প্রবাসে ভালবাসার বাংলা ভাষা

নওরোজ খালিদ বর্ণী:

লেখাটা আমাদের মতো বাবা-মায়ের জন্য, যাদের বাচ্চারা বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে বড় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে যে বাবা-মায়েরা আছেন তারা পড়লে অনুভব করতে পারবেন যে তারা কত ভাগ্যবান যে তাদের বাচ্চারা কত সহজে নিজের বাংলা ভাষাটা শিখে যাচ্ছে। আর আমরা যারা প্রবাসী বাবা-মা, তারা কত অসহায় যে, এতো কষ্টে অর্জিত, এতো মিষ্টি, আমাদের মায়ের বাংলা ভাষাটা আমরা আমাদের বাচ্চাদের শেখাতে পারছি না, হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। খুবই দুঃখজনক যে আমাদের বেশিরভাগ বাচ্চারাই না জানতে পারছে বাংলা ভাষার ইতিহাস, না জানতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, না পারছে বাংলা ভাষায় ভালো করে একটু কথা বলতে। লিখতে, পড়তে পারা তো অনেক দূরের কথা।

প্রবাসে জন্মানো বাংলাদেশী বাচ্চাদের বাংলা শেখা নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি–

আমার মনে হয়, প্রবাসে বাচ্চাদের বাংলা শেখাটা আসলে নির্ভর করে তাদের বাবা-মায়ের সচেতনতার উপর। যে তাঁরা চান কি না? বাচ্চা কি প্রবাসে জন্মেছে এবং বড় হচ্ছে বলে শুধু সেই দেশের ভাষাই জানবে? নাকি পাশাপাশি বাংলা ভাষাটাও লিখতে পড়তে পারবে, কম করে হলেও অন্তত কথাটুকু বলতে পারবে?

আমি বাংলাদেশে থাকতে কোনদিন অনুভব করিনি যে বাংলা আলাদা করে বলতে বা শিখতে হয়। ওখানে তো বলার জন্য একটাই ভাষা, বাচ্চা যখন প্রথম কথা বলতে শেখে তখন বাংলাই শেখে। তারপর যখন স্কুলে যায় তখন লিখতে পড়তে শিখে যায়, আলাদা করে কোন আয়োজন বা প্রস্তুতি লাগে না। বাচ্চা কথা শেখা মাত্রই চাইলে বড় বড় কবিতা-ছড়া শিখে ফেলতে পারে। কিন্তু বিদেশে বাচ্চাদের আপনা আপনি বাংলা শিখে ফেলার কোন উপায় নাই। ওরা স্কুলে যায়, বাজারে যায়, ডাক্তারের কাছে যায়, প্রতিবেশী বাচ্চার সাথে খেলে-কোথাওই তেমন বাংলা বলার বা শোনার সুযোগ নাই। ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে আমরা – কথায়, খাবারে, পোষাকে, বাঙ্গালী উৎসব উদযাপনে বাঙ্গালী পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করি সব সময়, কিন্তু তার পরও মনে হয় এটা যথেষ্ট নয়। কারণ বাচ্চারা ওদের জগতটাকে নিজেদের মত করে পরিচালনা করে, যেখানে বাংলার স্থান খুব একটা নেই, নেহায়েত বাবা-মায়ের কথাকে সম্মান করে, তাই মেনে নেয়। আর ওরাও জানে যে বাংলা না শিখলেও ওদের তেমন কোন সমস্যা নাই।

