প্রিয় অভিভাবকরা, যৌতুক নয়, বরং মেয়েকে স্বাবলম্বী করুন

জিন্নাতুন নেছা:

ফোনে কথা হচ্ছিলো এক বান্ধবীর সাথে। কথায় কথায় সে বললো, আমাদের এলাকায় এক মেয়েকে মেরে ফেলে পুকুর ঘাটে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। জানতে চাইলাম, কেন? কারণ হলো শ্বশুরবাড়ির চাহিদানুযায়ী অর্থ দিতে পারে নাই। আমি বললাম, ওদের আর্থিক অবস্থা তো ভালো। তাছাড়া অনেক টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিয়েছে, তাহলে এমন হলো কেন? আমার বান্ধবী যে ঘটনা বললো তা হলো, “মেয়েটির নাম রিমা (ছদ্মনাম)। রিমার পরিবারে ছিলো দুই ভাই, দুই বোন। বলা চলে উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান রিমা। পড়ালেখায় ভালো ছিলো। কিন্তু দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার ডাক্তার পাত্রের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে তার খালা। রিমার প্রচণ্ড অনিচ্ছায় তার বাবা বিয়ে দিয়ে দেয় একটা মোটর বাইক, ১৫ ভরি গহনা দিয়ে। বিয়ের কিছুদিন পার হতেই ডাক্তার স্বামীর নিজের ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার বাসনায় রিমাকে অনেক মারধর সহ্য করতে হয়েছে বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেবার জন্য। রিমা কিছু টাকা এনে দিয়েছিলো বটে। কিন্তু ডাক্তার স্বামীর লোভ মেটাতে পারেনি। অবশেষে স্বামী, শ্বশুর পরিবারের বলিদান হয়েছেন রিমা।”

আমাদের সমাজে এমন রিমার ঘটনা অহরহ। স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির চাহিদা মিটাতে না পেরে কত মেয়ে যে মৃত্যুবরণ করছে, তার ইয়ত্তা নাই।

আর একটি ঘটনা বলি। সালমা বেগম (২৫)। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা সরকারি অফিসের কেরানী একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন সরকারি চাকুরে ছেলের কাছে। বিয়ের সময় নগদ অর্থ, ঘরের জিনিসপত্র সবই দিয়েছিলেন। এমনকি মাঝেই মাঝেই স্বামীর চাহিদামতো নগদ অর্থ বাবার বাড়ি থেকে সালমা বেগম তার স্বামীকে এনে দিতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবা এক্সিডেন্ট করার পর চাকুরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়। তাই সংসারের অবস্থাও নাজুক হয়ে যায়। কারণ তাদের পরিবারে আর উপার্জনক্ষম কেউ নাই। তাই সালমা আর তার স্বামীর চাহিদামতো টাকা এনে দিতে পারে না। এজন্য প্রতিনিয়ত তাকে মারধর, অত্যাচার সহ্য করতে হয়। সালমা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, “যদি ঐ সময় বাবা-মা তাকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে না দিয়ে ঐ টাকা দিয়ে পড়াইতো, তাহলে আজ চাকরি করতাম টাকা উপার্জন করতাম। এতো কষ্ট সইতে হতো না।”

আমাদের সমাজের অধিকাংশ মেয়েরই সালমা বেগমের মতোন কথা। আমাদের আশেপাশে তাকালেই আমরা দেখতে পাই যে এমন অনেক নারী আছেন যারা অনেক অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসার করছে, কারণ তাদের যাওয়ার জায়গা নাই। এমনকি নিজেরাও কিছু করতে পারছে না। কারণ তাদের পড়ালেখা নাই। তারা আত্মনির্ভরশীল নয়। আর সে কারণে সাহসও করে উঠতে পারে না। কিংবা সেই পরিবেশও তারা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যৌতুকের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১২৭টি, নির্যাতনের শিকার ৯০জন, আত্মহত্যা করেছেন ৮০জন। এই পরিসংখ্যান দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারের কাছে যৌতুক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। যদিও সরকার আইন করে যৌতুক নিষিদ্ধ করেছে, সেইসাথে মেয়েদের শিক্ষাও বাধ্যতামূলক করেছে, তারপরও ‘উপহার’ দেয়ার নামে পাত্র এবং পাত্রীপক্ষ উভয়ই ‘যৌতুক’ প্রথা এখনও বহাল রেখেছে। আর মেয়েরাও শিক্ষার দৌড়ে হয় পিছিয়ে পড়ছে, নয়তো ঝরে পড়ছে। বেশিদূর এগোতে পারছে না আবার বাল্যবিবাহের কারণে। এ আরেক মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মতোন সমাজে বিদ্যমান।

এমন অনেক ঘটনার কথা জানি যে ছেলের বিয়ে দিয়ে যৌতুক নেয়াটা অনেক পরিবার উপার্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনকি অনেক ছেলের বাবা তার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে যৌতুক নিয়ে ঐ টাকা আবার তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দিচ্ছে। অভিভাবকদের এইটা একটা কৌশল। তাদের মনে এক বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে যৌতুক না দিলে মেয়ের ভালো বিয়ে হবে না। এমনকি তারা ভাবে যে যৌতুক না দিলে স্বামীর বাড়িতে তাদের মেয়ের সম্মান থাকবে না, মেয়েকে ভালোবাসবে না, কথা শোনাবে। কিছু অঞ্চলে তো এটা রীতিমতোন ‘উৎসব’ আকারেই আছে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। তারা এইটা চিন্তা করে না যে পাওয়ার অভ্যাস খুব ক্ষতিকর একটি অভ্যাস। যে অভ্যাস তৈরি হলে তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয় না। আর যখনই এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। মেয়েকে নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারাও যায়।

তাই মেয়ের অভিভাবকরা, প্লিজ যৌতুকের টাকা নয়, বরং মেয়েকে পড়ালেখা করান, চাকুরি করায় সহায়তা করুন, যেসব বাধা-বিপত্তির কারণে একটা মেয়ে চাকরি করতে পারে না বা মাঝপথে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, সেগুলোর সমাধানে বরং তৎপর হন। মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই মনে-প্রাণে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মন্ত্রণা দিন। যেনো কেউ পাশে না থাকলেও আপনার মেয়ে একাই পথ চলতে পারে। আপনার মেয়ে চাকরি করে, ব্যবসা করে উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠে।

মেয়ের অভিভাবকরা আসুন যৌতুকের টাকা দেয়ার কথা একেবারে মাথা থেকে মুছে ফেলি, তার চেয়ে বরং আমরা আমাদের মেয়েকে স্বাবলম্বী করি।

শেয়ার করুন: