সামাজিক মনস্তত্ত্বে ‘ধর্ষণ’ যখন বৈধ

আনা নাসরীন:

সম্প্রতি ‘নারী অধিকার কর্মী’ মারজিয়া প্রভা ও ছাত্রফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলার সাবেক নেতা বর্তমান শ্রমিক ফ্রন্টের সংগঠক রায়হান আনসারি এর সহযোগিতায় তাদের স্বজন/বন্ধু ছাত্রফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা কমিটির বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক কবি সজিব তুষার কর্তৃক একটি ধর্ষণের অভিযোগ উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।

শুরুতেই বলে রাখতে চাই কেবলমাত্র একটি সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক অভিযোগকে কেন্দ্র করে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যাওয়া, কাউকে ধর্ষক বা ধর্ষণের সহযোগী বলে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে ফেলাটাও কোনো বিবেচক মানুষের কর্ম নয়। যে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে আমাদের ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা আবশ্যক। তবে আমি ঘটনার প্রেক্ষাপটে মানুষের নানামুখী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিত্তিক কিছু কথা বলতে চাই।

আলোচিত ধর্ষণের অভিযোগটি তুলেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী মারজিয়া প্রভা এবং রায়হান আনসারির অন্যতম বন্ধু সাংবাদিক মাহমুদ খান। যা নিয়ে বরাবরের মতোই বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি যে ঘটনাটি কি আদৌ ধর্ষণ বলে গণ্য করা যায় কিনা। আরও দুঃখজনক হলো ঘটনার সহযোগীরূপে অভিযুক্ত মারজিয়া প্রভা ও রায়হান আনসারি যেহেতু যথাক্রমে একজন এক্টিভ নারী অধিকার কর্মী ও আরেকজন বাম নেতা, তাই এখানে নারীবাদ ও বাম রাজনীতির দিকেও উঠেছে তির্যক তর্জনী।

প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার আগে প্রাসঙ্গিক কারণে ধর্ষণ বিষয়ক সামাজিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে চাই। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আমরা দেখে থাকি যে – সমাজে কারও সম্মতি ব্যতীত যৌনাচার মাত্রই ধর্ষণ বলে বিবেচিত হয় না, যা কিনা ধর্ষণের মূল সংজ্ঞা হওয়া উচিত। তা যে বয়সের নারীর সাথেই হোক, যার সাথেই হোক, যে পরিস্থিতিতেই হোক, আর যে বা যাদের দ্বারাই সংগঠিত হোক না কেন। এবং ধর্ষণের সহযোগিতাও সমানভাবে অপরাধ বলে গণ্য করা উচিৎ, তা যেই করে থাকুক না কেন। আমরা দেখে থাকি যে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিকে কিছু মানুষ ধর্ষণ বলে গণ্যই করে না। যেমন মেরিটাল রেইপ, অনেকেই মনে করে নিজ স্ত্রী কিংবা প্রেমিকার ক্ষেত্রে ধর্ষণ বলে কোনও শব্দ নেই। অর্থাৎ স্ত্রী বা প্রেমিকার ক্ষেত্রে সমাজে যৌনাচারগত স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় লক্ষণীয়। অথচ নৈতিকভাবে নিজ স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথেও প্রতিটি যৌনাচারে সম্মতি জরুরি। কারো অনিচ্ছায় একটি মুহূর্তের যৌনাচারও ভিকটিমের পক্ষে বীভৎস অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে, এবং তা নিঃসসন্দেহে যৌন নিপীড়ন।

আমরা যে বিশেষ পরিস্থিতিগুলোর ক্ষেত্রে দেখে থাকি যে কিছু মানুষ ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে গণ্য করে না তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ভিক্টিম যদি আধুনিক বা পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, তিনি যদি মদ্যপানে অভ্যস্ত বা ধূমপায়ী হন, স্বেচ্চায় কোনও ছেলে বন্ধুর সাথে ভ্রমণে বা কোনও ফ্ল্যাটে আড্ডা দিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদভাবে ধর্ষক নিরপরাধ বলে গণ্য হয় ভিক্টিম যদি ঘটনার সময় ইনটক্সিকেটেড অবস্থায় থেকে থাকেন বলে ধারণা পাওয়া যায়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটি এরকম যে একটি মেয়ে কোনো পুরুষের সাথে কোনও ইনডোর এনভায়রনমন্টে যাওয়ার মানেই সেক্সচুয়ালি কনসেন্ট দেয়া। কোনও মেয়ে কোনও ছেলে বন্ধুর সাথে নেশাগ্রস্থ হওয়ার মানেই হলো সে সেই পরিস্থিতিতে যে কোনো অঘটনের জন্যই প্রস্তুত। ধর্ষণের ঘটনা দিনের বেলা সংঘটিত হয়েছিলো, নাকি রাতে, রাত হলে তা রাতের কততম প্রহর, সেটাও বিশেষভাবে বিবেচিত হতে দেখা যায়। ছেলে বন্ধুদের সান্নিধ্যে রাতে চার দেয়ালের মধ্যে সহাবস্থানও একটি মেয়ের ধর্ষণের শিকার হবার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে সমাজের বৃহদাংশ সম্ভবত একজন নারীর ক্ষেত্রে ‘বন্ধুত্ব’ বলে যে কিছু আছে তাই মনে করে না! অথচ একথা বলার অপেক্ষাই রাখে না যে লিঙ্গ নির্বিচারে ‘বন্ধুত্ব’ হলো বিশ্বস্ততার আরেকটি প্রতিশব্দ। একটি ছেলে যদি বন্ধুর ফ্ল্যাটে গিয়ে বন্ধু কর্তৃক ধর্ষণের হয় (সেটাও নিশ্চয়ই অসম্ভব কোনকিছু নয়) সেক্ষেত্রে সম্ভবত কেউ ভিকটিমকে এমন অভিযোগ করবে না যে ভিকটিম ইচ্ছেকৃত ধর্ষণের শিকার হতেই গিয়েছিলো। দুজন ছেলে যদি এক বিছানায় ঘুমাতে গিয়েও একজন ধর্ষণের শিকার হয়, সে ক্ষেত্রেও ধারণা করি ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে এই প্রশ্ন করা হবে না যে ভিক্টিম কেন রেপিস্টের সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে গিয়েছিলো। তাহলে একটি মেয়ের ক্ষেত্রেই কেন এমন অভিযোগ অনিবার্যভাবে আসে!

আমাদের সমাজ কি আশা করে না যে মেয়েরাও বন্ধুত্বে সমানভাবে আস্থা ও সম্মান রাখুক! একটা মেয়ে বা একজন নারী যদি নিজ বন্ধুদের সাথে ড্রিঙ্ক পার্টিতে যায়, রাত্রি যাপন করে, এক বিছানায় ঘুমায়, তবে কেন ধরে নেয়া হয় যে মেয়েটি ইচ্ছেকৃতভাবে ধর্ষণের শিকার হতেই গিয়েছিলো! তবে কি লিঙ্গবৈষম্য মাথায় রেখেই একটি মেয়েকে বন্ধুত্ব বরণ করতে হবে? তাই যদি হয়ে থাকে তবে কি তা বন্ধুত্ব বলে বিবেচনা করা সমীচীন হবে? মেয়েদের ক্ষেত্রে কি যৌনতা ব্যতীত একটি নির্মল বিনোদন বা আড্ডা উপভোগ করার অধিকার নেই? এ থেকে ধারণা করা যায় যে নারীকে সমাজ এখনও পর্যন্ত নিরেট ভোগ্যবস্তু বা যৌন উপকরণ হিসেবেই বিবেচনা করে।

কোনও প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী স্বেচ্ছায় যদি দুজনের সম্মতিক্রমে শারীরিক বা মানসিক যেকোনো রকম সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তা নিঃসন্দেহে আপত্তির অবকাশ রাখে না। কিন্তু সম্মতিটি অবশ্যই হতে হবে স্বাভাবিক অবস্থায়, সুস্থ মস্তিষ্কে, সজ্ঞানে। কোনো শিশু বা মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের কনসেন্টকে যেমন কনসেন্ট বলে গণ্য করা যায় না, একজন নেশাগ্রস্থ মানুষের কনসেন্টকেও কনসেন্ট বলে গণ্য করার কোনও যুক্তি নেই। তাই সুযোগ সন্ধানী না হলে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে কোনো মানুষের পক্ষেই উচিত নয় সম্মতিক্রমেও ইনটক্সিকেটেড অবস্থায় থাকা কোনও মানুষের সাথে প্রথম বারের মত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা।

কেউ কেউ দেখেছি এরকমও মনে করে থাকে যে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কিছু পুরুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা সক্রিয় হয়, এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে অনেকের দৃষ্টিতেই ধর্ষণ প্রবণতাকে মার্জনীয় বলে বিবেচনা করা হয়। সম্ভবত একারণেও এধরনের পরিস্থিতিতে সংগঠিত ধর্ষণকে অনেকে হালকাভাবে নিয়ে থাকে। আমি মনে করি কোনও পরিস্থিতিতেই ধর্ষণের মতো একটি গুরুতর অপরাধকে অগ্রাহ্য করার কোনও সুযোগ নেই। কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি নেশাগ্রস্ত হওয়ার ফলে ধর্ষণ প্রবণতা জাগ্রত হয় বলে উপলব্ধি হয়, তবে সেই মানুষটিরই বরং এধরণের আয়োজনে অংশ গ্রহণ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিরত রাখা বাঞ্চনীয়। আত্মনিয়ন্ত্রণহীন মানুষদের জন্য এই বিনোদনটি নয়, বা করলেও তাদের বিপরীত লিঙ্গের সহচার্য বর্জন করেই তা করা উচিত।

