কন্যা দিবসে এক কন্যার আত্মকথা

কাজী তামান্না কেয়া:

এই রকম একটা দিবস আছে, সে সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিল না। এবার এমেরিকান এবং বাংলাদেশি বন্ধুদের পোস্ট দেখে এর অস্তিত্ব টের পেলাম। ইন্টারনেট সার্চ করে দেখলাম ‘আন্তর্জাতিক কন্যা দিবসটি’র উৎপত্তি ভারতে। সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববারে পালন করা হয়। বাংলাদেশে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর, আর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ১১ অক্টোবরে।

যেসব সমাজে কন্যা শিশুদের পরিবারের বোঝা মনে করা হয়, সেসব সমাজের জন্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই দিবসটি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে, যেখানে কন্যাশিশু মানেই ‘অভিশাপ’ হিসেবে দেখা হয় আজও, যেখানে কন্যাভ্রুণ হত্যার সংখ্যা এখনও অগণিত, যেখানে ধর্ষণ, হত্যা, যৌন হয়রানি, শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের মতোন বিষয়গুলো এখনও মেয়েদের ভাগ্য থেকে মুছে যায়নি, বরং দিন দিন বাড়ছে, সেখানে এই দিবসটির তাৎপর্য অবশ্যই আছে।

একটা রিপোর্টে পড়ছিলাম যে, কন্যা দিবসটি পালনের অর্থ হচ্ছে বার বার মনে করিয়ে দেয়া সমাজ এবং রাষ্ট্রকে যে, পুরুষের চাইতে মেয়েরা কোনো অংশে কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ, যেন কোনো বাবা-মা তাদের কন্যা সন্তান নিয়ে কোনরকম হীনমন্যতায় না ভুগেন। মেয়েরা একইসাথে বিভিন্ন কাজ করতে পারদর্শি, যেমন অফিসে, তেমনি বাড়িতে, পরিবারে। বিশ্বজুড়ে নারীরা এটা প্রমাণ করেছে যে একহাতেই তারা সর্বোচ্চ পরিবর্তনটুকু আনতে সক্ষম। মূলত দিনশেষে পরিবারে হাসিটুকু আনে মেয়েরাই। এটা পরীক্ষিত সত্য।

কী করা হয় এই দিনে? এই দিনে বাবা মাকে কন্যা সন্তানদের কাছ থেকে এমন কিছু শিখতে বলা হয়, যা তারা আগে জানতো না। আজকের লেখায় আমি আমার জীবন থেকে প্রাপ্ত তেমন একটি বিষয় বাংলাদেশের সব বাবা মাকে জানাতে চাই৷

আমি পৃথিবীর মানচিত্রের এক কোনের একটি দেশ বাংলাদেশ, যে দেশটি হাজারো সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত, সেখান থেকে উঠে এসেছি। পৃথিবীর আরেকটি মহাদেশ এমেরিকা, যেখান থেকে প্রাপ্ত পিএইচডি ডিগ্রি সারা বিশ্বে এক নম্বর বলে গণ্য করা হয়, সেই ডিগ্রিটি গ্রহণ করার সর্বশেষ ধাপে আছি।

একজন মেয়ে হিসেবে এই দীর্ঘযাত্রা পথ কেমন ছিল?

আমার বাবা মা ছোটবেলা থেকে আমাদের খুব একটা শৃংখলে আবদ্ধ করে বড় করেননি। আমরা চার বোন এবং এরপর এক ভাই। হ্যাঁ, বাবা একটি ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। তার আগমনের অপেক্ষায় চারটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছিল তাদের ঘরে। খুব স্বাভাবিক, আমাদের ব্যবসায়ী বাবা ব্যবসার কাজে জগত সংসারে নিজেকে খানিকটা একা ভাবতেন বড় সন্তানটি ছেলে ছিল না বলে। তবে তাই বলে মেয়ে সন্তানদের কম সুযোগ দিতে তিনি রাজী ছিলেন না। নিরাপত্তা নামক সামাজিক সমস্যাটা আমাদের ছোটবেলায়ও ছিল। যখন ছোট ছিলাম, শক্ত করে ‘না’ বলা শিখিনি, আমাদের বাসায় দূরসম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়দের রাতে থাকা বা বাসায় আসা নিয়ে আব্বা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতেন, যাস্ট ঐটুকুই। বাসায় পুরুষ টিউটর পড়াতে এলে মা কখনও কাছে বসে থাকেননি। আমাদের ঘরের জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দেননি। তাই বলে স্বাধীনতা পেয়ে যাচ্ছেতাই করিনি। ভার্সিটিতে পড়াকালীন শিক্ষাসফর, বা পিকনিকে তাদের না বলে চলে যাইনি।

মাস্টার্স শেষ হবার খুব অল্প সময়ের ভেতর চাকরি পেয়েছিলাম। প্রথম দায়িত্ব হবিগঞ্জে গিয়ে ডাটা কালেকশন তদারকি। অবিবাহিত মেয়ে চাকরি পেয়েই হবিগঞ্জে ছুট, কই থাকলো, কার সাথে রাত কাটালো, এইসব চিন্তাগুলো আব্বা, আম্মাকে করতে দেখিনি। সেই বিশ্বাসটুকু হয় তাদের ছিল, নয়তো বিশ্বের বুকে নিজের স্থান করে নেয়ার দৌড়ে তারা আমাদের সামিল হতে দিতে চেয়েছিলেন। এরপর ঢাকা বেইজড চাকরি হলেও অসংখ্য ফিল্ড ট্রিপ আমি করেছি। কখনও একা, কখনও কলিগদের সাথে, কখনও সাথে অফিসের গাড়ি ও ড্রাইভার ছিল, কখনও কখনও ছিল না। দেশের ভিতর ট্রিপ করতে করতে এক সময় বিভিন্ন কনফারেন্সে দেশের বাইরে যেতে শুরু করলাম। দেশের ভেতর ফোন করে খবর নেয়ার যে ব্যাপারটা ছিল, দেশের বাইরে গেলে সেটা কিন্তু ঐভাবে সহজ ছিল না। আব্বা আম্মা কি চিন্তা করেনি? নিশ্চয়ই করেছে। তাই বলে কখনো যেতে বারণ করেননি। সাথে কে কে যাচ্ছে, কয়দিন থাকবো সেসব বার বার জিজ্ঞেস করেননি। প্রতিবারই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এসেছি।

আমার আজকের যে জার্নি, দেশের বাইরে পড়তে আসা, বিদেশের প্রতিকূল পরিবেশে বাড়ি খোঁজা, চাকুরি খোঁজা, কেনা-কাটা করা, দেশে যাওয়া আসা করা– এর কোনো একটা পর্যায়েও কিন্তু আব্বা আম্মা হাত ধরে শুরু করিয়ে দেননি। অনেক মেয়ের বাবা মা থাকেন, মেয়েরা বিদেশে পড়তে গেলে সেদেশে মেয়েদের সাথে গিয়ে সেট করে দিয়ে আসেন, ভ্যাকেশনে দেশে আসার টিকেট পাঠিয়ে দেন, সেইদেশে আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাদের বলে দেন মেয়েটির খোঁজ খবর রাখতে- আমার পরিবার ঠিক ঐ গোছের না। দেশ স্বাধীন পরবর্তী সংগ্রাম করা মানুষ তারা। সন্তানদের তারা স্বাবলম্বী করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিদেশে সন্তানের সাথে যেয়ে তাদের রেখে আসা তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। তবে এর কিছুদিন পর তারা গ্রিনকার্ড পেয়েছিলেন এবং এমেরিকায় এসেছিলেন। মা আমার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখেছেন, কী বিশাল বড় দেশে তাদের কন্যা একলা জীবন গুছিয়ে নিয়েছে, সেটুকু তারা নিজ চোখে দেখতে পেরেছিলেন। তবে শুরুতে এই যে তারা আমাকে নিয়ে আসেননি, তাতে কি কাজগুলি থেমে ছিল? একদম না। সমস্যা হতে পারতো না? হ্যাঁ পারতো। কিন্তু আমি ম্যানেজ করে নিতে পেরেছিলাম। নিজের দেখাশোনা নিজেকে করতে যেয়ে যে লাভটা হয়েছিল, আমি ঊণমানুষ হিসেবে গড়ে উঠিনি। মেয়ে হিসেবে বেড়ে উঠার আগে আমি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পেরেছিলাম।

গতকাল ফেইসবুকে কিছু ছবি পোস্ট করেছিলাম বোস্টনে আমার রুমমেইট এবং ক্লাসমেইটদের সাথে। একটা ছবিতে আমি একজন মাত্র মেয়ে আমার পাঁচজন ছেলে রুমমেইটের সাথে। বাসায় আরো একজন চাইনিজ মেয়ে ছিল–ক্যারেন। কোন এক বিচিত্র কারণে আমরা ওর সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়ে তুলতে পারিনি। ওর গল্প বলবো আরেকদিন। বাদবাকি ছয়জন আমরা ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলাম। তাই বলে তর্ক করিনি? আলবত করেছি, কারো সাথে রাগ-অভিমান করিনি? অবশ্যই করেছি। তবু দিনশেষে একই ফ্রিজে খাবার রেখেছি, একই কিচেনে শেয়ার করে রান্না করেছি, যার যার দরজা বন্ধ করে এসাইনমেন্ট করেছি, ভোর হতে না হতে দলবেঁধে ক্লাসে ছুটেছি।

ওরা সবাই এখনো আমার ভালো বন্ধু। একজন হাইতিতে ফিরে গেছে, একজন নেপালে, একজন রুয়ান্ডায় এবং বাকিরা এমেরিকায় আছি। ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ চ্যাটে নিজেদের খবরাখবর রাখি। ইচ্ছে আছে সবাই একটা গেট টুগেদার করবো নেপাল, বাংলাদেশে বা এমেরিকাতে। ওরা কি কেউ আমাকে পছন্দ করতো না? মানে ওই যে, ভালবাসাবাসি? অবশ্যই করতো। কিন্তু আমরা তো সবাই সবার বয়ফ্রেন্ড, গার্ল্ফ্রেন্ডের খবর জানতাম। কেউ কারো কাছে কিছু লুকানোর প্রয়োজন ছিল না। তাই সবাই সবার লিমিটেশন জানতাম। আর কী জানতাম? আমরা সবাই অল্প ক’দিনের জন্যে এমেরিকা পড়তে এসেছি মাত্র। ঝুট ঝামেলা করে বাসা ছেড়ে দিতে হলে, আরেকটা বাসা খুঁজে পাওয়া সোজা না। টাইমলি ডিগ্রি শেষ করতে না পারলে খরচ বাড়তে থাকবে। তাই ছেলেমেয়ে এক বাসায় একসাথে থাকা মানেই প্রেম পিরিতের অবাধ স্বাধীনতা নয়, আমরা তা একবাক্যে জানতাম এবং মানতাম।

কন্যা দিবসে সব পিতামাতার কাছে আর্জি, প্রত্যেকটা মানুষের ভুল করার অধিকার আছে। আপনি তাই কন্যা সন্তানটির জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। আপনি বড় জোর আপনার মতামত জানাতে পারেন, ভাল মন্দ বোঝাতে পারেন, জোর করতে পারেন না। তাদের সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিন। আপনার কন্যা সন্তানটিকে ছেলে সন্তানটির মত একই সুযোগ দিয়ে বেড়ে উঠতে দিন। দুই একটা ভুল করলেও তারা নিজেদের জীবনখানি নিজেদের মত যাপন করতে শিখে যাবে সুনিশ্চিত।

লেখক:
গবেষক, এক্টিভিস্ট, লেখক
সাউথ ক্যারোলিনা, ইউএসএ

শেয়ার করুন: