আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:
এ যেন আরেকটা আরেকটা #মিটু। মেয়েটির বয়স তখন ১২। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় সে। চারপাশে তখন তার ঝলমলে রোদ্দুর। মেয়েটি যখন গান গায় চারপাশে ফোটে যেন পলাশ ফুল। একদিন হঠাৎ বিষন্ন হয়ে যায় প্রজাপতি মেয়ে। গান গায় না, চুল বাঁধে না। জানালার গরাদ ধরে বাইরে শুধু তাকিয়ে থাকে সে। ভেতরটা তার ভেঙেচুরে যায়। কিন্তু বাইরে শান্ত। একটুও বুঝবার উপায় নেই ভেতরের গভীর রক্তক্ষরণ। দিন কেটে যায়। ১২ থেকে আস্তে আস্তে ১৬ তে পা । তারপর ২০-২২….।
শান্ত মেয়েটি একদিন হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে। সারা পৃথিবী তোলপাড় করে জানিয়ে দেয় ১২ বছর বয়সে রেপের শিকার হয়েছিল সে। আর রেপ করেছিল তারই গানের শিক্ষক। যে নাকি সমাজে খুবই জনপ্রিয় একজন সংগীত শিল্পী।
মেয়েটি জানায়, এতোদিন বলতে পারেনি সমাজ সংসারের ভয়ে। বলতে পারেনি অভিভাবকদের হারানোর ভয়ে। কারণ সেই শিক্ষককে সবাই ভালো মানুষ হিসেবে জানে। তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, সেই ভাবনায় চুপ থাকে কিশোরী মেয়েটি। একদিন ঘটনাচক্রে জানতে পারে সেই শিক্ষক শুধু তাকেই নয়, আরো মেয়েদের প্রতি ঘৃণ্য আচরণ করেছে। তার কথা মতো চললে একক গান গাইতে দিবেন বলে নোংরা ইঙ্গিত করেছেন। অশ্লীল ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। যারা শোনেনি, তাদের গান গাইতে দেয়া হয়নি। তার এসব নোংরা আচরণে ভীত হয়ে অনেক মেয়ে সরে আসে গান শেখা থেকে। এসব দেখে এতোদিন পর ভয়ের বাঁধ যেন খুলে যায় মেয়েটির। মনে হয়, না, আর চুপ থাকা নয়, মুখোশধারীর মুখোশ এবার খুলে দিতে হবে। হয় এসপার, নয় ওসপার। বিচার হওয়া দরকার।
ফেসবুকে জানায়, গান শেখাতে এসে শিক্ষকের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় সে। জানায় স্বনামধন্য সেই শিক্ষক, যিনি কিনা গানের শিক্ষক রকিবুল হাসান রবিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সংগীত প্রশিক্ষক, তাকে ভয় দেখাতো এই বলে যে, বাবাকে বলে দিলে বাবার ক্ষতি করা হবে। আত্মহত্যায় লিখে যাবে তার নাম, তার বাবার নাম। জানিয়ে যাবে তার আত্মহত্যার জন্য মেয়ে-বাবা-মা পুরো পরিবার দায়ী। বালিকামন ভয়ে কাঁদতো। বলতে পারতো না কাউকে। নিজের ভেতরে জমা করে শুধু ঘৃণার পারদ। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল সে।
মেয়েটির এমন প্রতিবাদে ঝড় ওঠে সমাজে। পক্ষে-বিপক্ষে দুপক্ষ হয়ে যায়। মেয়েটি আবার শান্ত। তার চোখ শান্ত, মন শান্ত। তবে মনোবল পাহাড়ের মতো দৃঢ়। জানে সে, এবারের ঝড় সে একাই পারবে সামলাতে। আর ভয় নেই। সবাই আছে পাশে।
জানা যায় ফেসবুকে লেখা পোস্ট হতেই লুকিয়ে যায় সেই অপরাধী। কথা বলার জন্য ফোন করা হলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। এখন নানাজনকে বলছে সে তাকে নির্দোষ বলার জন্য।
সুপ্রিয় পাঠক, পাশবিক নির্যাতনের এই ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটেছে রাজশাহীতে। তবে এরকম ঘটনা, শুধু রাজশাহী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেনীর মুখোশধারী মানুষদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে অনেক কিশোর কিশোরী। বাবা মার বেখেয়াল বা সরলতায় অনেকেই জানতেই পারছেন না কী ঘটছে তার সন্তানের সাথে। পরিবারের মানসম্মানের ভয়ে এসব শিশু বা কিশোর-কিশোরীরা বলতে পারছে না তার সাথে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা।
এই মেয়েটির পরিবার সংস্কৃতিমনা। তবু তার কথা বলতে সময় লেগেছে অনেক কটা বছর। আশার কথা এই তবুও সাহসী কন্যা বলতে পেরেছে তার কথা। দু:সময়ে পাশে পেয়েছে তার পরিবার আর সুহৃদদের। অনেক মেয়েরা বলতেই পারে না ভয়ে। ট্রমার ভেতর দিয়ে কেটে যায় তাদের গোটা জীবন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক জানান, মেয়েকে নাচ শেখাতে যেয়ে নানা ঘটনায় মানুষের উপর আজ বিশ্বাস হারিয়ে গেছে তার। মেয়ের নাচ শেখা এখন বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। এখন কারো সাথেই সহজভাবে আর মিশতে দেন না মেয়েকে। যদিও এটা সমাধান নয় বলে মন্তব্য তার।
আরেক অভিভাবক বলেন, আসলে যতই আমরা আধুনিক হচ্ছি ততই আমাদের বিকৃতির মাত্রা বাড়ছে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে সন্তানদের সাথে আমাদের সম্পর্ক সহজ হলেও কোথায় যেন একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। কাছে থেকেও কাছে থাকছি না আমরা। ফলে ঘটছে নানা সমস্যা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংস্কৃতিক কর্মী বলেন, আসলে মেয়েদের আজও নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে কাজ করতে হয়। যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করেন তাদের মানসিকতা যদি বিকৃত ধরনের হয় তা সত্যিই দু:খজনক। তিনি কিশোরীর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ে ওই শিক্ষকের দ্রুত শাস্তির দাবি জানান। তার মতে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গায় যদি এমন হয় তাহলে সমাজের জন্য তা অশনি সংকেত। অনেকেই ভয়ে পিছিয়ে যাবে সংস্কৃতি চর্চা থেকে। যার প্রভাব পরবে আচরণে, নৈতিকতায়। একজন মুখোশধারী মানুষের জন্য গোটা সমাজ কেন সাফার করবে?
তার মতে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের হতে হবে মুক্তমনের। এখানে নোংরামীর কোন জায়গা নেই। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে সবাইকে। সব অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহস করেই পা বাড়াতে হবে। বাইরে যতই সাহস দেখাক আসলে প্রতিবাদেই ভয় পায় অপরাধীরা। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, “যখনই জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে। যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনই সে পথ কুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।’