ওদিকে যদি ধর্ষকামী ব্যক্তিটি সমকামী হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে ধারণা করা যায় এধরনের ধর্ষকামী মানুষদের সাথে সমলিঙ্গের বন্ধুটিও নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যারা ধর্ষণ প্রবণ হয়ে ওঠেন সে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ এধরণের সামাজিক উৎসব আয়োজনে অংশ গ্রহণ না করে তা একাকিত্বেই উপভোগ করবেন এটাই কাম্য। সুতরাং এক্ষেত্রেও ভিক্টিমকে ব্লেইম করার সুযোগ থাকছে না, ধর্ষণের দায় সর্ব ক্ষেত্রেই কেবল ধর্ষকের নিজের উপরেই বর্তায়।

যদিও আলোচ্য ঘটনার ভিক্টিম ইনটক্সিকেটেড অবস্থায়ও সম্মতি প্রদান করেনি বলেই দাবি উঠেছে। ঘটনা প্রকাশক প্রত্যক্ষদর্শী মাহমুদ খানের দাবি অনুযায়ী ভিক্টিম উক্ত ঘটনায় অনবরত বিরক্তি বা অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু উপস্থিত অন্য সঙ্গীদের অসহযোগিতা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের কারণে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও সে প্রতিকার করতে সফল হয়নি বলে তিনি দাবি করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে নামটি উঠে এসেছে তা হলো ‘মার্জিয়া প্রভা’। একটি গ্ৰুপ কনভারসেশনের ভিত্তিতে তার একটি মন্তব্য আমার চোখে পড়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, “অভিযুক্ত ব্যক্তি ভিকটিমকে কী বলে এনেছিলো, তা আমি জানি না। আমি শুধু জানতাম আমাকে জায়গা করে দিতে হবে, আমি সেটা দিয়েছি। এখন দুজন এডাল্ট রুমের মধ্যে কী করবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় না।” বন্ধুর একপাক্ষিক আবদারে অপরজনের সম্মতি আছে কিনা তা জানার চেষ্টা না করে জায়গা করে দেয়ার অর্থ হলো ধর্ষণ সংঘটিত হবার সুযোগ করে দেয়া। এক্ষেত্রে অবশ্যই তার উচিত ছিলো জায়গা করে দেবার আগে মেয়েটির কাছ থেকে মেয়েটির মতামত জানতে চাওয়া, এবং তা অবশ্যই নেশাগ্রস্ত হবার আগে।

ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে ধারণা করা যায়, কেননা তারই উক্ত বক্তব্য অনুসারে অভিযুক্ত ধর্ষক তাকে জায়গা করে দেয়ার অবদারটি পূর্বেই জানিয়েছিলো। তাই সমস্ত আয়োজনের পূর্বেই ভিকটিমের মতামত নেয়ার যথেষ্ট সুযোগও ছিলো। এবং তা বিশেষভাবে নারীবাদী পরিচয়ের সুবাদেও নয়, শুধুমাত্র একজন কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিসেবেই ভিক্টিমের কনসেন্ট নেয়া অনিবার্যও ছিলো। ধর্ষণের অপরাধ এডাল্ট নারীর ক্ষেত্রেও সমানভাবে অপরাধ।

উক্ত ঘটনায় যেহেতু একজন ‘নারীবাদী এক্টিভিস্ট’ ও একজন বামপন্থী নেতার ভূমিকাকে ধর্ষকের সহযোগী বলে দাবি করা হচ্ছে, তাই দেখা যাচ্ছে বরাবরের মতোই উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ নারীবাদ ও বামপন্থী রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করছে। আমরা দেখেছি মসজিদেও জুতা চুরি হয়, তার মানেই যেমন ধরে নেয়া যায় না মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া কোনো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি জুতা চোর। তেমনিভাবে কিছু সুযোগসন্ধানী অসৎ মানুষ মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে ছদ্মবেশে নারী আন্দোলন, বাম রাজনীতি থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্গনেই প্রবেশ করতে পারে। অভিযোগ অনুসারে সত্যিই যদি তারা ধর্ষণের সহযোগিতায় জড়িত হয়ে থাকেন কিছু নারীবাদী একটিভিটি বা দলগত পদ দেখেই তাদের প্রকৃত নারীবাদী বা আদর্শ বামপন্থীরূপে গণ্য করে নারীবাদ ও বাম রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শেয়ার করুন: