ডমিটিলা চুঙ্গারা এবং নারীবাদী আন্দোলন

ইমতিয়াজ মাহমুদ:

(১)

ডমিটিলা চুঙ্গারার কথা জানেন তো? পুরো নাম ইংরেজিতে Domitila Barrios De La Chungara, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ার আন্দেজ এলাকার আদিবাসী নারী। যে এলাকায় ডমিটিলার বাস, সেটা ছিল তখন খনি এলাকা। বলিভিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের কথা কে না জানে! তেল আছে ওদের, গ্যাস আছে, রূপার খনি, টিন ও এলুমিনিয়ামের খনি, আরও কতো কী! প্রাকৃতিক সম্পদের হিসাবে দেশটি এতো সমৃদ্ধ থাকলেও ওখানকার লোকজন ছিল তখন হতদরিদ্র। খনিগুলির মালিকরা ছিল বেশিরভাগই বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। ওরা বিপুল বিশাল সম্পদের মালিক। ওদের উচ্ছিষ্টভোগী একটা মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীও আছে। কিন্তু শ্রমিক আর খেটে খাওয়া সব মানুষের দিন এনে দিন খাওয়ার সামর্থ্যও নাই।

কেন? এইটাই তো পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মহিমা। সম্পদ বলেন, অর্থ বলেন, বিত্ত বলেন, সবকিছুই ভোগ করবে লুটেরারা। আর সাধারণ মানুষ আর শ্রমজীবী মানুষের ভাগে থাকবে নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যে যতটুকু দরকার তার চেয়ে একটু কম। রাষ্ট্র বলেন, সরকার বলেন, আইন বা আদালত বলেন অথবা পুলিশ মিলিটারি যতকিছু আছে, সবারই কাজ হচ্ছে ঐটা বজায় রাখা। শ্রমজীবীর মানুষ যে পেট ভরে খেয়ে থাকার মতো মজুরি না পায়। আমাদের দেশে দেখেন না? গার্মেন্টস বাণিজ্যের বার্ষিক ভল্যুম, জাতীয় অর্থনীতিতে তার অংশ ইত্যাদি হিসাব করেন, আর সাথে শ্রমিকদের মজুরি দেখেন। হিসাব মিলে? ঐটুকু মজুরিও আবার নিয়মিত পায় না শ্রমিকরা। আরেকটু মিলিয়ে নেন, গার্মেন্টস শ্রমিকরা যদি বকেয়া বেতনের জন্যে একটা মিছিলও বের করে ওদেরকে পেটানোর জন্যে এই রাষ্ট্রে আবার আলাদা পুলিশ আছে- ওদের কাজই হচ্ছে শ্রমিক পেটানো।

ডমিটিলাদের এলাকাটা টিন ও রূপা খনির এলাকা। ষাটের দশকের কথা বলছি। খনি শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছে। কেননা যে মজুরি ওদেরকে তখন দেওয়া হচ্ছিল সেই মজুরিতে পেট চলে না। খনি শ্রমিকদের ইউনিয়ন আন্দোলন ডেকেছে- ধর্মঘট হচ্ছে বিক্ষোভ ইত্যাদি হচ্ছে। বলিভিয়ায় তখন সামরিক শাসন। ওরা শ্রমিকদের দাবি মানবে না। শ্রমিকদেরকে প্রায়ই লাঠিপেটা করে আর ধরে ধরে জেলে পুরে রাখে। এইরকম চলতে চলতে দেখা গেল যে ওদের এলাকায় কর্মক্ষম পুরুষদের একটা বড় অংশ জেলখানায় বন্দী। শ্রমিকদের ইউনিয়ন তখন একরকম অসহায়, কোন কর্মসূচি করতে পারে না- লোকজন তো সব জেলে আটক, কর্মসূচি করবে কে? তখন নারীরা এগিয়ে এলো কারাবন্দী শ্রমিকদের মুক্তির দাবিতে।

(২)
১৯৬১ সালে ডমিটিলার এলাকায় নারীরা গঠন করে Housewives Committee বা গৃহবধূদের কমিটি। সেসময় নারীদের একটা অংশ বাইরে কাজ করতো বটে, কিন্তু শ্রমিকদের ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডে ওদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। ইউনিয়নগুলির নেতৃস্থানীয় পদ তো দূরের কথা, নারীদের মধ্যে ইউনিয়নের সদস্যও খুব একটা ছিল না। এই গৃহবধূদের কমিটি তখন ইউনিয়নের বদলে নিজেরাই কর্মসূচি হাতে নেয়- কারাবন্দী শ্রমিকদের মুক্তির দাবীতে খনি এলাকা থেকে ওরা শোভাযাত্রা নিয়ে যাবে লা পাজে। ওদের এলাকা থেকে রাজধানী লা পাজের দূরত্ব ২০০ মাইলের মত। এই দুইশ মাইল পার হয়ে কয়েক হাজার নারীর সেই শোভাযাত্রা যখন রাজধানীর উপকণ্ঠে পৌঁছেছে, ওদেরকে আটকে দিয়েছে পুলিশ আর মিলিটারিরা। নারীরা সেখানেই অবস্থান নিতে চেয়েছে, সৈন্যরা ওদের উপর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে, লাঠিচার্জ করেছে। কোন অত্যাচারই নারীদের আন্দোলন থামাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ওরা মুক্ত করে এনেছে কারাবন্দী শ্রমিকদের।

ডমিটিলা চুঙ্গারা একদম প্রথম থেকে এই আন্দোলনের সাথে ছিলেন না। গৃহবধূদের কমিটি যখন হয় তখন তিনি যিহোভা’স উইটনেস করেন। যিহোভা’স উইটনেস হচ্ছে খৃস্টান ধর্মের একটা অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা- ওদের কর্মীরা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে দরোজায় দরোজায় গিয়ে ধর্ম প্রচার করে। সেই কাজ করতেন ডমিটিলা। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেও ঐসব ধর্মীয় কাজের অসারতা বুঝতে পারলেন আর সেইসব ছেড়েছুঁড়ে গৃহবধূদের কমিটিতে যোগ দিলেন। ডমিটিলার নেতৃত্বে গৃহবধূদের কমিটির আন্দোলন আর সেই সাথে খনি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গতি লাভ করে। বলিভিয়ার শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণই কেবল নয়, সাধারণভাবে বলিভিয়ার রাজনীতিতেও নারীদের মতামতের পথ সুগম করে নেয় সেখানকার নারীরা। আর কেবল বলিভিয়াই নয়, বলিভিয়ার বাইরেও সারা দুনিয়া জুড়ে নারী মুক্তির আন্দোলনেও ডমিটিলা চুঙ্গারা একজন উল্লেখযোগ্য নেত্রী।

কিন্তু ডমিটিলা চুঙ্গারা এবং তাঁর গৃহবধূদের কমিটির এই আন্দোলনের পথ খুব একটা সুগম ছিল না। বাধা এসেছে। বাধা এসেছে সরকারের দিক থেকে, লুটেরা পুঁজির মালিকরা ঠেকাতে চেয়েছে নারীদের। এগুলি তো আছেই। বাধা ওদের নিজেদের মধ্যে থেকেও এসেছে- পুরুষ শ্রমিকরা এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ডমিটিলার সহযোদ্ধারা ওরাও সহজে নারীদেরকে মেনে নেননি। আর সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ, ওরা তো আছেই।

নারীদের সংগ্রাম মানেই তো হচ্ছে একই সাথে দুইটা ফ্রন্টে লড়াই। নারীরা যখন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করতে যায়, তখন তাকে একসাথে দুইটা লড়াই করতে হয়। একটা হচ্ছে নারীর অধিকারের লড়াই, আর আরেকটা হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। কেননা নারীর প্রতি শোষণের মাত্রাটাও যে সেইটাই- এমনিতে শ্রমিক হিসাবে শোষণ আবার শ্রমিকদের মধ্যেও নারী হিসাবে শোষণ। শোষকরা তো শোষণ করেই, সেইসাথে পুরুষ শোষিতরাও আবার নারী প্রতি বৈষম্য করে, বঞ্চনা করে, প্রহসন করে। ফলত নারীকে লড়তে হয় একই সাথে দুইটা লড়াই বা একই লড়াই দুইটা আলাদা ফ্রন্টে। ডমিটিলা চুঙ্গারা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে। বাধা এসেছে দুইভাবেই। কেবলমাত্র নারী বলেই ওদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে বাড়তি একটা প্রতিবন্ধকতা।

(৩)
আর নারী যখন সংগ্রামে নামে তখন বাধাটা কীভাবে আর কী রূপে আসে সেটা তো আমাদের অজানা নয়। কেননা নারীরা যখন অধিকারের কথা বলে তখন শত বছরের জেঁকে বসা জগদ্দল পুরুষতন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে কী কী সব হাতিয়ার ব্যবহার করে সে তো আমরা জানিই। ডমিটিলা চুঙ্গারা নিজে সেটার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর Let Me Speak বইতে।

ডমিটিলা বলছেন, আমরা যখন ট্রেড ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক দল করতে যাই তখন অনেক নারীও আমাদেরকে সমালোচনা করেছে। ওরা বলতো, ‘এইসব অলস মেয়েমানুষের কি আর কিছু করার নাই? ওরা কেন ঐসব কাজকর্মে নাক গলাতে যায়?’ এভাবে এমনকি নারীরাও আমদেরকে সমালোচনা করেছে। কেননা শুধু বলিভিয়াতেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই জন্ম থেকেই মেয়েদেরকে এইভাবেই বড় করা হয়েছে। ইতিহাসে যুগে যুগে নারীরা দেখিয়েছে যে নারীরা পুরুষের মতোই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ দেওয়ার যোগ্যতা রাখে। নারীরা দেখিয়েছে যে ওরা পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রেও অংশ নিতে পারে। তিনি বলছেন, বলিভিয়ার আইনে নিশ্চয়তা দেওয়া আছে যে নারীরা সকল কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু আবার ওরাই নারীদের কথা ভুলে যায়। নারীদেরকে ওরা দেখে ময়লা টেবিল পরিষ্কার করার একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতোন। যে ন্যাকড়া ময়লা টেবিল পরিষ্কার করার জন্যে ব্যবহার করার পর সেটা আবার লুকিয়ে রাখা হয় ঘরের কোন একটা কোণায়।

নিজের দলের লোকজনের আচরণ নিয়েও বলেছেন ডমিটিলা। তিনি বলছেন, আমরা যখন ট্রেড ইউনিয়ন করতে যাই, আমাদের সংগঠনের মধ্যেও আমাদেরকে অনেকবার বলা হয় অলস অকর্মা! অনেক সময় বলা হয় যে আমরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে যাই নেতাদের সাথে প্রেম করার জন্যে! এমনকি নেতাদের অনেকের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যায়, ওরা মনে করে যে ওদের সাথে ফ্লার্ট করার জন্যেই যেন মেয়েরা ইউনিয়ন করতে যায়। অনেক কমরেডরা বলেন যে নারীদের আরও বেশি বেশি করে ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেওয়া দরকার। কিন্তু পরে আর সেকথা মনে থাকে না।

(৪)
নারী অধিকার আন্দোলন বা নারীমুক্তির আন্দোলনের নেতা হিসাবে ডমিটিলা চুঙ্গারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারী অধিকার কর্মীদের সাথে বা নারীবাদীদের সাথে বিভিন্ন সভা সমিতিতে ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন, মতবিনিময় করেছেন, মেলামেশা করেছেন। পশ্চিমা নারীবাদীদের প্রসঙ্গে ডমিটিলার অভিজ্ঞতা ও মতামত খুব যে মধুর ছিল সেকথা বলতে পারছি না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ থেকে সারা দুনিয়াব্যাপি আন্তর্জাতিক নারী দশক পালন করা হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের নারী দশক কর্মসূচির সূচনার দিকে মেক্সিকোতে একটা সম্মেলনে বক্তৃতা করতে গেছেন তিনি। সেই সম্মেলনের অভিজ্ঞতা থেকে যেসব কথা বলেছেন সেগুলি বেশ কৌতূহল জাগানিয়া কথা- সেই কথাগুলি বলার জন্যেই এবং সেগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্যেই এই লেখাটার অবতারণা।

তিনি বলছেন যে মেক্সিকোর সেই সম্মেলনে তিনি দুই ধরনের নারীমুক্তির ধরন দেখেছেন। প্রথম ধরনটা হচ্ছে তারা যারা মনে করেন যে নারীমুক্তি হবে তখনই যখন পুরুষদের যত দোষত্রুটি আছে নারীরাও ঠিক সেগুলি করতে পারবে। এটাকে নাকি বলে ফেমিনিজম। এর মানে হচ্ছে নারীকে লড়তে হবে পুরুষের মত নানারকম মন্দ কাজ করার অধিকারের জন্যে। যেমন পুরুষরা যেমন প্রকাশ্যে বিড়ি সিগারেট ফুঁকতে পারে বা মদ খেতে পারে, নারীদেরও সেই একই কাজ করার অধিকার থাকতে হবে। যেমন ওরা সেই সম্মেলনে বলেছেন যে, ‘একজন পুরুষ যদি আজ রাতে বাইরে যায় আর নানারকম ফুর্তি টুর্তি করে তাইলে আমারও অধিকার আছে আগামীকাল বাইরে যাওয়ার আর সেই একই কাজ করার’ ইত্যাদি। এই লাইনের ফেমিনিস্টরা হচ্ছে আমেরিকানরা, যারা সাধারণত স্বচ্ছল এবং সম্পদশালী। ওদের সবকিছু আছে, এখন পুরুষদের বদভ্যাসগুলি নকল করতে চায়।

আরেকদল আছে সেইসব নারীরা যারা মানুষ হিসাবে মর্যাদা চায়, যারা রাজনীতি, শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি বা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চায়, সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে চায়। যাদের কাছে মুক্তি মানে আমাদের মতামত যেন ঘরে-বাইরে সর্বত্র সম্মানের সাথে দেখা হয়।

ডমিটিলা ঐসব রোটারি ক্লাব, লায়ন মহিলা ক্লাব বা সেরকম যেসব নারীদের সংঘ সমিতি আছে সেগুলির উদাহরণও দিয়েছেন। এরা নারীদেরকে নানারকম টুকটাক বৈষয়িক সাহায্য সহযোগিতা করে, শিশুদের জন্য ছোটখাটো কল্যাণমূলক কাজে কিছু টাকা খরচ করে। এদের কর্মকাণ্ডে সাধারণত সরকারও অনেক সহায়তা করে। নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারগুলি যেমন লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে, এদের কাজে সরকার সেরকম কোন বাধা তো দেয়ই না, বরং উৎসাহই দেয়। কেন? কেননা এরা তো অধিকারের কথা বলে না, একটু কল্যাণমূলক কাজ করে একটা মহান ভাব নেয় ইত্যাদি। এইসবের ফলে চূড়ান্ত বিচারে লাভ হয় কার? লাভ হয় সেইসব পুঁজিপতিদেরই, যারা আমাদেরকে শোষণ করে।

(৫)
ডমিটিলা চুঙ্গারা রাজনৈতিক মতামতের দিক থেকে মার্ক্সবাদী ছিলেন।

ডমিটিলা চুঙ্গারার কথাগুলি কৌতূহল জাগানিয়া বলছি কেননা এই যে তিনি পশ্চিমা নারীবাদী বিশেষ করে আমেরিকান নারীবাদীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক লাইনের যে পার্থক্য টেনেছেন সেটা তো আপনি ফেলে দিতে পারবেন না। আপনি যদি নারীমুক্তির কথা বলেন, সেটার সোজা অর্থ হচ্ছে বৈষম্য ও শোষণ থেকে নারীদের মুক্তি। শোষণমুক্তির কথা যখন বলবেন, তখনই তো চলে আসে খেটে খাওয়া মানুষের উপর পুঁজির শোষণ বা দরিদ্র মানুষের উপর ধনীর শোষণ। শোষণের শিকার তো নারীরা একা হয় না- নারীরা যেমন শোষিত হয়, পুরুষরাও শোষিত হয়। সুতরাং শোষণমুক্তি তো নারীর একা হবে না। শোষণমুক্তি মানে পুঁজির শোষণ থেকে বা ধনিকের শোষণ থেকে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি। সেই কারণে শোষণমুক্তির লড়াইটা নারী ও পুরুষকে সমানভাবে একসাথে করতে হয়।

নারীকে যে লড়াইটা আলাদা করে করতে হয় সেটা হচ্ছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। বৈষম্যের উৎসটা কী? বৈষম্যের উৎস হচ্ছে পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র নারীকে পুরুষের সমান মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেয় না- নারীকে মনে করে পুরুষের মালিকানার বস্তু। পুরুষতন্ত্রের চোখে নারী হচ্ছে পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ বা ঊনমানুষ। এইটাই হচ্ছে বৈষম্যের মূল। বৈষম্যের বিধানগুলি আপনি পাবেন হাজার বছর ধরে চলে আসা ধর্মের বিধান, আইনে, নীতিতে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি বিধানে। বৈষম্যের প্রতিফলন দেখতে পাবেন ভাষায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে সর্বত্র। এইজন্যে নারীর এই লড়াইটা, অর্থাৎ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা একান্ত নারীর লড়াই। এইখানে নারীর সাথে একই সাথে শোষিত যারা তারাও অনেক সময় নারীর প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে।

শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এই দুইটা আবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শোষণের বিরুদ্ধে যদি জয়লাভ করতে না পারি আমরা, বা একটা শোষণহীন সমাজ যতদিন পর্যন্ত না আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, ততদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষের বৈষম্যও দূর হবে না। এইখানেই পশ্চিমা নারীবাদীদের সাথে ডমিটিলা চুঙ্গারা এবং দুনিয়াব্যাপি তাঁর যেসব কমরেডরা আছেন, তাঁদের পার্থক্য। পার্থক্যটা মৌলিক। মার্ক্সবাদী বা সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থী নারী আন্দোলন কর্মীরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই আর নারীমুক্তির লড়াইকে একসাথে যুক্ত করে দেখেন। আর শোষণমুক্তি মানে তো হচ্ছে পুঁজির শোষণ থেকে মুক্তি।

অপরদিকে পশ্চিমা নারীবাদীরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখেই নারীমুক্তির কথা বলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যদি বজায়ই থাকে তাইলে তো শোষণ থেকে মুক্তি হচ্ছে না। পুঁজিবাদ যদি বজায়ই থাকে তাইলে নারী তো কোন না কোনোভাবে পণ্যই থেকে গেল। তাইলে বিশ্বের বৈষম্য দূর করবেন? শুধু একসাথে বিড়ি সিগারেট মদ খাওয়া বা ঐরকম সব কাজে পুরুষের সমান হওয়ার অধিকার?

(৬)
ডমিটিলা চুঙ্গারার কথা ধরে নারীবাদীদের মধ্যে এই পার্থক্যটার কথা বলার জন্যেই এই লেখাটা। কিন্তু এই পার্থক্যের কথা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি যে মার্ক্সবাদী বা সমাজতন্ত্রী নারীবাদীরা ছাড়া অন্য নারীবাদীরা যেসব আন্দোলন ইত্যাদি করেন সেটাও কোন না কোনোভাবে নারী অধিকারেরই আন্দোলন। এই দুই ধরনের নারীবাদীদের মধ্যে চূড়ান্ত বিচারে একটা ঐক্যও এক অর্থে আছে। সেই ঐক্য ও তার প্রয়োজনীয়তার কথাও আমাদের বিবেচনা করা দরকার। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও আমাদের মতো অন্যান্য দেশগুলির ক্ষেত্রে সেইধরনের ঐক্য তো আসলেই জরুরি।

সেইটাই আমরা অন্বেষণ করবো। সেই লক্ষ্যে এর পরের কিস্তিতে আমরা পিঙ্ক চাড্ডি আন্দোলনটাকে উদাহরণ ধরে একটা আলোচনা করবো এবং তৃতীয় কিস্তিতে গিয়ে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা অন্বেষণ করবো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.