‘আত্মহত্যা কখনই ক্রাইম বা অপরাধ না’

গুলশান কিবরিয়া:

আত্মহত্যা কোন অপরাধ নয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে হয়তো এই ধূসর দুঃখ জগত থেকে মানুষকে বের করে আনা সম্ভব।

The Suicide Act 1961 কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত আত্মহত্যা ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে বেআইনি এবং অপরাধ ছিল। কেউ যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতো এবং সেটা যদি প্রমাণিত হতো তবে তাকে কারাবাস দেয়া হতো, অথবা জরিমানা করা হতো। আর যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করতো সে মরে গিয়েও নিষ্কৃতি পেতো না। তার অপরাধের দায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের উপর আসতো আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই। তাছাড়া সামাজিকভাবে ঘৃণিত হওয়ার ব্যপার তো আছেই।

আত্মহত্যাকে পৃথিবীর উন্নত একটি দেশ ইংল্যান্ডই অপরাধমূলক দায় অথবা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেই ধরে নিতো আজ থেকে ৬০ বছর আগ পর্যন্ত। এখনও অনেক অনুন্নত এবং স্বধর্মপরায়ণ জাতি এই আত্মহত্যাকে অপরাধ এবং বেআইনি বলেই ধরে নেয়। অথচ আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিদ্যা প্রমাণ করেছে যে আত্মহত্যাকারী অথবা আত্মহত্যায় প্রচেষ্টাকারীর মানসিক অবস্থা একজন স্বাভাবিক মানুষের অবস্থার মতো নয়। এটা এক প্রকার মানসিক অসুস্থতা, অপরাধ নয়। এর জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন, জেল জরিমানা নয়। অপরাধ করার জন্য একজন মানুষের যে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা থাকে সেটা আত্মহত্যার চিন্তাকারীর থাকে না।

অনেকেই তাই প্রস্তাব করছে ‘Commit suicide’ এর পরিবর্তে ‘die by suicide’ ব্যবহার করার কথা। কারণ ‘Commit’ এর সাথে crime জড়িত। অথচ আত্মহত্যা কখনোই ক্রাইম বা অপরাধ নয়। আত্মহত্যাকারী অথবা আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারীকে ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি না দিয়ে অথবা মহাপাপের ভয় না দেখিয়ে মানসিক চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন । আত্মহত্যাকে ঘৃণা অথবা শাস্তি প্রদান করে আত্মহত্যাকারীকে দমিয়ে রাখা যায় না। কারন যে নিজের জীবন নেয় তার মন এমন ভাবে জটিল দুঃখ এবং সমস্যা দিয়ে মেঘাচ্ছন হয়ে থাকে যে সেটা ভেদ করে কোন প্রকার ধর্মীয় অনুশাসন, নীতি, আদর্শ কোন কিছুই পৌঁছাতে পারে না তার মনে।সে তখন এক দুর্ভেদ্য জটিল সমস্যার ভেতর দিয়ে যায়। যেখানে ঘৃণা বা শাস্তি প্রদান ভালো করার চেয়ে খারাপটাই করে বেশী।

আত্মহত্যা দুই রকম আবেগতাড়িত হতে পারে:

১। তড়িৎ আবেগের নিয়ন্ত্রণহীনতা, এবং
২। দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক অসুস্থতা (ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ইত্যাদি)

হঠাৎ আবেগের বশবর্তী হয়ে অনিয়ন্ত্রিত আবেগ অনেক সময় মানুষকে আত্মহত্যার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এই ধরনের আত্মহত্যাকে রোধ করা হয়তো একটু কঠিন। তবে দুই নম্বরটি অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে যারা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন তাদেরকে হয়তো থেরাপি অথবা কাউন্সেলিং দিয়ে সুস্থ করে আনা যায়। এরকম দুইটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছিলো যখন আমি ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি।

সেই নব্বই দশকের কথা। আমাদের পাড়ায় একটি পরিবার ভাড়া এসেছিলো আমার বাসার ঠিক সামনের বিল্ডিং এ। মেয়েটির নাম রিকি (ছদ্মনাম)। বয়স ১৬ কী ১৭ হবে। দেখতে ভীষণ সুন্দরী। তাই অতি উৎসাহী পাড়ার ছেলেরা মেয়েটির বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতে শুরু করলো। মেয়েটিও সেটা উপভোগ করতো। হয়তো কারও সাথে কোনো সম্পর্কেও জড়িয়েছিল। সমাজ এই বিষয়টি মেনে নেয়নি অর্থাৎ মেয়েটিকে ‘বাজে মেয়ে’ এবং রিকির মাকে ‘বাজে মা’ হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করতো বেশিভাগ মানুষ। রিকির মা একদিন রাগ করে মেয়েটিকে খুব বকাঝকা করে। ফলশ্রুতিতে মেয়েটি নিজের জীবন নিয়ে নেয়। এটা ছিল এক প্রকার তড়িৎ আবেগের অনিয়ন্ত্রণ। সমাজের চোখে সেই মেয়েটি জঘন্য অন্যায় করেছে আত্মহত্যা করে। তাই তার জানাজা পড়ানো হবে না বলে ঠিক হয়। কিন্তু মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড দুর্ধর্ষ মাস্তান। তাই তোপের মুখে মেয়েটির জানাজা শেষপর্যন্ত পড়ানো হয়। এই ধরনের মৃত্যুর জন্য কী আমরা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করতে পারি? আমার মতে, অবশ্যই পারি। আর এই আত্মহত্যার কন্ট্রিবিউটরি ফ্যাক্টর ছিল মায়ের বকুনি। মা বকেছে কেন? কারণ মা সমাজের চোখে ‘ছোট’ হয়ে গিয়েছে। তাই সমাজের এখানে এই আত্মহত্যার পেছনে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।

আত্মহত্যা নিয়ে কেউ আলোচনা করতে চায় না। কারণ আলোচনা করলেই ভাবে এটাকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। অথচ আধুনিক মনোবিজ্ঞান অন্য কথা বলে। এটা যে পাপ নয় এবং এরকম চিন্তা আসাটাও যে অস্বাভাবিক নয়, সেটা হয়তো আমাদের সমাজ এখনও মেনে নিতে পারে না। এরকম আত্মহত্যার চিন্তা করা স্বাভাবিক এবং অন্যায় নয় – এরকম বললে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারী তার মনের এই অসুখ তার প্রিয়জন অথবা কাছের মানুষকে শেয়ার করবে এবং প্রয়োজন বোধে সঠিক চিকিৎসাও নিতে আগ্রহী হবে। তবেই আত্মহত্যা হয়তো কিছুটা রোধ করা যাবে। এজন্যই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টানো খুব জরুরি এরকম অকালে ঝরে যাওয়া প্রাণগুলোর জন্য।

ইংল্যান্ডে সুইসাইড হটলাইন রয়েছে, যেখান থেকে মানুষ ২৪/৭ কথা বলতে পারে যদি সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামারিতান্স (Samaritans)। যখন মানুষ ইমোশনালি অনেক ডাউন ফিল করে এবং আত্মহত্যার চিন্তা আসে তখন তারা তাদের মনের চিন্তাকে অন্য আরেকজনের সাথে শেয়ার করে অনেক সময় অনেক হালকা হয়। কিছু কিছু সময় ঐ ধূসর জট বাঁধানো দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসতেও সক্ষম হয় তার মনের অবস্থা অন্যের কাছে শেয়ার করে। কিন্তু আমাদের বাঙালী সমাজ এই ধরনের চিন্তার কথা কাউকে শেয়ার করলে উল্টা ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়ে দেয়।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সকলের উচিৎ আত্মহত্যাকারী, আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারী অথবা এরকম চিন্তাকারীকে ঘৃণা না করে মানসিক ভাবে সাহায্য করা এবং প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা।

গুলশান কিবরিয়া

আইনজ্ঞ এবং লেখক।

শেয়ার করুন: