দিহান, আনুশকাকে আমাদের মিডিয়াই তৈরি করেনি তো?

ফওজিয়া চৈতি:

সাম্প্রতিক আলোচনার ভাইরাল বিষয় আনুশকার মৃত্যু, দিহানের ধর্ষণ। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া দুই কিশোরের সমালোচিত কর্মকাণ্ড। যার ফলাফলস্বরূপ ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারালো কিশোরী মেয়েটি।

ধর্মে বলে কেয়ামতের আগে মানুষ ভীষণ রকম অসহিষ্ণু হয়ে যাবে, তুচ্ছ ঘটনায় একে অপরকে আঘাত করবে, ধৈর্য্য হারা হবে। কেয়ামতের আর কত দেরি আমি জানি না, তবে এসব বৈশিষ্ট্য এখনই মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। যা আমরা প্রমাণ পাই – ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নানা ঘটনায়, বরিশালের বিয়ে বাড়িতে মাংস নিয়ে মারামারিতে কনের চাচার মৃত্যু, মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় বলাৎকার, ধর্ষণের পর ধর্ষণের মত নানা রকম ঘটনায়।

এই বাংলাদেশে ধর্ষণ যেন এক খেলায় পরিণত হয়েছে। পুরুষশাসিত এই সমাজে এক দল বলছে – ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোষাক দায়ী, এক দল বলছে – বিধর্মীকে ধর্ষণ করা জায়েজ। আবার এক দল বলছে – নারী পুরুষের বন্ধুত্ব ধর্ষণের জন্য দায়ী।

একজন মেয়ে হিসেবে এগুলোর কোনটাই আমি মানতে রাজি নই। যদি পোশাক দায়ী হয় তাহলে পশ্চিমা বিশ্বে ধর্ষণের সংখ্যা কম কেন? যদি বিধর্মী মেয়েদের ধর্ষণ করা জায়েজ হয়, তাহলে তো সব মেয়েই অন্য ধর্মের পুরুষের কাছে খেলার পুতুল। আর নারী পুরুষের বন্ধুত্ব যদি ধর্ষণের জন্য দায়ী হয়ে থাকে তাহলে এই বন্ধুত্ব শুধু আজকাল হচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব এই বাংলায়৷ আমাদের বাপ চাচারা যারা ৬০-৭০ এর দশকে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তো তাদেরও আছে ছেলেমেয়ের মধ্যে মিষ্টি বন্ধুত্বের গল্প। কই তাদের যুগে তো ধর্ষণ শব্দটা এমন বহুলভাবে প্রচলিত ছিল না!

এক সাংবাদিক বন্ধু একবার গল্পের ছলে বলেছিল- “এই দেশের মানুষ ভালো নিউজ খায় না “। নাসায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বাংলাদেশী তরুণ এক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পেয়েছে, বা এক কিশোর আন্তর্জাতিক কোরআন তিলওয়াতে প্রথম হয়েছে, এসব নিউজের চেয়ে এই দেশে ভাইরাল হয় উচ্চ শিক্ষিত ছেলে বৃদ্ধ বাবাকে দেখে না বা তানজিনা তিশা সকালের নাস্তা কী করেন, এই ধরনের নিউজ। যার কারণে আমাদের মিডিয়াগুলোও বেশি ভিউয়ের আশায় – “কেন বিয়ের এতো বছর পরেও তিশা নিঃসন্তান?” এই ধরনের নিউজের পিছনে ঘুরে বেশি।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মুভি /নাটক/ টেলিফিল্ম অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম সব বয়সী মানুষের জন্য। শুধু বিনোদন না, এই বিনোদন নিতে নিতে অনেক কিছু শিখে মানুষ। আর আজ কাল আমাদের মিডিয়ায় বিনোদনের নামে শুধু নোংরামি, কুটনামিই দেখানো হয়। আর এসব কুটনামিতে ভারতীয় সিরিয়ালগুলো সেরা।

একটা ঘটনা শেয়ার করি – তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি। প্রথম সিনেমা হলে গিয়েছি নিজের ও প্রতিবেশীর পরিবারসহ সিনেমা দেখতে। মুভির নাম – শ্রাবণ মেঘের দিন। মুভির মধ্য বিরতিতে শুরু হলো মুনমুন/ময়ুরীর অশ্লীল নাচ/ডায়ালগসহ বিজ্ঞাপন। যা বাবা মা, ভাইয়ের সামনে দেখা ছিল খুবই বিব্রতকর ব্যাপার। এখনো মনে আছে, পরের দিন স্কুলে গিয়ে যতটা না “শ্রাবণ মেঘের দিন” মুভি নিয়ে আলোচনা করেছি, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি আলোচনা করেছি সেই অশ্লীল বিজ্ঞাপন নিয়ে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের বরাবরই প্রবল আকর্ষণ থাকে।

এখনকার নাটকগুলোতে বাকেরভাই মুনা’র মতো বিশুদ্ধ প্রেম দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা ভাঁড়ামী ছাড়া কিছুই না। এমনি মানুষ এখন জীবনমানের কারণেই হোক, আর পারিপার্শ্বিক কারণেই হোক, অনেক অস্থিরতায় থাকে। তার উপর এই ধরনের নেতিবাচক বিনোদন মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে বিস্তার।

কিছুদিন আগে নিউজে পড়লাম বিস্ময় বালক কৌশিক (ছদ্মনাম) এর ঘটনা৷  ১৬ বছরের বালকটি ধরা খেয়েছে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে। সে তার স্টেটমেন্টে স্পষ্ট বলেছে,  “ধুম ৩” মুভিটা সে ১৫৩ বার দেখেছে এবং ইন্সপায়ার হয়েছে ব্যাংক ডাকাতির মতো এডভেঞ্চারে। ভাবতে পারছেন বাচ্চাগুলো এই বিনোদন থেকে কত কিছু শেখার চেষ্টা করে? আর তারা কী শিখছে!!

প্রতিটি এলাকায় ডিশ লাইনের নিজেস্ব কিছু চ্যানেল আছে। সেসব চ্যানেল তো পরিবারের সামনে দেওয়াই যায় না। সেসব চ্যানেলে সারাক্ষণ চলতে থাকে যৌনশক্তি বাড়ানোর, যৌন অঙ্গ বড় করার নানা রকম রসালো বিজ্ঞাপন। মনে হয় বাংলাদেশের সব ছেলে যৌনতায় অক্ষম। এবং এর দায়ভার তারা নিয়ে রেখেছে। রাস্তা ঘাটে অনেক বাচ্চাছেলেদের দেখেছি সেসব বিজ্ঞাপনের ডায়ালগ নিয়ে হাসাহাসি করতে।

সাম্প্রতিক সময়ে “ফ্যামিলি ক্রাইসিস” নামে একটি নাটক এনটিভিতে দেখায়। নাটকটির কন্সেপ্টটি বেশ ভালো লেগেছে। যখন অন্যান্য নাটকে ননদ ভাবীর প্যাচপ্যাচানী, বউ শাশুড়ির লড়াই ইত্যাদি ইত্যাদি নোংরামি দেখাতে ব্যস্ত, সেখানে এই নাটকটি একটু ব্যতিক্রম। পরিবারের হাজার সমস্যার মাঝেও যে সকলের সাথে ভালভাবে মিলে মিশে থাকা যায়, তাই এখানে দেখানো হয়েছে। যদিও এখানেও পুরুষতান্ত্রিকতা ছাড়তে পারেনি পরিচালক।

এখনকার বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোতে অশ্লীল ধর্ষণের চিত্র না দেখালে যেন সিনেমাই জমে না। সেখানে দেখানো হয় ধর্ষণে কত আনন্দ পায় ধর্ষক। তার সেই হাসি। এই ধরনের অসুস্থ বিনোদনে বাচ্চাদের বড় করে আমরা কীভাবে আশা করি একটি ভালো প্রজন্মের? তবে কিছু কিছু ভালো মুভি অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু তার সংখ্যাটা খুব কম। যা সচরাচর টিভিতে দেখানোও হয় না। সুতরাং বেশিরভাগ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।

ইন্ডিয়ার বিভিন্ন নিউজে দেখা যায় ক্রাইম পেট্রোল দেখে তারা খুনের পরিকল্পনা ঠিক করেছে। কী ভয়ানক ভাবতে পারছেন?

দিহান ও আনুশকা কী দেখে ফরেন বডির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ ছেলেমেয়ের ইন্টারনেট ব্যবহারেও সতর্ক হওয়া উচিত মা-বাবার। যদিও এটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুতরাং প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে না চিল্লায়ে কীভাবে কিছুটা সুস্থ করা যায় নিজ নিজ জায়গা থেকে তা ভাবা উচিত। এর এক বিশাল দায়িত্ব গিয়ে পড়ে আমাদের মিডিয়ার, বিনোদন সৃষ্টিশীলদের। যারা এখানে এসে চিল্লাবেন ইসলামী অনুশাসন কামিল হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, তাদের বলবো – সৌদি আরবে তো ইসলামী অনুশাসন চলে। ওখানের অবস্থা এতো খারাপ কেন? তাহলে ধরে নিতে হয় – হয় তারা মানে না, বা মানলে ভুল পথে মানে। তো সঠিক ইসলামী অনুশাসন জানা আছে তো আপনার? মনে হয় না। জানা থাকলে এত বলাৎকারের ঘটনা প্রতিদিন শুনতে হতো না।

একটা সুন্দর, সুস্থ প্রজন্ম, দেশ সবার কাম্য। তাই সকলের উচিত নেগেটিভটা নয়, পজিটিভ কিছু প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা।

(লেখকঃ ফওজিয়া চৈতি, উদ্যোক্তা)

শেয়ার করুন: