পুরুষ শূন্য পৃথিবীতে ২৪ ঘণ্টা!

বৈশালী রহমান:

অবশেষে নারীদের প্রার্থনা শুনলেন ঈশ্বর। চব্বিশ ঘন্টার জন্য পুরুষমুক্ত হলো পৃথিবী।

জোহরা এই প্রথম ঘুম থেকে উঠলেন গায়ের ব্যথা ছাড়া। গতরাতে মাতাল বর্বর স্বামীটি, প্রতিরাতে রাতের খাবারের পাশাপাশি যার মারও হজম করতে হয় জোহরাকে, সে যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। আস্তে ধীরে তৈরি হয় জোহরা। ফাতেমা ম্যাডামের বাসায় কাজ করতে যেতে হবে। কাজ করতে গিয়ে আজকে বস্তির গলির মুখে অশ্লীল গালিগালাজ আর অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ সহ্য করতে হবে না, এটা ভাবতেই খুশিতে তার মন ভরে ওঠে।

আজ আরামে আছেন ফাতেমা বেগমও। স্ত্রীরোগে দীর্ঘদিন ধরে ভোগার কারণে সংগমে তীব্র যন্ত্রণা হয় তাঁর। গাইনোকলজিস্টের নিষেধও আছে এ ব্যাপারে। কিন্তু তাঁর “স্বামী” করিম সাহেব বিষয়টা মানতেই চান না। প্রতিরাতেই “স্বামীর হক” আদায়ের জন্য শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আজকে তিনি নেই। ফাতেমা বেগম আজ বহুদিন পর ঘুম থেকে উঠে শুধু নিজের জন্য এককাপ চা বানিয়ে খাবেন, টাটকা খবরের কাগজ পড়বেন। যে সুযোগ বিবাহিত জীবনের বিশ বছরের মধ্যে একবারও তাঁর হয়নি।

আজ ফাতেমা বেগমের ছোটো মেয়ে, দশ বছরের মিন্টি খুব আনন্দ করে খেলছে। সেও কেমন করে যেন বুঝে গেছে, আজ তার টিচার বাসায় আসবে না। পড়ানোর নাম করে তার কাপড়ের ভিতর হাত ঢুকিয়ে তাকে ব্যথা দেবে না। যে ব্যথার কথা সে লজ্জায়, ভয়ে নিজের মাকেও বলতে পারেনি।

ফাতেমা বেগমের বড়ো মেয়ে মিষ্টি আজ খুব নিশ্চিন্ত মনে পাবলিক বাসে উঠলো। উঠার সময় এই প্রথম তাকে কন্ডাকটরের নোংরা স্পর্শ সহ্য করতে হয়নি। বাসে উঠে “মহিলা সিট” লেখা দেখে সে হেসে ফেললো। আরে বাবা, এখন আর মহিলা সিটের দরকারটা কী। এখন তো সে দাঁড়িয়েই যেতে পারে। বাসে দাঁড়িয়ে থাকার সময় “হঠাৎ লেগে গেছে” অজুহাতে কেউ তো এখন তার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় বার বার হাত দেবে না!

তুলি আজকে প্রথম টুইশন থেকে রাত দশটায় নিশ্চিন্তে বাসায় ফিরবে। লোডশেডিং এর অন্ধকারে কয়েকজন পুরুষ তাকে আরও অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে দানবের মতো ছিন্নভিন্ন করবে এই ভয় আজ তার নেই। পরী আজকে জীবনে প্রথমবার বান্ধবীদের নিয়ে রাত তিনটায় রাস্তায় বসে চা খাবে। চা টা নাহয় তারা বাসা থেকেই বানিয়ে নিয়ে গেল।

জুঁই আজ প্রথমবার নিজের মেয়েকে নিয়ে মেলায় যাবে। ছোটবেলায় মেলার ভিড়ে দানবের দল তার কাপড় খুলে নিয়েছিল। শরীরে হাত দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মেয়েকে নিয়ে কখনো সে কোনো ভিড়ের মধ্যে যায়নি। কিন্তু আজ সে যাবে। আজ তার ভয় নেই।

প্রিয় পুরুষ, উপরের যে ঘটনাগুলো বললাম, সবই কাল্পনিক ঘটনা। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে মানুষ প্রজাতির কেউ শুধুমাত্র লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটা আমি কখনও চাই না। কারণ আমার খুব কাছের, খুব প্রিয়, খুব আপনজনেরা অনেকেই তো পুরুষ। চব্বিশ ঘন্টা কেন, চব্বিশ সেকেন্ডও তো আমি তাদের বিলুপ্তি চাইতে পারি না।

কিন্তু ভাবুন তো,কেন একটা মেয়ে চব্বিশ ঘন্টা পুরুষশূন্য পৃথিবী হোক এই কল্পনাও করতে চাইতে পারে? কেন নিজের বাপ, ভাই, ছেলে পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও অন্যের বাপ, ভাই, ছেলের কাছ থেকে আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়? গল্পের জোহরা, ফাতেমা, মিন্টি, তুলি, পরী, জুঁই এর সাথে যারা অত্যাচার করেছে, তারাও তো কারও বাপ, ভাই, সন্তান। পূজা নামের পাঁচ বছরের মেয়েটার যৌনাঙ্গ চিড়ে যে পুরুষ ধর্ষণ করেছিল, তার কাছাকাছি বয়সী একটি মেয়ে ছিল। আজ নোয়াখালিতে যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হলো, সেই ছেলেগুলোও কারও ভাই, কারও সন্তান। তাহলে কারও বাপ, ভাই, ছেলে হওয়াটা তাদের ধর্ষক হয়ে ওঠা আটকাতে পারলো না কেন?

অতএব হে পুরুষগণ, “চব্বিশ ঘন্টার জন্য পৃথিবী পুরুষশূন্য হলে কী হবে” এই জাতীয় কাল্পনিক আলাপেই উত্তেজিত হয়ে না গিয়ে বরং আত্মোপলব্ধি করুন। ধরে নিলাম আপনি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু সেটা অন্য মেয়েরা বুঝবে কীভাবে? বোঝার মতো কী কাজটা আজ পর্যন্ত আপনি করেছেন? নিজের ঘরের মেয়েরা ছাড়া বাইরের মেয়েদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করেছেন কি?

মেয়েদের এ ধরনের পোস্টে গালিগালাজ করে, তাদেরকে “বেশ্যা” আখ্যা দিয়ে নিজেদের “ভালো পুরুষ” বলে প্রমাণ করবেন? হাসালেন। বরং মেয়েরা কোন দু:খে এইসব কথা বলছে সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। ট্রমা সেল্টারগুলোতে যান। ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখেন। স্বজাতির পাপের বোঝা দেখে লজ্জায় এমনিতেই চোখ নত হয়ে আসবে।

তখনই হয়তো আর পুরুষশূন্য পৃথিবীর কথা কেউ কল্পনাতেও আনবে না। পৃথিবীটা নারী পুরুষ সহাবস্থানের মাধ্যমেই সুন্দর হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.