একজন ‘রুচিশীল সংস্কৃতিবোদ্ধা’র নিপীড়ক ও ধর্ষকরুপী চেহারা-২

সুমু হক:

বিয়ের পর থেকেই নানারকমভাবে রোকসানার কাছে পলাশের চরিত্রের অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়তে থাকলেও সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটলো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। ইংল্যান্ড থেকে রোকসানার বোন, দুলাভাই বেড়াতে এসেছেন, বাড়ি ভরা আত্মীয় স্বজন। সেই সময়  নানারকম ছোটবড় বিষয় নিয়ে পলাশকে নালিশ করে ক্ষেপিয়ে তুললেন পলাশের পরিবার। পলাশ রোকসানার বোন-দুলাভাইয়ের সাথে প্রকাশ্যেই রূঢ় আচরণ করতে শুরু করলেন।

নির্জনে পলাশকে জিজ্ঞেস করলেন রোকসানা, কী হয়েছে?
উত্তর এলো, “এই, কথা বলবি না তুই আমার সঙ্গে! কথা বলবি না!”
রোকসানা স্বভাবতই অত্যন্ত লজ্জিত এবং ভীত হয়ে পড়লেন পাছে বাড়িভর্তি অতিথির মধ্যে কেউ পলাশের কথা বলবার এই কদর্যতাটা শুনে ফেলে!
এবার চলুন, পরের অংশটুকু শোনা যাক তাঁর জবানিতেই।

“আমি বললাম, পলাশ তুমি এইরকম করতেসো কেন?”
তখন আমি সবার কাপড় ভাঁজ করে রাখছি একটা একটা করে।
ও আমাকে বলে, “তুই তো তোর বোনের বান্দি!”
“মানে? পলাশ, তুমি এইগুলা কী বলতেসো? আরে! তুমি আস্তে করে কথা বলো!
আমারে বলে, “তুই তো একটা বেজন্মা!”
“তখন আমি ওরে বললাম, “পলাশ! তুমি মুখ ঠিক করে কথা বলো!”
ও এরকম করে শুয়েছিলো, ভাগ্যিস ওর দিকে আমার পেটটা ছিলো না, আমি তার পাশে, পাশ ফিরে দাঁড়ায় ছিলাম। হঠাৎ আমারে এমন জোরে একটা কিক মেরেছে … সাত মাসের প্রেগনেন্ট আমি।”

ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েদের মগজের ভেতর সেই অনাদিকাল থেকে সংসারই যে তার একমাত্র ধর্ম এবং কর্তব্য, এই বিষয়য়টাকে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে, যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির কারো কাছে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে নিগৃহীত হওয়াটাকে তারা ভীষণ লজ্জার এবং অপমানের বলে মনে করে থাকেন। সমস্তটা লজ্জা যেন একান্তভাবেই তার, সেই অত্যাচারী স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের নয়!

আর তার ওপর যদি বিয়েটা নিজের পছন্দে, অর্থাৎ প্রেমের বিয়ে হয়, সেক্ষেত্রে দায়টা বোধহয় আরো নিজের ওপর নিয়ে নেন নির্যাতিতা মেয়েরা। বিয়ের পর তাই প্রেমিকটি ভয়ানক অমানুষ অত্যাচারী স্বামীতে পরিণত হলেও লজ্জা এবং দ্বিধায় তারা কাউকে বলে উঠতে পারেন না। আমাদের সমাজ পরিবারের সম্মান নামক অদেখা অজানা বায়বীয় এক বস্তুর ভয়ে ন্যূজ করে রেখেছে মেয়েদের, যাদের বাবার বাড়ির সম্মান নাকি আবার নির্ভর করে তাদের বৈবাহিক জীবনের সাফল্যের ওপর। অতএব, ভালো থাকো, মন্দ থাকো, বাঁচো আর মরো, পতিদেবতাটিকে ছেড়ে যাওয়া চলবে না। ছেড়ে গেলে লোকে কী বলবে! কখনোবা তার সাথে জড়িয়ে থাকে ভবিষ্যৎ সন্তানের নিরাপত্তার প্রশ্ন। প্রেমের বিয়ের এই ভয়ংকর পরিণতির খবর আমরা প্রায়ই দেখি পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়।

রুমানা মঞ্জুরের ঘটনাটি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই আপনাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি!
সৌভাগ্যবশত: রোকসানার পরিণতি রুমানার কাছাকাছি পৌঁছবার মাত্র তিল পরিমাণ দূরত্বে এসেও থেমে যায়, বেঁচে যান তিনি। পলাশের সাথে বিবাহিত জীবনের ২৪টি বছর একের পর এক সেই ভয়ংকরতম যন্ত্রণা এবং লাঞ্ছণার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।

অবশ্য এক্ষেত্রে রোকসানার দুর্বলতা ছিল পলাশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। ভাইবোনেরা বরং তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। রোকসানা বলে চলেন,

“আসলে জানো, অতি ভালোবাসতাম। আমার আনকন্ডিশনাল লাভ ছিল রে! জানো, আমি নিজের কাছে প্রমিজ করেছিলাম যে এই ছেলেটাকে…যে এতো কষ্ট পেয়েছে লাইফে, ওর বাবা ছিল না, এরকম কষ্ট ছিল ওর! আমি কোনদিন ওকে কষ্ট দেবো না। আমি ওকে লুক আফটার করবো। আমার মনে হয়েছে কী যে, আল্লাহ, ওর বাচ্চা আসবে! এখন আমি ওকে আবার… তাহলে ওতো আবার এটা সহ্য করতে পারবে না! ওতো একটা মানুষ! আর কীভাবে এটা! ওর ফ্যামিলির সবাই ওয়েট করতেসে বাচ্চার জন্যে! ”

রোকসানার বোন-দুলাভাই চলে গেলেন।

রোকসানা আক্তার ঝর্ণা

“এরপরে যখন-তখন টর্চার শুরু করলো! প্রতিটা রাত আমাকে গালাগাল করে…”এই কুত্তার বাচ্চা! তুই এই রুম থেকে যা!” আর তখন আবার আমার বোনঝির পরীক্ষা শেষ, আমার ভাইয়েরা আমার বোনঝিকে বলছে, বড় ভাইয়ের বাসা তো তখন পাশে আরেকটা ফ্ল্যাটে, “কিছু হইলেই কিন্তু তুই আমাদেরকে খবর করবি। ঝর্ণা যাতে সেইফ থাকে। তুই খেয়াল রাখিস।” … সারা রাত আমি জানলা ধরে তাকায় থাকতাম আর কানতাম। আমি ভয়ে ওর সাথে গিয়ে শুইতাম না যে ও আমাকে যদি মারে! ও আমাকে যদি বকে! এইরকম টর্চারটা সে করতো। আমাকে বলতো, “বাচ্চাটা হোক, জানিস কী করবো? তোর বাচ্চা, তুই হসপিটালে তো বেডে থাকবি, বাচ্চা তো আমাকে দেবে, আমি বাচ্চা নিয়ে চলে যাবো। তুই খুঁজেও পাবি না!” তখন তো আমার ভয় ও আমার বাচ্চা নিয়ে যাবে!”

শুধু এখানেই শেষ নয়, সিজারিয়ানের ডেট ঠিক হয়ে যাবার পর সেই ডেটের দুদিন আগে পর্যন্ত রোকসানা এবং তাঁর সন্তানের ভয়ানক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ধর্ষণ করেন পলাশ। সিজারিয়ান হয়ে যাবার পর সাতদিনের মাথায় হাসপাতালের বিছানায় আবার ধর্ষণের চেষ্টা করে সফল না হলেও বাড়িতে ফেরা মাত্রই শুরু হয় তার নিয়মিত ধর্ষণ এবং আরো নানারকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার।

“প্রেগনেন্সির সময়টাতে ও পশুর মতো হয়ে যেতো! আমার কোন নিষেধও মানতো না! আমি বলতাম, পলাশ, তুমি এইরকম করো কেন, পলাশ, বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে যাবে! ও মানতো না।… উফফফ,” বলে থামলেন রোকসানা।

পলাশের সাথে থাকা এরপরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস, প্রতিটি বছর এরকম হুমকি, অনিশ্চয়তা এবং আতংকে কেটেছে তাঁর।

ক্রমশ:

 

আগের পর্বের লিংক:

https://womenchapter.com/views/35830

শেয়ার করুন: