মা মানেই মহান নয়, জন্ম দিলেই কেউ মা হয় না

ফড়িং ক্যামেলিয়া:

বাংলা সিনেমার একটা বিখ্যাত ডায়লগ হলো, ‘আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি’; অথচ কথাটা হওয়া উচিৎ ছিল, ‘আমি আমাদের সন্তানের মা হতে চলেছি’।

একজন বিবাহিত নারী যখন জানে তার গর্ভে একটা ভ্রুণ এসেছে, তখন সে নিজের অজান্তেই ধরে নেয় সে তার স্বামীকে কোনো একটা উপহার দিতে যাচ্ছে। সে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে শিখে আসা মাতৃত্বের মহিমার অংশ হতে পেরে গর্বিত বোধ করে। অথচ বিবাহিত না হলে তার কাছে এই সন্তান সব চেয়ে বড় লজ্জার কারণ হতো।

যে ভ্রুণ সবেমাত্র তার গর্ভে এসেছে, তার প্রতি তো মায়া জন্মানোর প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। সেখানে মাতৃত্বের সূচনাই হয় না, মা হওয়া তো বহু দূরের পথ। কিন্তু এই সমাজ তাকে শিখিয়েছে, নারী যখন স্বামীর ভ্রুণ তার গর্ভে ধারণ করে, তখন-ই হয় সম্মানিত, তাই সে আনন্দিত। এখানে সে তার অনাগত সন্তানের আনন্দের চেয়ে স্বামীর খুশির কারণ হতে পেরে আনন্দিত হয়। এই অনাগত সন্তান, তার স্বামী এবং সমাজের প্রতি কর্তৃত্ব স্থাপনের হাতিয়ারও বটে, কিংবা কর্তৃত্ব না বলে তার সোশ্যাল সিকিউরিটি বলাই ভালো।

সন্তান জন্ম দিলেই কি মা হয়? মা হওয়া কি এতো সহজ?

ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানশালির নাম শুনে অনেকেই ভাবে এ কেমন নাম! লীলা তো কোনো বংশ না, বরং মেয়েদের নাম হয়। তাহলে কেন সঞ্জয় তার নামের সাথে লীলা যুক্ত করলো? এই নামের রহস্য হলো, বানশালি তার মা লীলা বানশালির নাম থেকে “লীলা” নামটি গ্রহণ করেছেন। সিমি গারেওয়ালের এক ইন্টারভিউতে সঞ্জয় বলেছিলেন, আমার মা আমার জন্য যা করেছেন, তার ধন্যবাদ স্বরূপ আমি আমার নামের সাথে মায়ের নামটা যুক্ত করেছি। আমার মা সমস্ত সংসার একাই সামলেছেন, আমার বাবা কোনো দায়িত্ব পালনের মধ্যে ছিল না। আমাদের এমন দিনও গেছে যখন খাবার কেনার মতো টাকা জোগাড় হতো না, কিন্তু আমার মা কখনো ভাঙতেন না, বলতেন, এটাই জীবন এবং এর সাথে লড়েই জিততে হবে।

লীলা তার সন্তানদের বলতেন, ‘স্বপ্ন সব তোদের, আর সমস্ত দুঃস্বপ্ন শুধুই আমার’।
এটা একজন জন্মদাত্রীর মা হয়ে ওঠার সংগ্রাম।
ঠিক এর বাইরেও উদাহরণ আছে। নিজের সন্তানকে খুন করে ফেলা মাও আছে। এমন মাও আছে যারা স্কুলে গিয়ে স্যারদের বলে আসেন, মারেন কাটেন কোনো সমস্যা নাই, শুধু রেজাল্ট ভালো হলেই হবে!

এমন মা তো আমাদের সমাজে কম না যারা কন্যা সন্তানকে শেখান, মারুক কাটুক স্বামীর ঘরেই থাকতে হবে। সংসার করতেই হবে। স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঘর। ধর্ষণের শিকার মেয়েকে চুপ থাকতে বলেন। মেয়েকে মানুষ থেকে মেয়ে-মানুষ হতে বাধ্য করেন।

আবার কোনো কোনো মা তার ছেলেকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেন। ছেলে আর ছেলের বৌ এর মাঝে সমস্যা তৈরি করেন। ছেলেকে শেখান পুরুষ মানুষ হতে। বৌ পেটালে বাহবা দেন। ছেলের সমস্ত অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন।
তবে কী করে সব মায়েদের মহান বলি?

সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা করন জোহর সিঙ্গেল বাবা হয়েছেন। উনি একজন নারীর গর্ভ ভাড়া করে নিজের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এখানে ওই নারী মোটেও মা হোননি। পুরোটাই ছিল বিজনেস, গিভ এন্ড টেক। এই একই পদ্ধতিতে বাবা হয়েছিলেন শাহরুখ খানও।

গর্ভে ভ্রুণ ধারণ করলেই সে মা হয় না। শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সন্তান লালন-পালন করলেই মা হয় না। একজন জন্মদাত্রী তখনই মা হয়ে ওঠে, যখন সে সন্তানের সঠিক লালন-পালন করেন।
একজন সন্তানকে সুস্থ এবং সঠিক মানুষ হবার শিক্ষা দেন। সন্তানের নৈতিকতা বিকাশে সহায়ক হোন এবং সন্তানকে হারতে নয়, মাথা নত করতে নয়, বরং হারকে হারানোর শিক্ষা দেন।

একজন নারী তখনই মা হোন, যখন তিনি তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। তার আগে তিনি কেবলই একজন জন্মদাত্রী। মা মানেই মহান নয়, জন্ম দিলেই কেউ মা হয়ে ওঠেন না। তাই মা মানেই মহান এই ধারণা মোটেও সঠিক নয়।

শেয়ার করুন: