জান্নাতুল নাঈম পিয়াল:
এই যে কিছুদিন পরপরই দেশে একেকটা ধর্ষণ, ধর্ষণের প্রচেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা কিংবা যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি ইত্যাদির খবর ভাইরাল হয়, তাতে আমরা ছেলেরা বা পুরুষরাও, যাদের মধ্যে ন্যূনতম মনুষ্যত্ববোধ অবশিষ্ট আছে, প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হই, বিচারের দাবিতে সরব হই। কিন্তু তারপরও, আমরা ছেলেরা বা পুরুষরা কি এই ব্যাপারগুলোর ভয়াবহতা পুরোপুরি কখনোই অনুভব করতে পারি?
অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করবো, আমি পারি না। কারণ নিজের সাথে না ঘটলে বা ঘটার তেমন আশঙ্কা না থাকলে আমরা কখনোই কোনো নেতিবাচক জিনিসকে শতভাগ অনুভব করতে পারি না। তাই তো রাতের বেলা অন্য অনেক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলেও, আমাকে এমন কোনো দুঃস্বপ্ন দেখতে হয় না যে কেউ আমাকে নির্জন জায়গায় একা পেয়ে জাপটে ধরেছে, আর আমি তারস্বরে চিৎকার করছি। ভোরবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যখন দেখি চারদিক সুনসান, তখনো আমার বুক কেঁপে ওঠে না।
রাস্তায় প্রচণ্ড ভীড় দেখলেও আমার হাত-পা অবশ হয়ে যায় না যে এখন বুঝি হুট করে আমার শরীরে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া লাগবে। কেউ সরাসরি বা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারলে আমার একটু অস্বস্তি হয় ঠিকই, কিন্তু সেই অস্বস্তি আমাকে বাকি সারাটা দিন তাড়া করে বেড়ায় না। দিন বা রাতের কোনো সময়েই বাস প্রায় যাত্রীশূন্য হয়ে পড়লে আমাকে চলন্ত বাস থেকেই লাফিয়ে নেমে পড়তে হয় না। কোনো পাবলিক টয়লেটে কিংবা ট্রায়াল রুমে ঢুকে আমাকে আগে ভালো করে চেক করে নিতে হয় না যে লুকানো সিসি ক্যামেরা আছে কি না বা কোনো ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে কেউ আমার দিকে নজর রাখছে কি না।
সিনেমা দেখতে বসে ভিলেন কর্তৃক নায়িকাকে ধর্ষণের দৃশ্যে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে না। লিফটে বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের উঠতে দেখলে পিছিয়ে যেতে হয় না কিংবা তাড়া থাকলে ওঠার পরও কয়েকটা মিনিট অবিরাম দোয়া-দরুদ পড়ে যেতে হয় না। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরার শর্টকাট রাস্তায় অল্পবয়েসি কয়েকজনকে দেখে ঘুরপথে কয়েকগুণ বেশি সময় ব্যয় করতে হয় না।
কিংবা শুরুতে যে বলছিলাম, ধর্ষণ জাতীয় কোনো সংবাদ দেখলে আমি ক্ষুব্ধ হই, রাগান্বিত হই, দেশটা গোল্লায় গেল বলে হা-হুতাশ করি, কিন্তু তারপরও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমাকে লম্বা সময় ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় না, আমার পৃথিবীটা হঠাৎ করে ঘন কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায় না। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, আমার আশেপাশের কিংবা পরিচিত প্রতিটি মেয়ের মনেই এই ধরনের অনুভূতি হয়। হয়তো সবসময় না, কিন্তু কখনো না কখনো তো অবশ্যই। কেবল নিরাপত্তাবোধের অভাবেই তারা জীবনটাকে কখনোই ঠিকভাবে যাপন করতে পারে না। মানসিকভাবে ক্রমশই বিপর্যস্ত হতে থাকে।
অনেক সময় এই মানবজীবনকে তাদের কাছে এক চরম অভিশাপ বলেও মনে হয়। তাই আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই দেশে স্রেফ পুরুষ হয়ে জন্মানোটাই সবচেয়ে বড় প্রিভিলেজ। কে জানে, হয়তো গত জন্মের পুণ্যের ফল!