প্রবাসে থেকে আমরা বাবা-মায়েরা যদি আলাদা করে বাংলা ভাষাটাকে ভালবাসতে না শেখাই তাহলে বাচ্চাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। কারণ বিষয়টা ওদের পক্ষে নিজে থেকে অনুভব করা সম্ভব না। আমার বাচ্চাদের শিখাতে গিয়েই আমি বুঝেছি কাজটা কত কঠিন। আমাদের ইচ্ছাতে আপনা আপনি ওরা বাংলা শিখে ফেলবে ব্যাপারটা একদমই তেমন না। আমার বাচ্চারা প্রথম কথা বলতে শিখেছে বাংলাতেই, কিন্তু ওরা একটু বড় হতেই যখন বাইরে বেশিরভাগ জায়গাতেই বাংলা ব্যবহার করতে পারছে না, তখন দেখলাম ওরা নিজেরাই বুঝে নিচ্ছে কার সাথে বাংলা বলা যাবে, আর কার সাথে বলা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো ওরা মানুষ ছোট হলেও খুব দক্ষতার সাথে নিজেদের সাচ্ছন্দ্যের জায়গাটা খুঁজে নেয়। দেখলাম ওরা বাংলা বলাটা এড়িয়ে যেতে শিখে যাচ্ছে। যেমন- একদিন ওরা দুজন সিন্ডারেলা পুতুল নিয়ে খেলছে আর ইংরেজিতে সংলাপ বলছে, শুনে ওদের বাবা বললো- ‘তোমরা বাংলায় কথা বলে খেলো’ সাথে সাথে ওরা বললো- ‘বাবা সিন্ডারেলা তো বাংলা কথা বলে না’।

ভেবে দেখলাম আসলেই তো ওদের পক্ষে ঐ সংলাপ মনে মনে বাংলায় অনুবাদ করে বলাটা একেবারেই সম্ভব না। সারাক্ষণ এমন ছোট ছোট বিষয় ঘটেই চলেছে। সত্যি আমার মনে হয়েছে ওদের জীবনে বাংলা ব্যবহারের জায়গা তো আসলে খুবই কম। আমরা ওদের উপর যেন জোর করে বাংলাটা চাপিয়ে দিচ্ছি। ওরা বাংলাতে মনের ভাব প্রকাশে মোটেও সাচ্ছন্দ‌্য বোধ করে না এটা ওদের জন্য খুব কষ্টের, বাংলা কথা শুনলে ওরা একটু থেমে যায় বোঝার চেষ্টা করে, কী বলবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়, বিব্রতবোধ করে। তাই দেখি যে আমার দুই মেয়ে যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে বা বাঙ্গালী বন্ধুদের সাথেও যখন কথা বলে তখন কখনই বাংলা বলে না। আমাদের কাছে কখনই বাংলায় কিছু জিজ্ঞেস করে না, ওদের বাবা যখন স্কুলের পড়া নিয়ে বসে তখন বাংলা বললে বুঝতে পারে না। আবার আমি যখন বাংলা পড়াই, তখন অনেক কিছু ইংরেজি বলে ওদের বোঝাতে হয়, কারণ বাংলাতে ওরা মনের ভাব বোঝেও না, প্রকাশও করতে পারে না। আমরা যেহেতু সব সময় ওদের সাথে বাংলা বলি, তাই ওরা মোটামুটি বুঝতে পারে, বলতেও চেষ্টা করে। কখনও কখনও আবার আগ্রহ করে কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ বা বাংলা শব্দের মানে জানতেও চায়। কিন্তু সব মিলিয়ে অনেক সময় খুব হাস্যকর বাংলা বলে, যেমন- ওরা যখন একটু ছোট ছিল, ঘুমের সময় এভাবে আমাকে ডাকতো – ‘মা can you please ঘুম পাড়া us। এসব উদাহরণে তো ইতিহাসের পাতা ভরপুর।

