রবীন্দ্র উপন্যাসে নারীর অধিকার চেতনা

লীনা দিলরুবা:

কেবল কবিত্ব বা সাহিত্য প্রতিভার বিচারেই নয়, মানবতাবাদী হিসেবেও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ংপ্রভ এক জ্যোতিষ্কের মতো উজ্জ্বল। সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে তিনি বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। গল্প-উপন্যাস, কবিতা আর নাটকে নারীর অধিকার চেতনাকে তিনি তুলে ধরেছেন অনমনীয় দৃঢ়তায়; তাঁর উপন্যাসে নারী অধিকারের প্রসঙ্গটি এসেছে বারবার, নানা রূপ ও ভঙ্গিমায়।

ড. শাহীদা রহমানের ‘রবীন্দ্র উপন্যাসে নারীর অধিকার চেতনা’ বইটির প্রতিপাদ্যও তাই। উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘নারীর একমাত্র ও পরমার্থ লক্ষ্য যে মাতৃত্বে নয়, মনুষ্যত্বে’- তার প্রথম উচ্চারণ রবীন্দ্রনাথের নায়িকাদের মুখেই শোনা যায়। নারী মা ও স্ত্রী ঠিকই, কিন্তু সর্বপ্রথমে সে স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তি।’ বইটির সাতটি অধ্যায়ে রবীন্দ্র উপন্যাসে নারী চরিত্রসমূহের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের এই বক্তব্যকেই মূলত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন লেখক। বইয়ের সাতটি অধ্যায় হচ্ছে: ‘তৎকালীন হিন্দু সমাজে নারীদের স্থান’, ‘রবীন্দ্রমানসে নারী’, ‘গবেষণায় বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে’, ‘রবীন্দ্র উপন্যাসে বিধবা নারী’, ‘রবীন্দ্র উপন্যাসে সধবা চরিত্র’, ‘রবীন্দ্র উপন্যাসে কুমারী নারী’ ও ‘রবীন্দ্র উপন্যাসে অপেক্ষাকৃত অপ্রধান নারীচরিত্র’।

লেখক মূলত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কুসংস্কার ও পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী রূপের মুখে নারীর অবিচল অগ্রযাত্রা, আত্মসম্মানবোধ ও সাহসিকতাকেই বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। কুমুদিনী, বিমলা, এলা, লাবণ্য, সুচরিতা, দামিনী ইত্যাদি নারীর চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, এদের মাধ্যমে আসলে নারী তথা মানবশক্তির জয়গানই গেয়েছেন মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকটি নারী চরিত্রের পরিণতি নিয়ে আপোষ করতে হলেও নারীর আত্মশক্তি বিকাশের সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের সংগ্রাম দৃঢ় ও অনমনীয়। এ প্রসঙ্গটি বারবার তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথকে প্রশংসার অর্ঘ্যে সিক্ত করেছেন লেখক।

রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি উপন্যাসে নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে আধুনিক সমাজ বাস্তবতায় নারীর অবস্থান এবং নারী-পুরুষের চিরন্তন দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যাবতীয় প্রতিকূলতার মুখেও অবিচল ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দামিনী কিংবা সর্বনাশের অতল গহ্বর থেকে আত্মশক্তির বলে উঠে আসা বিমলা, এরা কেউই পুরুষতন্ত্রের অসহায় শিকার হতে রাজি নয়, শত উত্থান-পতনেও তাদের মধ্যে অধিকার আদায়ের প্রেরণা খুঁজে পায় সর্বকালের সর্বযুগের নারী।

‘আমি আগুনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছি; যা পোড়বার ছিল তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যা বাকি আছে তার আর মরণ নেই’ – ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিমলার এই উক্তি তার মত আরো অনেক সংগ্রামী নারীরই মনের কথা। রবীন্দ্রনাথের পূর্বতন বা সমসাময়িক তো বটেই, একুশ শতকের অনেক কথাশিল্পীও নারী অধিকারের সদম্ভ ঘোষণায়
রবীন্দ্রনাথের মত নিঃসংকোচ হতে পারেননি।

ড. শাহীদা রহমানের গদ্য স্বাদু ও নির্ভার। তবে যেহেতু পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে সেহেতু সবসময় একাডেমিক বাঁধুনির অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেনি এটি। এ কারণে অনেক জায়গাতেই লেখকের উচ্চারণ কিছুটা আঁটোসাটো, কখনও বা বৃত্তাবদ্ধ। কোথাও কোথাও ভাষা বেশ এলায়িত, মনে হয় গবেষকসুলভ শৃঙ্খলাবোধে কোথাও যেন চিড় ধরেছে। আর এ কারণেই ‘সবগুলোর শিল্পবোধ নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ’ (বইয়ের ফ্ল্যাপের বর্ণনা) বা ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কালের তুলনায় অনেক বেশি প্রাগ্রসর (পৃ. ২০০)’-এর মত অসতর্ক বাক্যগঠনও চোখে পড়ে।

সূচিপত্রে ‘উল্লেখপঞ্জি’কে কেন ‘উল্লেখঞ্জি’ বলা হল তা নিয়েও ভাবনায় পড়বেন কোনো কোনো পাঠক। তবে এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাহিত্য স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে এ বই যথেষ্ট সফল। কেবল সাহিত্যিক বা ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ নয়, মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বুঝতেও এ বই আমাদের সাহায্য করবে।

লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ফেনীতে। লেখালেখির শুরু দৈনিক পত্রিকায়। মূলত গ্রন্থ সমালোচনা করেন। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা এবং জীবন তাঁর আগ্রহের জায়গা। গবেষণা করছেন, তাঁর কবিতা নিয়ে। প্রায় দু্ই দশক ধরে চাকুরী করছেন, আর্থিক খাতে।

শেয়ার করুন: