতা নিজ গতিতে চলবে। পুরাতন বিশ্বাসে আঘাত করে জন্ম নিবে নতুন বিশ্বাস।
(লেখক: আরণ্যক ঋষি, অ্যাক্টিভিস্ট)