শুধু প্রবাসের কথাই বলি কেনো, বাংলাদেশে বাচ্চাদের বাংলা শেখার অনেক সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশে যে বাচ্চারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, তারাও সাধারণত বাংলাতে কথা বলতে চায় না, যেটুকু বলে তা শুনলে মনে হয় না বাংলাদেশে ওরা বড় হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় সব বিষয়ে আশানুরূপ নম্বর পায়, কিন্তু বাংলাতে পায় না। কিন্তু আসলে ওদেরই বা দোষ কী, ওদের গণ্ডিও তো সীমাবদ্ধ। আবার যেসব বাচ্চা বাংলা মিডিয়ামে পড়ে, তাদেরও কিছু বাবা- মাকে দেখি বাচ্চার সাথে ইংরেজিতে কথা বলেন। তারা বলেন যে বাচ্চা বাংলা পড়তে বা বলতে পছন্দ না, ইংলিশেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুনে অবাকই লাগে। তাদের অবশ্য ভরসা আছে , কারণ বাচ্চা বাংলা তো শিখবেই! আসলে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে গেছে, তা তো আমাদের মেনে নিতেই হবে।

এখানে কিছু বাচ্চাকে দেখেছি যাদের একই সাথে ইংরেজি-বাংলা দুটো ভাষা রপ্ত করতে সমস্যা হয়। বাসায় এক রকম, বাইরে আরেক রকম ভাষা শুনে ওরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায়, এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সেক্ষেত্রে এদেশের ডাক্তার যে কোনো একটা ভাষা শেখানোর উপর জোর দিতে বলে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চা যেই ভাষাটা সবসময় ব্যবহার করতে পারবে, সেই ভাষাটাই শেখে যাতে বাচ্চার মনের ভাব প্রকাশে বাধা না পায়। সেক্ষেত্রে বাংলা আর জায়গা পায় না।

কিন্তু যে বাচ্চাগুলোর কোন সমস্যা হচ্ছে না তাদের জন্য, আমাদের মতো বাবা-মায়েরই দায়িত্ব, যাতে ওরা কোন চাপ অনুভব না করে ভালবেসে বাংলা শেখে। বাংলাদেশের মত এদেশের বাচ্চারাও নিজেদের ক্লাসের পড়া নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকে- তার সাথে তো সপ্তাহ জুড়ে সাঁতার শেখা, ছবি আঁকা, নাচ, গান বাজনা, খেলা, কোচিংসহ আরও অনেক কিছুর বাস্ততা থাকে। কোনো কিছুতেই তো পিছিয়ে থাকা যাবে না। এতো প্রতিযোগিতা চারদিকে, যে ওদের হাতেও সময় অনেক কম। তাছাড়া বাবা-মায়েরও চাকরি -সংসার-সামাজিকতা সব সামলিয়ে সময় বের করা খুব কঠিন। কিন্তু অনেকেই যখন বলেন বিদেশে তোমাদের বাচ্চাদের তো তেমন একটা পড়তে হয় না, ভারি বইয়ের ব্যাগ টানতে হয় না, ওরা তো সবসময় খেলার উপরেই থাকে। আর তোমাদেরই বা কাজ কী? সবই তো মেশিনে হয়, যেমন কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়া-মোছা, রান্না ইত্যাদি। এগুলো যারা বলেন, তারা হয়তো মনে করেন ফেসবুকের ঝকঝকে ছবির মতোই আমাদের জীবন। তাঁদের একদমই জানা নাই প্রবাস জীবনের যন্ত্রণা, চব্বিশটা ঘণ্টা আমাদের কীভাবে যে কাটে!

এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটাই মনে পড়ে–

‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে,যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।’

বিদেশে বড় হওয়া প্রবাসী পরিবারের বাচ্চাদের প্রধান ভাষা ইংরেজি হলেও বাড়িতে যেহেতু মাতৃভাষার প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না, সে যতই বাড়িতে ইংরেজি চর্চা হোক না কেনো, বাংলা মিশ্রিত হবেই। এতে ইংরেজি ভাষাভাষী বাচ্চাদের সাথে একটু তফাত যদি থাকে তা স্বাভাবিক। তবে তাতে বাচ্চার একাডেমিক ইংলিশ ভালো হতে কোন বাধা নাই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া যেহেতু বিবিধ ভাষা-ভাষীদের দেশ, সেহেতু কোন বাচ্চাই যেন পিছিয়ে না থাকে ইংরেজি ভাষাভাষী বাচ্চাদের থেকে, তাই ওদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রচুর পরিমাণে ইংরেজি বই পড়তে উদবুদ্ধ করা হয় ছোটবেলা থেকেই। তাই ওদের ব্যস্ত জীবনে আমি এতোটা আশা করি না যে সমান তালে ওরা ইংরেজির মতো বাংলা শিশুসাহিত্যের বইগুলো সেভাবে পড়তে আগ্রহী হবে।

কিন্তু অসম্ভবও না। এখানে অনেক বাচ্চা আছে যারা অনেক ভালো বাংলা জানে। যদিও দেখি যে, বাচ্চা হাই স্কুলে যাওয়া শুরু করলে ওরা আরও ব্যস্ত হয়ে যায়, আর ওদের বাংলাটাও একটু দুর্বল হয়ে পড়ে, কথায় ইংরেজি টান আরও বেড়ে যায়, কিন্তু যেটুকু পারে, সেটুকুও কিছু কম না। তাই অনুভব করি আমাদের সব ব্যস্ততার মধ্যে থেকে অল্প একটু সময় বের করে বাচ্চাকে বাংলাটা শেখানো খুবি জরুরি।

আমি অনেক বাবা মাকে আফসোস করতে দেখেছি যাদের বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলা শিখতে পারেনি, বা শিখেও চর্চার অভাবে ভুলে গেছে। ঐ বাচ্চাগুলোর জন্য এই পর্যায়ে আর বাংলা শিখে ওঠা বেশ কঠিন। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য স্টেটের কথা আমি জানি না, তবে সিডনিতে বিভিন্ন জায়গাতে বাংলা স্কুল আছে। কাছাকাছি কোন স্কুলে বাচ্চাকে দেয়া যেতে পারে, তা যদি নাও সম্ভব হয়, বাংলাদেশ থেকে আসা প্রত্যেকটা বাবা-মা চাইলে নিজেরাই বাচ্চাকে লিখতে- পড়তে- বলতে শেখাতে পারেন। বাবা-মা হচ্ছেন সবচেয়ে বড় শিক্ষক। বাচ্চা বাংলা স্কুলে গেলেও সপ্তাহে এক দেড় ঘণ্টায় যা শিখবে তার উপর বাবা -মাকে একটু সময় তো দিতেই হবে, তাতে বাচ্চাদের শেখাটা অনেক সহজ হবে।

বাচ্চারা স্বভাবতই অনেক মেধাবী, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, ওদের একটু দিক নির্দেশনা দিলে ওরা গর্ব করার মতো অনেক কিছু শিখে ফেলতে পারে । তার জন্য শুধু অভিভাবকের ইচ্ছাটুকুই যথেষ্ট। আমি যতটুকু জানি এদেশে বাচ্চাদের হাই স্কুলে বাংলা ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বাচ্চারা বা বাবা-মা’রা বাংলা বিষয়টাতে আগ্রহী না। তারা জাপানিজ, স্প্যানিশ, ভাষা শিখে গর্ববোধ করে, কেউ বাংলা নিতে চায় না বলে স্কুলগুলোও বাংলা রাখে না। অথচ একথা কারও অজানা নয় যে চাকরির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাষা বিশেষ মূল্য যোগ করে।

তাহলে প্রশ্ন হলো, সেই ভাষাটা বাংলা নয় কেন?

