আপনার সন্তানকে সেক্স সম্পর্কে জানান

প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:

যৌনতা কী? এটি একটা স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া। আমাদের সমাজ কিংবা পরিবার কিংবা ধর্ম ব্যাপারটার উপর এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে যে এটা নিয়ে কথা বলাও মহাপাপ। সামান্য একটা “বৃষ্টিতে ভিজে চুমুর” ছবির জন্য হেয় প্রতিপন্ন করা হয় আমাদের দেশে। ভাবখানা এমন যেন ছবিটা দেখেই সবার চেতনাদণ্ড দাঁড়িয়ে গেছে!! অথচ চুমুটা কিন্তু ক্ষেত্রভেদে আদরের বহিঃপ্রকাশ। তেমনি সেক্সও একটা খুব স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া, যেটাকে অবদমন করে শরীর এবং মনকে কষ্ট দেয়া হয়।

আমার যখন প্রথম পিরিয়ড হয়, আমার কাজিন আমাকে বলেছিলো “খবরদার, কোন ছেলে যেন তোকে টাচ না করে, তাহলে কিন্তু তুই প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবি”। সেক্স সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না! কী পরিমাণ মানসিক টর্চারের মধ্য দিয়ে যেত পিরিয়ডের সেই সাতটা দিন, বলে বোঝানো সম্ভব না। কারণ হলো পিরিয়ড বা সেক্স নিয়ে খোলামেলা আলোচনার অভাব। বাংলাদেশে বিশেষ করে সেক্স নিয়ে সামনাসামনি আলোচনার সময় এসেছে। আজকালকার বাচ্চারা ইউটিউবের কল্যাণে অনেক ছোট বয়সেই সেক্স সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু সেটা একদমই গোপনে। রাতের বেলায় সবাই ঘুমালে কিংবা কানে হেডফোন গুজে লুকিয়ে লুকিয়ে। এতো গোপনীয়তা কেন বা কীসের জন্য? যদি বড়রা বা মুরুব্বিদের কেউ ব্যাপারটা জানতে পারে বা দেখতে পায় তাহলে তার গুষ্টি উদ্ধার হয়ে যায়। কিন্তু এটা তো ভাত খাবার মতই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটার অনুপস্থিতিই বরং বাস্তবে আপনাকে, আমাকে কষ্ট দিবে।

ক্লাস নাইনে পড়াকালীন বায়োলজিতে একটা চ্যাপ্টার ছিলো, সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়ার পেছনে কে দায়ী? ক্লাস করার সময় কম্বাইন্ড ক্লাসে ছেলেমেয়েদের হাসাহাসির চোটে স্যার বা ম্যাডামের ক্লাস নিতে সমস্যা হয়ে যেত। অনেক ছেলেদের দেখেছি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বই লুকিয়ে দেখতে। সেখানে পিড়িয়ডের এর একটা চ্যাপ্টার ছিলো। এগুলো সবই তো সতর্কতার জন্য। নিরাপদ স্বাস্থ্যের জন্য। তাহলে সেক্স নিয়ে ওপেন আলোচনা কেন হয় না? এটাও শারীরিক স্বাস্থ্যের আওতাভুক্ত। একটা ছেলে বা মেয়ের মোটামুটি ১৪/১৫ বছর হওয়ার সাথে সাথেই তার শারীরিক চাহিদা শুরু হয়ে যায়। এটা নিয়ে যদি সরাসরি কিশোর বা কিশোরীদের সাথে কথা বলা হয় বা জানানো হয়, তাহলে কিন্তু এই যে ফ্যান্টাসি তৈরি হচ্ছে বাচ্চাদের মনে, এটা হতো না।

বাচ্চারা ইউটিউব বা গোপনে শুনে বা ভুল জেনে তাদের মনে একটা কল্পনার রাজ্য তৈরি করছে, আর সেখান থেকেই বিভিন্ন অপরাধের জন্ম হয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজকাল অনলাইনে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে রিলেশন হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী-পুরুষ সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড। মুখে কেউ টুঁ শব্দটি করবে না। এরাই সেক্স চ্যাট বা সেক্স কলের মতো নোংরা কাজ করে। বিকৃত মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে আক্রান্ত হচ্ছে ছোট শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা পর্যন্ত।

টাকা পয়সা উপার্জনের জন্য যেমন অনেকেই শর্টকাট পথ বেছে নেয়, তেমনি শারীরিক প্রয়োজন মিটানোর জন্যই বর্তমানে এতো বেশি রেপ কেসের ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মূল্যবোধ এর ঘাটতি তো আছেই। এই শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহাল থাকে পতিতালয়, থাকে পরকীয়া সম্পর্ক। সমাজ কিংবা পরিবার ভাবছে, একটা মেয়ে বা ছেলের সমস্ত সম্মানটাই নির্ভর করছে সে বিয়ের আগে সেক্স করেছে কিনা! বিয়ের পরে যদি জানতে পারে স্বামী বা স্ত্রীর কারও সেক্স বিষয়ক সমস্যা আছে, তাহলে উপায় কী? মেয়ের প্রব্লেম থাকলে তো স্বামী আরেকটা বিয়ে করে ফেলে, যদি স্বামীর থাকে সমস্যা, তবে? সেক্স বিষয়ক প্রবলেম থাকতেই পারে, এটাও স্বাভাবিক অন্যান্য শারীরিক সমস্যার মতোই, সেটা তো ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট এর মতোই ট্রিটমেন্ট করা যায়। মারণব্যাধির সাথে লড়াই করতে রাজী, তাও সেক্স নিয়ে কারও সাথে কথা বলবে না। ডাক্তারের কাছে তো যাবেই না। বউ বা বর কারো সেক্স এর সমস্যা হচ্ছে, ডাক্তারের কাছে গেলে মান সম্মান নষ্ট হবে, কিন্তু পরকীয়া করতে গিয়ে কত দুর্ঘটনা ঘটছে, বা কত অপরাধই না হচ্ছে! এমনকি নিজের স্ত্রী বা বরের সাথেও কথা বলে না এ ব্যাপারে। এমনি কেউ জোরে সেক্স শব্দটাও উচ্চারণ করে না!

“Prevention is better than cure” প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আর এই সামাজিক ব্যাধি থেকে উত্তরণের একটাই উপায়, সেক্স নিয়ে কথা বলুন। যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমাদের দেশে একটা ছেলে স্টাব্লিশ হয়ে বিয়ে করতে করতে বয়স প্রায় ৩০ এর কোঠায় চলে যায়। আর মেয়েদের এতো অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা বুঝতেই পারে না যে মেয়েদেরও তৃপ্ত হওয়ার ব্যাপার আছে। একটা ছেলে ১৪ থেকে ৩০ এই বয়সটা কীভাবে সেক্সুয়ালি হ্যাপি থাকবে, বলেন তো? এছাড়াও আমদের দেশের অনেক পুরুষ প্রবাসী হিসেবে দেশের বাইরে কর্মরত আছেন। তারা বিয়ে করে বউ দেশে বাপ মা সেবা করার জন্য রেখে যান। কেউ কেউ আবার প্রেগন্যান্টও হয়ে যায় বিয়ের দুই বা এক মাসের মধ্যে। তারপর সেই বউ বা মেয়েটার যৌনতা সম্পর্কে কেউ খোঁজ রাখে না। তার উপর সেই মেয়ে বা বউকে পাড়াপ্রতিবেশির বিরক্ত করা তো আছেই।

আচ্ছা ওই বউটার শারীরিক চাহিদা কীভাবে মিটবে, বলেন তো? আর ওই যে পুরুষটা, যিনি কিনা বিয়ে করেই বিদেশে চলে গেছেন, তারই বা কী হবে? বিবাহবহির্ভুত সেক্স তো সমাজ মানবে না। আবার পতিতালয়ে গেলেও সমাজ ছিঃ ছিঃ করবে। আবার এই সমাজই ছেলেদের সোকল্ড স্টাব্লিশ না হওয়া পর্যন্ত বিয়েও করতে দিবে না। তাহলে ছেলেটা তার স্বাভাবিক যৌন চাহিদাটা মেটাবে কীভাবে? এসব কারণে ছেলেমেয়েরা পর্নের উপর আসক্ত হয়ে পড়ে। আর জড়িয়ে পরে কোন ঘৃণ্য অপরাধে। ফলস্বরূপ ধর্ষণ বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। আগেও ছিল ধর্ষণ। তবে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সংখ্যাও বাড়ছে ঊর্ধ্বগতিতে।

আর সেক্স নিয়ে এরকম রাখঢাকের কারণে এদেশের অধিকাংশই জানে না এটা ভীষণ সুখকর একটা অনুভূতি, যেটা কিনা শুধুমাত্র দু’জনের সম্মতিতেই পাওয়া সম্ভব। এখনও আমাদের সমাজ ভার্জিন মেয়ে খোঁজে বিয়ের জন্য। যাদের কাছে ভার্জিনিটি শুধুমাত্র দু’পায়ের মাঝে একটা পর্দার উপর নির্ভর করে। এখনও সমাজের অধিকাংশ মানুষ জানেনই না যে ভার্জিনিটির উক্ত পর্দাটি যৌন কর্ম করা ছাড়াও অনেক কারণেই ছিঁড়তে পারে। ওই যে বলে না, “বাঁচতে হলে জানতে হবে। জানুন এবং জানান”। আপনার সন্তানকে এখন থেকেই “সেক্স” সম্পর্কে জানান, কথা বলুন। কথা বলার বিকল্প নেই এই অমানিশা থেকে বের হওয়ার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.