বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন কোন পথে!

সালমা লুনা:

নারী নির্যাতন বা নারী অধিকার নিয়ে লেখালেখি করি বলে অনেকে কিছুটা বিদ্রুপ কিছুটা তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলেন, তুমি তো আবার নারীবাদী! নারীদের নিয়ে লেখালেখি কর।
সবিনয়ে বলি, আমি নারীবাদী নই।

তবে নারীবাদী হওয়া দোষের কিছুও না।
তাই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি নারীবাদী?
আমতা আমতা করে নিজেই উত্তর দেই, মনে হয় না। আসলে আমি নিজেও জানি না, আমি নারীবাদী কীনা!

সত্যিই তাই।
আমি জানি না আমি নারীবাদী কীনা।
হ্যাঁ, নারীদের নিয়ে লেখালেখি করি। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা লাগাতার নির্যাতনের ঘটনা আমাকে প্রতিবাদী করে। লিখতে বাধ্য করে।
কিন্তু নারীবাদ নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ নেই।

নারীবাদ একটা আন্দোলন। যার এদেশীয় পদ্ধতিতে কিছু সমস্যা আছে।
যে পদ্ধতির জন্য নারীবাদ আমার দৃষ্টিতে একটা চরমপন্থা বলে মনে হয়।
এটা এমন এক মৌলবাদ, যেখানে প্রকৃত মৌলবাদীদের সাথে বাংলাদেশের নারীবাদের মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠের মতো একটা সম্পর্ক দৃশ্যমান। দুটোই পাঁড় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন। কখনো আক্রমণাত্মক। তাই দুটিতেই মানুষের প্রতিক্রিয়া একই।

কিছুটা বিশ্বাস, কিছুটা সন্দেহ, কিছুটা প্রয়োজন ও বর্জনের এক বিতর্কিত বিমূর্ত বাস্তবতা। অনেকেই ভীষণ বিরক্ত হবেন এটুকু পড়ে। জানি। কিন্তু এটাই বাংলাদেশের বর্তমান নারীবাদ।
অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন, ভাসমান, গোয়ার্তুমিতে ভরা এক প্রশ্নবিদ্ধ একটিভিজম। এক বিতর্কের নাম। যেখানে নারীবাদ এক উগ্রতা,
লক্ষ্যহীনভাবে যা ইচ্ছে তাই করার নাম। গায়ের জোরে এককভাবে নিজেকে জাহির করাই যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য একজন নারীবাদী কর্মীর।
যার ফলে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে এখানে। এবং দৃশ্যমানও। আর তাই প্রশ্নবিদ্ধও হচ্ছে বারেবারে।
নারীবাদকে তাচ্ছিল্য করার কারণ এতেও কিছুটা নিহীত।

গত কয়েক বছরে দেশে নারীবাদের নামে যা দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তা হলো নারীবাদ এমনকি কখনো নারীর বিরুদ্ধে গিয়েও অবলীলায় সঙ্গ দিয়েছে অবৈধ রাজনীতির সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজের, স্বজন তোষনের, ধর্ষকের, পরকীয়ার, অবাধ যৌনতার, মাদকের, সামাজিক অবক্ষয়ের। ধর্ম এবং ধার্মিককে বানিয়েছে নারীবাদের প্রধান শত্রু। কুপ্রথা ভাঙার নামে সমাজের মূল্যবোধ ভেঙে চলার নামই হয়েছে নারীবাদ।

প্রতিটি অভিযোগ কতটা সত্য তা অনলাইন পরিক্রমা যারা নিয়মিত করেন তারাই বুঝবেন।

এই কথাগুলোও নারীবাদ বলতে দিতে চায় না। ব্লেইমিং এর অজুহাতে মুখ বন্ধ করতে চায়। কারণ খুব চুপেচাপেই এখানে নারীবাদ ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে এখন। এগুলো বললেই বর্তমানের একেকজন বিভীষণসম (ঘরের শত্রু) নারীবাদীরা হাহা করে তেড়ে আসে, জাজমেন্টাল বলে। নারীবাদের শত্রু, মোল্লা, ব্রাহ্মণ, গোয়েন্দা বলে আখ্যা পাওয়া যায়। নীতির প্রশ্নে বন্ধুও এখানে শত্রু হয়ে যায়।

তাই এমন ভীষণ রূপ দেখে আমার মনে হয় না আমি নারীবাদী। তবে নারীর স্বার্থে যেখানে যে আঘাত করবে সেই কথাটি বলতে, সেটির প্রতিবাদ করতে আমি পিছপা হই না। নিজে নারীবাদের প্রাকটিস করি নিজের মতো করে। সেই অর্থে আমি নারীবাদী নই। নারীবাদী হতে হলে খুব, ম্যালা লেখাপড়া করতে হয়। নইলে নারীবাদের বই পড়া নারীবাদীরা যে কেউ যেকোন মুহূর্তে যে কাউকে তুড়ি মেরে খারিজ করে দেয়।
এ কয় বছরে সেটা বহুবার দেখেছি আমি।

যে নারীবাদ সাজানো ঘরসংসার রেখে পুরুষ বন্ধুর সাথে এখানে ওখানে শুয়ে পড়ার স্বাধীনতা চায়, একে তাকে ধরে সেই শোয়ার জায়গা ঠিক করে দিতে বলে বিকারহীনভাবে, সেই নারীবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।
যে নারীবাদে শরীর সুন্দর অসুন্দর যাই হোক বিবসনা করে তাকে লোকের সামনে তুলে ধরার স্বাধীনতা বোঝায়, মদ গাঁজা খেয়ে তার ছবি আপলোড করা বোঝায় – সেটি ব্যক্তির উগ্রতা হতে পারে, নারীর অধিকার আন্দোলনের বিষয়টা এখানে কোথায় কীভাবে ম্যাচ করে, তা ঠিকঠাক বোঝা যায় না বলেই নারীর স্বাধীনতার আকাংখা প্রতিনিয়ত গালাগাল খাচ্ছে।

গালিতে সমস্যা নাই, সেটা নারী ঠিক পথে চললেও খায়। কিন্তু সমস্যা হলো নারী স্বাধীনতার যে পথটিতে পূর্বসুরীরা মাটি ফেলে গেলেন সেই পথটি মসৃণ করার বদলে উত্তরসুরীদের জন্য আরও বিপজ্জনক করে তুলছেন বর্তমান নারীবাদীরা।

বাংলাদেশের নারীবাদীদের কাছে কোন সঠিক পথের দিশা আছে?
নারীবাদের একটা রোলমডেল কি আছে এখানে, যাকে কেন্দ্র করে যার নেতৃত্বে এদেশে নারীবাদ চর্চা বিস্তার লাভ করবে? নির্যাতিত নিপীড়িত মুক্তিকামী নারীরা যেদিকে তাকিয়ে শক্তি খুঁজে পাবে ডানা মেলে দেয়ার?
অন্তত নেতৃত্ব না হোক, কর্মীরা কি নারীবাদকে একটা আন্দোলনের ধারণা হিসেবে এর কোন প্যাটার্ন বা কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছে, যেখানে এসে অধিকার বঞ্চিত নারীরা শ্বাস নিতে পারে?
দুচারজনের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা আছে হয়তো বা। যা খুবই সামান্য।
এতোবড় একটা প্ল্যাটফর্মে দু’একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তেমন কাজে লাগে না।
আরো যা সমস্যা তা হলো এই দুচারজনেরও বন্ডিং নেই। ফলে নারীবাদের সহসাই শক্ত কোন প্ল্যাটফর্মের আশাও নেই।

এ অনেক বড় কাজ। অনেক গুরু দায়িত্ব। একে নারীবাদ আন্দোলন বলতে চাইলে নারীবাদী কর্মীদের একাত্মতা জরুরি ছিল।
যার আশা সুদূর পরাহত।
সেজন্যই নারী অধিকার নিয়ে কিঞ্চিত লেখালেখি করলেও ঠিক নারীবাদ নিয়ে আগ্রহ নেই আমার।
আরো অনেকেই বলে থাকেন এমন। এসব কারণে মিছিল দীর্ঘ হবার সম্ভাবনা প্রবল।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.