আমার কাছের একজন বন্ধু একদিন আমাকে বলছিলো- ‘কেন তুমি বাংলা পড়িয়ে সময় নষ্ট করছো, বাংলা পড়ে কী করবে ওরা? বরং ম্যান্ডারিন পড়াও, পরে অনেক কাজে লাগবে। ওকে শুধু এটুকুই বললাম, কোন ভাষাকেই আমি ছোট করে দেখছি না, কিন্তু বাংলা শেখানোর তাগিদতাই আমার বেশি, কারণ এটাই ওদের জীবনে সম্পদ হয়ে থাকবে, আর শেখাতে না পারলে আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না।

আরও কিছু উদাহরণ মনে পড়ে গেলো। যেমন- # বেশ অনেক দিন আগে এখানে একটা বাংলা স্কুলের জন্য বাচ্চা খোঁজা হচ্ছিল, আমি তখন মাত্র সিডনিতে এসেছি , এখানকার কায়দা-কানুন, মানুষের মানসিকতা কিছুই জানি না। প্রথমবার বাংলাদেশ ছেড়ে আসার সময় প্লেনে সিডনিবাসী একজন বাঙ্গালী ভদ্রলাকের সাথে আলাপ হলে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এখানকার বাংলা শিক্ষার অবস্থা, উনি তেমন কোন ধারণা দিতে পারলেন না। তখন একটু দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, কারণ বাংলাদেশে থাকতে তো বাংলা পড়ানোই ছিল আমার পেশা। এখন অপরিচিত দেশে নতুন জীবনে কী করবো, আমি কিছুই জানি না। যাই হোক তখন বাংলা স্কুলের কথা শুনে মহা উৎসাহে উনাদের সাথে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা খোঁজা শুরু করেছিলাম, আর আমি আমার পরিচিত একটা বাচ্চার বাবার সাথে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বাচ্চার বাবা আমার উপর অনেক রাগ করে বলেছিলেন- ”আমার বাচ্চা এদেশে থাকবে, বাংলা শিখে করবেটা কী ? শুধু শুধু সময় নষ্ট। তুমিও এসব লোকজনের সাথে মেলামেশা করো না, এদের কোন কাজ কাম নাই এরা হুদাই আঁতলামি শিখায়ে সময় নষ্ট করে’। তখন আমিও এদেশে নতুন, উনার উপদেশ শুনে কী বলবো, কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারিনি। তবে বাচ্চাকে বাংলা শেখানো মানে আঁতলামি, এটা শুনে কষ্ট লেগেছিলো, লজ্জাও লেগেছিলো উচ্চ শিক্ষিত মানুষের মুখে এমন মন্তব্য শুনে।

সত্যি বলতে এখনো যখন আমি বিদেশিদের মতো ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারি না, বা একেবারে নির্ভুল গ্রামার ব্যবহার করে ঝড়ের মতো কথা বলতে পারি না, তখনও একবারের জন্যও ঐ রকম লজ্জা লাগে না, বা অপরাধবোধ হয় না।

#আর একদিন, একজন বন্ধুর বাচ্চার জন্মদিনে গিয়েছি, ওখানে এক দম্পতির সাথে পরিচয় হলো। দেখলাম উনারা বাচ্চার সাথে ইংরেজিতে কথা বলছেন, বাচ্চা কোন বাংলা শব্দ বললে সেটা আবার ইংলিশে সংশোধন করে দিচ্ছেন। কথায় কথায় বললেন উনারা বাংলাদেশে বেড়াতে যেতে পারছেন না, কারণ উনার বাচ্চা ভালো ইংলিশ বলতে পারে না। বাচ্চা বিদেশ থেকে দেশে গিয়ে যদি একটু ভালো করে ইংলিশ বলতে না পারে, তাহলে মান-সম্মান থাকবে না।

মনে হলো, হায়রে বাঙালির সম্মানবোধ!

#আরেকদিন আমার মেয়েদের একজন বাঙ্গালী বান্ধবী একই সাথে ওরা ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওকে আদর করে জিজ্ঞেস করেছিলাম -‘তোমার চুল এতো সুন্দর করে কে বেঁধে দিয়েছে’?  বাচ্চাটা কিছুতেই আমার কথা বুঝতে না পেরে বিব্রতবোধ করছিলো, ইংলিশে বলার পর ও উত্তর দিতে পারলো। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি, আমি ভাবতেই পারিনি যে ও বাংলা বোঝে না, কারণ ওর জন্ম বাংলাদেশে, আর চার বছর হলো সিডনিতে এসেছে। পরে আমি ওর মাকে ব্যাপারটা বললাম, ওর মা বললো, ‘এখানে আসার আগে বাংলাদেশে ও বাংলা লিখতে, পড়তে, পারতো, এখন সব ভুলে গেছে, আর ওর ছোট ভাই তো শেখেইনি’। আমি ওদের দুই ভাইবোনকে বাংলা শেখানোর ব্যাপারে বললাম, সাথে সাথে ও না করে দিলো, বললো ‘না আপু শুধু শুধু বাংলা শিখায়ে কী করবো? বাংলা শিখাতে চাচ্ছি না’

# আবার আরেকদিন একটা বাংলা স্কুলের বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার একজন পরিচিত ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বসলেন। তারপর চোখ মুখ টান টান করে বললেন-‘ আজকে দেখবো বাংলা স্কুলে কী এমন বাংলা শেখায়! ওই অনুষ্ঠানে ছোট দুইটা বাচ্চা মেয়ে বাঙালি সাজে সুন্দর করে শাড়ি পরে উপস্থাপনা করছিল, তাই দেখে উনি উপহাস করে পাশের জনকে বললেন, ‘দেখেছেন কেমন বাংলা বলছে? এরা নাকি বাংলা স্কুলে পড়ে? আরে জানি তো স্ক্রিপ্ট যেটা পড়ছে ওটা কেউ বাংলিশে লিখে দিয়েছে, তাও ঠিকমতো পড়তে পারছে না। কথা কে বলছে খতা, ভালোকে বলছে বালো।’ আরো অনেক কিছু বললেন উনি, অথচ উনার বাচ্চারা কিন্তু ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলে না। বোধহয় সেটাই উনাদের কাছে গর্বের বিষয়।

এরকম মন্তব্য শুনে খুব খারাপ লাগলো। আমার মনে হলো মানুষ এতো নির্বোধ কেনো হয়? শুধু উনিই না, এখানে আরও অনেক মানুষকেই দেখেছি যারা এদেশে বাচ্চাদের বাংলা শেখানোটা ওদের জীবন যাপনের সাথে মেলাতে পারেন না। তাঁরা বুঝতেই পারেন না যে ওদের জন্য বুঝে বাংলা কথা বলা সাথে সঠিক উচ্চারণ করা অতটা সহজ না। এখানে বাংলা স্কুলের শিক্ষকরা সপ্তাহে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় পান ক্লাস করানোর জন্য, তাঁরা কেউই টাকা উপার্জনের জন্য কাজটা করেন বলে আমার মনে হয় না। ছুটির দিনে তাঁরা তাঁদের হাজারও ব্যস্ততার জীবন থেকে সময় বের করেন বাচ্চাদের শেখানোর ইচ্ছা থেকে। বাংলা স্কুলের সাথে জড়িত প্রত্যেকটা মানুষেরই সারা বছর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, এমনকি লম্বা ছুটির সময়ও অনেক সময় পরিবারের সাথে তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয় না। স্কুলের দায়িত্বে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে।

তাও দেখা যায়, বাংলা যেহেতু অপরিহার্য বিষয় না, কিছু বাচ্চা সময়মতো আসে না, অনেক সময় হোম ওয়ার্ক আনতে ভুলে যায়, অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসে না, আবার কেউ কেউ কীইবা মনে করে বাংলা শিখতে আসে, আর কীইবা মনে করে শেখা বন্ধ করে দেয়, বলতে পারবো না। এখানে সারা বছর বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা ভর্তি হয়, আর তারা শুরু করে প্রাথমিক পর্যায় থেকে। অর্থাৎ-একটা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা যে লেভেল থেকে শুরু করে, একটা উপরের ক্লাস এর বাচ্চাও একই লেভেল থেকে শুরু করে। ক্লাসে একই গ্রুপের কোন বাচ্চা হয়তো কিছুটা শিখে গেছে, আর একজন বাচ্চা হয়তো তখন শূন্য থেকে শুরু করছে। শিক্ষককে একই ক্লাসে একেক বাচ্চাকে একেকভাবে যত্ন নিতে হয়। তাই পর্যায়ক্রমে বয়স অনুযায়ী প্রতি বছর এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠে যাবার কোন সুযোগ নাই। ওদের আগ্রহ ধরে রাখাও খুব মুশকিল।

মেইনস্ট্রিম স্কুলের সাথে তুলনা করলে তো চলবে না, আবার বাংলাদেশের সাথে তুলনা করলেও চলবে না। কেউ মনে করেন বাংলা স্কুলের পড়ার গতি অনেক মন্থর, কেউ মনে করেন এতো পড়া তাঁর উপর আবার হোম ওয়ার্ক, কেউবা মনে করেন বাংলা স্কুলে গেলেই বাচ্চা ম্যাজিকের মতো রাতারাতি বাংলা শিখে যাবে!

এই তিন ধরনের মানুষই আসলে অনুভবই করতে পারেন না বিদেশে বাংলা শেখার প্রকৃত চিত্রটা। অনুভব করলে বোঝা যায়, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে বাচ্চা অ, আ, ক, খ শিখবে এটা আর এমন কী? কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি বিষয়টা এতোটাও সহজ না, আমার মেয়েরাও বাংলা শিখতে চায় না, অনেক টালবাহানা করে, আমি ওদের কাছে শুধু একটা আবদার করেছি যে বাবা-মা তোদের জন্য সবকিছু করবে, তোরা বাবা-মার জন্য শুধু বাংলাটা শেখ। ওরা আবেগের বশে মেনে নেয়, তখন সুন্দর করে বাংলা পড়ে। ওরা এখন ছোটদের বই দেখে রিডিং পড়তে পারে, ছোট ছোট বাক্য লিখতে পারে, ওরা ক্লাস ফাইভে কষ্টে যেটুকু পারে, বাংলাদেশে হয়তো একটা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা সহজেই সেটা পারে। কিন্তু আমি তাতেই খুশি হয়ে যাই, আর ওদের চর্চার মধ্যে রাখার চেষ্টা করি, কারণ কোনভাবেও ওরা বাংলা মাথায় রাখতে চায় না, ওদের শিখতেও সময় লাগে না, ভুলতেও সময় লাগে না। আমিও হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার পড়াই। আমি জানি ওরা কোন বাংলাবিদ হয়ে উঠবে না কোনদিন। শুধু এটুকুই চাই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটু জানবে, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু জানবে, বাংলাতে মনের ভাবটুকু প্রকাশ করতে পারবে। বাংলা বই পড়তে পারবে, একটু লিখতে পারবে। প্রাথমিকভাবে এদেশে এর চাইতে বেশি আশা করি না। এরপর যদি ওরা নিজে থেকে আগ্রহ করে শিখতে চায় তাহলে তো অনেক পথ খোলা আছে।

আমার বাসায় ছোট্ট লাউঞ্জে আমার বাচ্চাসহ আরও বারোটা বাচ্চার বসার জায়গা করে বাংলা পড়ানো শুরু করেছিলাম রবিবার করে, কিন্তু কোভিডের রেস্ট্রিকশনের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, এখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে, আবার শুরু করতে পারবো আশা করি। আমি সাধুবাদ জানাই ঐ বাবা- মায়েদের যারা তাঁদের হাজারও ব্যস্ততার জীবনে বাচ্চাদের বাংলা পড়ানোর জন্য সত্যিকারের তাগিদ অনুভব করেছেন। আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ইন্ডিয়ান বাঙালি অভিভাবক, তারা নিজেরা খুব ভালো বাংলা জানেন না, কিন্তু বাংলার প্রতি খুব আগ্রহী, তাই মনে প্রাণে চান বাচ্চাকে বাংলা শেখাতে।

কথাগুলো বললাম, কারণ এখন আমি বুঝি বাঙালি হলেই বাংলার প্রতি দরদ থাকবে এমনটা নয়, এদেশে বাংলা যেহেতু বাধ্যতামূলক বিষয় না, সেহেতু ভালো না বাসলে কেউই এই বিষয়ের পিছনে সময় দিবে না। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে। জোর করে কোন বাঙালিকে এটা বোঝাতে চেষ্টা করার কোন মানেই হয় না যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা বাংলা শেখাতে না পারলে, আমাদের পরে বাংলা আর থাকবে না, অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। মানুষের তো চাওয়ার শেষ নাই, ব্যক্তিগতভাবে আমার ইচ্ছা করে, আমাদের বাচ্চারাই শুধু নয়, তার পরেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেনো ভালবেসে বাংলাকে ধরে রাখে, সে তারা যেখানেই থাকুক না কেনো।

আমি নিজে আজকে ১৭ বছরেও বিদেশি ভাষা-সংস্কৃতি নিজের জীবনে ধারণ করতে পারিনি বা চাইনি। আমি কখনও বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও থাকবো স্বপ্নেও ভাবিনি, কোনদিন ইচ্ছাও ছিল না। বাংলাদেশে আমি আমার ভালোলাগার জগতে প্রতিষ্ঠিত ছিলাম। ভাগ্য আমাকে শিকড় ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে দেশের বাইরে। খুব কষ্ট হয়েছিল নতুন সবকিছুর সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে। এখন বাস্তবতার চাপে সময়ের সাথে সব সয়ে গেছে। তেমনি আমি অনুভব করতে পারি, এদেশে জন্মানো বাচ্চাদের কাছে বাংলা ভাষা- সংস্কৃতিটা তো বিদেশি। তাই ওদের সাথে জোরাজুরি করে চাপিয়ে দিতে চাইলে ওরা যখন মনের ভাবটা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না, ওদেরও নিশ্চয়ই কষ্ট হয়।
তবুও জানি হাল ছেড়ে দিলে তো পুরোটাই শূন্য। একথা আমি মানি যে ওরা যতই এদেশে জন্মাক বা বড় হোক বা থাকুক না কেনো, ওদের শিকড় কিন্তু বাংলাদেশেই- একথা অস্বীকার করতে পারবে না কোনদিন। ওদের যেহেতু শিকড় ছেঁড়ার ভয় নাই, তাই আমার চাওয়া এটুকুই যে বিদেশি ভাষা-সংস্কৃতির সাথে ওরা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি চর্চার ভারসাম্য যেন বজায় রাখতে পারে। কোনভাবেও যেন ওরা বাংলা চর্চা থেকে দূরে সরে না যায়। তাই আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি ওদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং চাই যেটুকুই শিখুক তা ভালবেসে শিখুক। আমি এখানে কিছু মানুষকে চিনি যারা তাদের বাচ্চাদের বাংলা লিখতে, পড়তে, শিখাতে পেরেছেন। তাঁরা যখন গর্ব করেন বাচ্চাদের জন্য, খুব ভালো লাগে আমার। তবে একথাও জানি যে তাঁরা কত ধৈর্য আর নিষ্ঠা নিয়ে বাচ্চাদের শিখিয়েছেন, আপনা-আপনি বাংলা শিখে ফেলেনি ওরা। আমি অন্তর থেকে তাদের জন্য সব সময় দোয়া আর শুভকামনা করি। মন থেকে তাঁদেরকে অনুসরণ করি।

আর বাংলা শেখানোর স্বপ্ন দেখি আমার বাচ্চা দুটোর জন্য, সেই সাথে প্রবাসে জন্মানো সব বাঙ্গালী বাচ্চাদের জন্য।

ফেবরুয়ারি ২০২১
সিডনী

শেয়ার করুন: