টক্সিক রিলেশন বনাম ভালবাসা

তাসনুভা তাজিন (ইভা):

ভালোবাসা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, “পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।”
এ রকম জীবনমুখী উক্তি শুনতে আর জীবনের সাথে মেলাতে ভালোই লাগে। কিছুক্ষেত্রে এতোই ভালো লাগে যে মনে হয় এটাই সর্বজনীন সত্য। ভালোবাসার অত্যাচার সহ্য করে নিতে হয়, এর বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না, এই দর্শনে যারা বিশ্বাসী তাদের অনেকে ভালোবাসার অত্যাচার সহ্য করতে করতে কখন যে মনের অজান্তে ভালোবাসার মানুষের অত্যাচারও সহ্য করে নিতে শুরু করে বুঝতেই পারে না।

জীবনে প্রথম যে পুরুষের সংস্পর্শে এসে মনে হয়েছিলো এটাই ভালোবাসা, সে এখন আমার চেয়ে আক্ষরিক অর্থেই সাড়ে তেরো হাজার কিলোমিটার দূরে। একসাথে থাকতে থাকতে দুজনের মধ্যকার ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছিল, এই সাধারণ কারণে আলাদা হয়ে যায় অনেক জুটি। আমাদের কারণটা আরও সাধারণ ছিলো; দু’জন একসাথে ভালো থাকতে পারছিলাম না। আমি যেভাবে বড় হয়েছি, আমার জ্ঞান, বুদ্ধি সবকিছু ছিলো তাঁর বেড়ে ওঠার ধরন থেকে আলাদা। দুজনের ভালোবাসার ধরন ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই ভালোবেসেও আলাদা হয়ে যাই। শেষবার যখন কথা হয় তখনও সিনেমার মতো দু’জন দু’জনকে ভালো থাকার আশীর্বাদ করেছিলাম। প্রেম একটা গেলে আরেকটা আসবে না ভেবে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার জন্য বেশ কয়েকবার আলাপে বসার চেষ্টা করেছিলাম। শেষমেশ একসাথে অসুখী থাকার চেয়ে আলাদা হয়ে মানসিক শান্তির দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম। যখন নিজের ভালোবাসার উপরে স্থান দিয়েছিলাম সম্মান, মানসিক শান্তি এসবকে, তখন কিন্তু ভাবিনি আমাকে আমার মত করে ভালোবাসবে, এমন একজনকে পেয়ে যাবো। এসব সান্ত্বনা টিনএজারদের মানায় হয়তো। যেই বয়সে ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে আসছিলাম, তখন জানতাম নিজের ভালো থাকার জন্য উপযুক্ত কারো সাথে চলার চেয়ে বেশি জরুরি অনুপযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারা, আর তাদের কাছ থেকে দূরে থাকা। আমার কাছে বিষয়টা সংখ্যারেখায় শূন্যতে থাকার মতো স্থির অবস্থা। উপযুক্ত কারও সাথে জীবনটা ধনাত্মকের দিকে উত্তেজনাকর হতে পারে, আর ভুল কারো সাথে ঋণাত্মকের দিকে উত্তেজনাকর।

টক্সিক, এব্যুসিভ শব্দগুলো ইদানিংকার বেশ পরিচিত শব্দ। প্রায়ই শোনা যায়, টক্সিক বা বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে সরে আসা উচিত। বিষ যেমন ধীরে ধীরে আপনাকে শারীরিকভাবে মেরে ফেলে,টক্সিক বা বিষাক্ত সম্পর্ক তেমনি ধীরে ধীরে আপনাকে মানসিকভাবে মেরে ফেলে। এখন কেউ যদি “আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান” এ বিশ্বাসী হোন,এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এক মিনিট! এটা কি আসলেই তার ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে? আপনার স্বামী অনেক বেশি রেগে গিয়ে আপনার গায়ে হাত তুললো,আপনি এটা মেনে নিলেন কারণ ভালো যেহেতু বাসে, রাগের মাথায় করা এসব একটু আকটু মেনে নেয়াই যায়। আপনার সন্তান মানসিক চাপে থাকলে আপনাকে গালাগাল করে, আপনি এও মেনে নিলেন; কারণ ভালোবাসা। আপনার মা জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও মানসিক শান্তি পান নি,এই ফ্রাস্ট্রেশন তিনি তোলেন আপনাকে এবং আপনার সহোদর কিংবা বন্ধুকে ছোট করে। আপনি এটাও মেনে নিলেন,কারণ ভালোবাসা (এটা তো আরেকটা পয়েন্ট পায়;আফটারঅল তিনি মা)। এগুলো ব্যাক্তিগত বিষপান হতে পারতো। কিন্তু আপনি স্বামীর এব্যুসিভ আচরণ মেনে নেন বলে অন্য একজন নারী এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না; তাকে আদর্শ স্ত্রীর উদাহরণ দেয়া হয় আপনার কথা বলে। আপনার সন্তানের সহিংসতা মেনে নেয়াটাও আপনার ব্যক্তিগত (কিংবা পারিবারিক) ব্যাপার হওয়ার কথা। কিন্তু সহিংস আচরণে লাই পেয়ে আপনার সন্তান সমাজের জন্য ক্ষতিকর হলে বিষটা কিন্তু আপনিই ঢেলে দিচ্ছেন সমাজের বাকি মানুষগুলোর জীবনে। আপনার পূজনীয় মাতা যখন আপনার বন্ধুকে ছোট করে, তখন তার উপরে পড়া মানসিক চাপের ভার কিন্তু আপনি নিচ্ছেন না। আর আপনার মা কখনো অনুধাবনই করছেন না সন্তান বা সন্তান তুল্য এসব প্রাণী একেকটা ব্যক্তি; ইনডিভিজুয়াল মানুষ। এভাবে টক্সিক পরিবারকে “আফটারঅল পরিবার” বলে বুকে আগলে রাখার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে আপনি নিজে মানসিকভাবে মরছেন তো মরছেন,সাথে মেরে ফেলছেন সেই সব মানুষের উদ্যমকেও যারা ভালোবাসার দোহাই দিয়ে করা এসব অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে চায়।

টক্সিক মানে কিন্তু খালি চোখে দেখা অত্যাচার নয়। বিষ যেমন খালি চোখে দেখে বোঝা যায় না এটা প্রাণঘাতী, টক্সিক মানুষগুলোও তাই। এরা আপনাকে ভালোবাসবে। আপনি যখন ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে যাবেন, এরা আপনাকে আঘাত করবে। আঘাত পেতে পেতে আপনি যখন বুঝবেন এইখান থেকে বের হতে হবে,এরা আবার আপনাকে গভীর ভালোবাসায় আটকাবে। এভাবে চলতে থাকবে। আপনি কখনোই মানসিক শান্তিতে এসে স্থির হতে পারবেন না। এরা আঘাত করে যাবে আর স্যরি বলে যাবে। এর জন্যে কে দায়ী জানেন? আপনি। আপনার যে জেনেশুনে বিষকে অমৃতের গ্লাসে ঢেলে পান করার সাধ জেগেছে। আপনি ওতেই স্বাদ পেলে আমার আপত্তি থাকার কোনো কারণ ছিলো না। কিন্তু ঐ যে বললাম…আপনি এই সংস্কৃতিকে আগলে আছেন বলে আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে আমাকেও। বলছি না ছেড়ে দিন মানুষটাকে। আমিও চেষ্টা করেছিলাম প্রেমিকের সাথে পুনরাবৃত্তি হওয়া সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে; কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কীভাবে বন্ধ করা যায় কিংবা আদৌ বন্ধ করা যায় কিনা। বন্ধ করা যায়নি। তাই নিজেকে অক্ষত রাখতে নিরাপদ দূরত্বে সরে এসচি।

টক্সিক প্রেমিক/প্রেমিকার ক্ষেত্রে আজকালকার বন্ধুবান্ধব বলে ছেড়ে দে, নিজের মানসিক সুস্থতা আগে। অথচ সেই প্রেমিককেই বিয়ে করে ফেলার পরে টক্সিক আচরণ টের পেলে তখন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন বলে ‘আফটারঅল স্বামী তো, মানিয়ে নে’। স্বামী যখন অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে যায় তখন কখনো কখনো বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন ডিভোর্সকে সমর্থন করে ইদানীং।

কিন্তু ভাবুন,আপনি যদি বলেন, “আমার মা আমাকে মানসিক অত্যাচার করে,আমি চেষ্টা করেছি মা’কে বোঝানোর,কিন্তু তিনি বুঝতে রাজি নন”, তখন আপনাকে সবাই টনিক দিবে যে বাবা-মা সন্তানের ভালো চায়,যা করে সন্তানের ভালোর জন্যই করে, তুমি ভুল বুঝছো, নিজে মা হলে বুঝবে, আরো কত কী! টক্সিক প্রেমিক, বন্ধুবান্ধবের সাথে আমরা দিনের কিছুটা সময় থাকি। আর পরিবারে আমরা দিনশেষে ফিরে যাই শান্তির জন্য। অথচ দেখুন, সবচেয়ে বেশি যেখানে শান্তির নিশ্চয়তা দরকার, সেখানের টক্সিসিটিকে আমরা আমলেই নিতে চাই না। কারণ হুমায়ূন আহমেদ এর মত জনপ্রিয় লেখকও এসব টক্সিসিটি আগলে রাখা সংস্কৃতিকে উসকে দেন বিভিন্ন লেখায় উক্তির মতো এসব কথা ঢুকিয়ে দিয়ে,
“পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.