ক্ষরণ

ফাহমিদা খানম:

ড্রইংরুমে দুলাভাই মাথা নিচু করে বসে আছেন – উনাকে দেখলে মায়া লাগার কথা থাকলেও আমাদের কারোই লাগছে না—

“তোমরা আমাকে একটু বুদ্ধি দাও, আমি এখন কী করবো?”
“দুলাভাই, শ্বশুরবাড়ির বুদ্ধিতে আপনি কাজ করবেন? বলেন কী? আপনার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে না? আর আমরা কী বুদ্ধি দিবো বলেন, আপনার কন্যাই তার মাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে”।

দুলাভাই এই প্রথম ছোড়দার এই কথায় ক্ষেপে উঠলেন না ,অন্য সময় হলে ঠিকই ছেড়ে দিতেন না ,আজকে সত্যিই অসহায়।
“আমার প্রতি যে মা-মেয়ের এতোটা অভিমান ছিলো আমি বুঝতেও পারিনি, আমি তো ভেবেছি এই বাসায়ই আছে –কী বলবো সবাইকে?”

আমার বাবা অনেক শখ করে বড় কন্যাকে বড় ঘর আর শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন – তাদের রীতি- রেওয়াজের নামে কোথাও কিছু ঘাটতি পর্যন্ত রাখেননি, অথচ সেই বাড়িতে আপুর অবস্থান দেখে সবাই ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল – বিয়ের পর সেই বাড়ির বউদের সবকিছুই ওরা নিয়ন্ত্রণ করতো , যৌথ পরিবারের সেই বউগুলো স্রেফ দম দেয়া পুতুলের মতই ছিলো – তাদের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে বড় আপু এক সময় এই বাড়ির অতিথিই হয়ে গেলো – দাওয়াতি হয়ে আসতো দুলাভাইয়ের সাথে, বাবা যতবার মেয়েকে কিছুদিন কাছে রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করতো, দুলাভাই নির্লিপ্ত উত্তর দিতেন—
“বাড়ির এতো দায়িত্ব ফেলে বাবার বাড়ি বেড়ানোর সুযোগ হবে না”।

বাবার চোখের ভাষা আর পানি আমরা দেখতে পেতাম। আপু প্রথম যখন বলেছিল বাবার টান ওর প্রতি সবচেয়ে বেশি ছিলো, আমরা প্রথমে না বুঝলেও এক সময় বুঝেই যাই আপুর অবস্থানটুকু! একবার ছোড়দা ভার্সিটি থেকে আপুকে দেখতে যাবার সময় আপুর প্রিয় আইসক্রিম নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বাসায়, এটা নিয়েও আপুকে খোঁটা হজম করতে হলেও দুলাভাইকে এসব বললে কাজ হতো না, সে সবসময় পরিবারের পক্ষেই থাকতো।

আপু এ বাড়িতে মেহমান হবার পরে সবার আগে বদলে গেলেন বাবা। দুই ভাইয়ের বিয়ের সময় মেয়েপক্ষকে জানিয়ে দিলেন, নিজের যা আছে তা নিয়ে বউ তুলবেন, আর আমার বিয়ের সময়ে দুলাভাই তার পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে না দেওয়ায় নিজেও আসেননি –আপুকেও আসতে দেননি, বাবা নিজে অনুরোধ করার পরেও দুলাভাইয়ের রাগ পড়েনি। আপুর মেয়ে হবার পরে বাবার সে কী আকুলতা! নানাভাইয়ের উপহার সেই বাড়ির কারোই নাকি মনঃপুত হয়নি, আপুর কান্না শুনে আমরা কাঁদলেও বাবাকে আর শুনাইনি। নাতিনের প্রতি অসম্ভব টান ছিলো বাবার – যদিওবা আপু কালেভদ্রে বেড়াতে আসতো। বাবা আর আমরা আমাদের সবটা ভালবাসা সেই বাচ্চার জন্যে অনুভব করতাম, তবুও আমরা আপন হতে আর পারিনি!

“কোথায় যেতে পারে সেটাও বুঝতেছি না, ইয়ে তোমাদের গ্রামের দিকে একটু খবর নিবে?”
“গ্রামে আছে কে? আর ২৫ বছর ধরে এই বাড়িতেই সে আসার, বা থাকার অনুমতি পায়নি, এখন কেন ভাবছেন এই বাড়িতেই আছে?”

বড়দার কথায় চমকে উঠলাম। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের ভেতরে এতো ক্ষরণ, আজকে কেউই ছাড় দিবে না। এতোকাল আপুর জন্যেই চুপ ছিলো সবাই।
“আমি যে ভাই –ভাবিকে এখন কী জবাব দিবো? উনারা দেশে এসেছেন এই বিয়ে করাতেই, আমার মেয়েটা যে এতো জেদি হবে আমি কল্পনাও করিনি”।

“আমার মেয়েটাকে যে কষ্ট দিয়েছো, এটা তোমার প্রাপ্য ছিলো জামাই”।
মায়ের কথা শুনে আমরা তিন ভাইবোন অবাক হয়ে গেলাম – সারাজীবন মাকে দেখেছি বড় জামাইকে তোয়াজ করে চলতে, আর আজ !

“আমি তো মেয়ের খারাপ চাইনি, আর আমার মা চেয়েছেন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত রাখতে, সেজন্যে বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন, এখানে অন্যায়ের কী আছে বলেন?”

“তোমার মেয়ে বা আমার মেয়ের মতামতের কোনো দাম ছিলো কি?”
“আমরা মায়ের উপরে কখনও কোনো কথা বলি না, আর উনি যা করেন আমাদের ভালোর জন্যেই করেন”

“আমার মেয়ে কি মা ছিলো না? নিজের সন্তানের উপরে কি ওর দাবি নাই? সংসারে তার চাওয়া পাওয়ার দাম ছিলো না, তাই বলে কি নিজের মেয়ের বেলাতেও থাকবে না? আচ্ছা সেটা বাদ দাও, তোমার নিজের মেয়ে কি ছোট? নিজের ভালমন্দ কি বোঝে না?

“এসব কী বলছেন আম্মা? আমরা কি ওকে ভালবাসিনি?”

“শাড়ি – গহনা কিনে দিলেই কি ভালবাসা হয়ে যায়? কখনও বুঝেছো তোমাদের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে মেয়েটা এই বাড়ির অতিথি হয়ে গেছে? বেঁচে থাকতে তোমার শ্বশুরের আকুতির বিপরীতে বারবার তাকে ছোট করেছো তোমরা”।

“আমি এখন ওদেরকে কোথায় খুঁজবো?”
“আমার মেয়েটার দুই আনা দাম ছিলো না সংসারে, তোমাদের ইচ্ছের দাম দিতে গিয়ে সে নিজের বাপের বাড়ি থেকেই দূরে সরেছিল, সময় কী নির্মম দেখলে আজকে সুদসহ সব ফিরিয়ে দিলো, আমার মেয়ের জন্যে এতোদিন বুকে কষ্ট ছিলো, মনে হতো জোর করে ওকে খাঁচায় পুরেছি, আজকে শান্তি লাগছে – যে কয়দিন বাঁচবে মা-মেয়ে নিজের মতো করে বাঁচুক!”

মায়ের কান্নায় আমরা সবাই হুঁশে ফিরলাম – এতোকাল ধরে জমিয়ে রাখা কষ্টটুকু পুরোই উগড়ে দিলেন মা অথচ এতোগুলো বছর এই ক্ষরণ বুকে জমিয়ে রেখেছিলেন – হয়তো আপুর জন্যেই চুপ ছিলেন– আজকে আর কিছু হারানোর নেই বলেই হয়তো এভাবে নিজের ক্ষরণ প্রকাশ করলেন!

ফাহমিদা খানম
১৯/২/২০২১

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.