‘ধর্মীয় মৌলবাদ: নারীর প্রতি সহিংসতার ভিত্তি মূল’

কাজী তামান্না কেয়া:

আজকাল বাংলাদেশে ধর্ষণ অতি সাধারণ ঘটনা। এখানে দুই মাস বয়সী নবজাতক থেকে ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হয়। তাতেও যেন মুক্তি নেই নারীদের। গ্যাং রেইপ, রেইপের পর শারীরিক অত্যাচার, রেইপের পর হত্যা, মৃতদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করাসহ অসংখ্য অমানবিক আচরন আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত ৮ মাসে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১৯২ জনকে গণধর্ষণ, ৪১ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং আরো ১৬২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এই সংখ্যাগুলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার সংখ্যা এবং আমরা জানি, নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশী।

আজকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যে নারীকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী অমানবিক অত্যাচারের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তা কিন্তু আরো এক মাস আগের ঘটনা। এই ভয়ংকর ঘটনাটি স্থানীয় নেতাদের হাত ধরে এবং পুলিশি তৎপরতার অভাবে লোকচক্ষুর বাইরে চলে যাচ্ছিল। আরো অসংখ্য ধর্ষণের মতো এই ঘটনাটাও লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যেতো এর ভিডিও না থাকলে বা ফেইসবুক পোস্ট এ না এলে। তাই ধর্ষণের সংখ্যা নয়, এর স্বরূপ এবং পেছনের কারণগুলো দেখতে হবে।

এই আচরণগুলোর পেছনের কারণগুলো কী, শুধুই কি বিচারহীনতার কারণে একটা সমাজ এতোটা অমানবিক হতে পারে? দুর্ঘটনা ঘটার সময় স্থানীয়রা এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না কেন? সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সামনে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় বাবলা চৌধুরী নামে একজন আওয়ামীলীগ এগিয়ে আসেন এবং তার ততপরতায় অপরাধীরা দ্রুততম সময়ে ধরা পড়ে। আজকাল যেভাবে বাসে ধর্ষণ, নিজের বাড়িতে ধর্ষণ, স্কুল কলেজে যাতায়াতের পথে ধর্ষণ হচ্ছে, সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এইসব ধর্ষণের ঘটনা অনেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব। একটা ধর্ষণ যখন সংঘটিত হয়, তখন নারীটির আর্ত-চিৎকার শুনে কেউ এগিয়ে আসছে না কেন, ধর্ষণ রোধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না কেন? আসুন, ধর্ষণ সমস্যা মারাত্মক হয়ে উঠার আগে নোয়াখালীসহ বাংলাদেশের আরও কিছু অঞ্চলে সামাজিক সমস্যার সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না উঠার আরেকটি বাস্তব এবং অমানবিক দিক দেখে আসি।

সামাজিক সমস্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণগুলি একদিনে আজকের অবস্থায় আসেনি। মৌলবাদ গোষ্ঠী ধীরে ধীরে সমাজকে নিপীড়ন এবং অত্যাচার মেনে নিতে অভ্যস্ত করেছে। একটা উদাহরণ দেই। বিগত বেশ অনেক বছর ধরে নোয়াখালী অঞ্চলে রোজার দিনে খাবারের দোকান খোলা রাখলে দোকানিকে হুমকি দিয়ে, পিটিয়ে সেগুলো বন্ধ করাতো স্থানীয় মৌলাবাদ গোষ্ঠী। অথচ আমরা যুগ যুগ ধরে দেখে এসেছি খাবারের দোকান কাপড় দিয়ে একটু আড়াল করে রোজার পবিত্রতা রক্ষা করতে। এতে যে রোজা রাখছে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না, আর যে রোজা রাখেনি, সে প্রয়োজনীয় খাবার এবং পানিটুকু কিনতে পারছিল।
বর্তমান সময়ে নোয়াখালী, ফেনী এবং ধর্মীয় সন্ত্রাস জেঁকে বসা অঞ্চলগুলোতে আপনি রোজার দিনে কোন খাবারের দোকান খোলা পাবেন না। এতে কি শুধু হোটেল মালিক এবং কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? স্থানীয়দের সমস্যা হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে, কিন্তু তারা মৌলাবাদীদের এই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন, সমাজ এবং সাধারণ মানুষ এই ‘ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষার নামে সন্ত্রাস’কে মেনে নিয়েছে। এ কারণেই নুসরাতকে হত্যা করতে এগিয়ে এসেছিল তার সহপাঠীরা এবং তাদের মধ্যে একজন গর্ভবতী মেয়েও ছিল। আজকের ভিডিওর নারীটি যখন চিৎকার করছিল, আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসেনি, কারণ তারা এই মধ্যযুগীয় অত্যাচারকে সামাজিকভাবে মেনে নিতে শিখে গেছে। এই রকম শত শত অমানবিক এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা উল্লেখ করা যায় যেখানে আপনি সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পাবেন। আরো দেখবেন তুচ্ছ কারণে যেমন মোবাইল চুরির অপবাদ, খাবার বা অন্য যে কোন বস্তু চুরি করার অপবাদে শত শত নির্বাক নারী পুরুষের সামনে নির্যাতন করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে, অথচ কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না।

এইসব সন্ত্রাসের সাথে মৌলবাদ এবিং মধ্যযুগীয় বর্বরতার যোগাযোগ আছে। আমাদের দেশের বহু সংখ্যক প্রবাসী দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করছেন। তারা রেমিটেন্সের সাথে সাথে আরো নিয়ে আসছেন নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণ। নব্বই এর দশক থেকে বিদেশী শক্তির অর্থায়নে অসংখ্য কওমী মাদ্রাসা তৈরি করা হয়েছে। এসব মাদ্রাসা থেকে লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রী নারীর প্রতি সহিংস আচরণকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়ার শিক্ষা পাচ্ছে। ইসলামে নারীর গায়ে হাত তোলার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব ধর্মীয় শিক্ষা নারী শিক্ষায়নে বাধা দেওয়া, নারীকে বাইরে বের হতে না হওয়া, নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ায় বাধা প্রদানসহ আরও অসংখ্য পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় নিয়মের বেড়াজালে নারীকে আবদ্ধ করে রাখছে। আমাদের সেইসব সমস্যাগুলির দিকে তাকাতে হবে। ধর্ষণ যেমন একদিনে বাড়েনি, একদিনে কমেও যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সমস্যার মূলে প্রবেশ করা না হবে।

নোয়াখালীসহ মৌলাবাদ আশীর্বাদপুষ্ট অঞ্চলে যখন ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, তখন সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি এদের সক্ষমতাকে ছোট করে দেখছিল। আজ সেইসব গোষ্ঠীর অপরাধ বাড়তে বাড়তে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, এরা যখন হায়েনার চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, তখন আপনারা প্রশ্ন করছেন, এরা ছাত্রলীগ না শিবির? হ্যাঁ, রাজনৈতিক শেল্টার ধরে এই সমস্যা সুলুক সন্ধান করা যেতে পারে, তাতে লাভ কিছু হবে না, কারণ সমস্যার মূল আরো গভীরে। অনেকেই বলেন ধর্ষকের ফাঁসি দিলে সমস্যার সমাধান হবে। আসলেই কি তাই? শুধু অপরাধীর বিচার করে একটা সমাজ থেকে অপরাধ মুছে ফেলা যায় না। এই সমস্যার সমাধানে বিচারের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা এবং মৌলবাদের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক পরিচিতিঃ
Kaji Tamanna Keya, MS, MPS
Doctoral candidate
Arnold School of Public Health
University of South Carolina, USA
Email: [email protected]

শেয়ার করুন: