শাহমিকা আগুন:
সুশান্ত এর টিশার্ট আমার নজর কাড়লো। এতে লেখা আছে সাইকো। কে সাইকো ওর কাছে? পুরো পৃথিবীর মানুষ? নাকি ও নিজেকে নিয়ে অন্যরকম ভাবতো? কৈশোরে মা হারা ছেলে। পৃথিবীর সব রং হয়তো তখন থেকেই বিবর্ণ হতে শুরু করেছিল ওর কাছে। বেশিরভাগ মানুষই প্রিয় মানুষ, প্রিয় জিনিস, প্রিয় সংসার হারানোর শক থেকে বের হতে পারে না। মানুষের অবচেতন মন দীর্ঘমেয়াদী শোকের ভারে ন্যুব্জ হতে থাকে।
এক সময় আমি নিজেও আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। পুলিশ আর উইমেন রেফুজি কর্মীদের কারণে পারিনি। আমার স্বামী ছুঁড়ে ফেলে দেয়াতে সেই শক নিতে পারিনি তখন। আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা যত্নের সংসার আমার থাকলো না! কিছু কাছের মানুষের প্রতারণা সব বদলে দিল। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মৃত্যুই সব সমাধান। আমি তখন ছিলাম হেরে যাওয়া একজন মানুষ। রিস, আমার ছেলে। আমার সব খারাপ সময়, ভালো সময়ের সঙ্গী। ইংল্যান্ডে যে মা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তার কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে যাওয়া হয়। আমি নিজে সোশ্যাল সার্ভিসে কাজ করেছি। আমি জানতাম। আমার ছেলের জন্য আমি জীবন দিতে পারি। সারাদিন রেফুজ কর্মী, সিসিটিভি এর কারণে অন্যমনস্ক থাকতাম। কিন্তু রাত হলে নিজের মাথা এসে চেপে ধরতো। বলতো, তুই একটা ফেইলিওর। তুই বেঁচে কী হবে? মরে যা।
একরাতে নিজের গলা নিজে চেপে ধরেছিলাম। শ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। জ্ঞান হারিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল সে রাতে আমি গডকে দেখেছি। কথা বলেছি। রিস পাশের বিছানায় শোয়া ছিল। এতো ছোট শিশুটি জানতো না পাশের বিছানায় তার মা তাকে ছেড়ে চলে যাবার কী নীল নকশা করছিল! পরদিন যখন জ্ঞান ফিরে দেখলাম বেঁচে আছি, রিসের দিকে তাকিয়ে অনেক কাঁদলাম। আজ এই অবুঝ শিশুটি জেগে উঠে ওর মাকে মৃত পেতো! কী হতো ওর! বুঝতে পারলাম আমার সব প্রশিক্ষণ, অর্জন, জ্ঞান বৃথা হয়ে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে রেফুজ কর্মীর পায়ে পড়লাম। স্বীকার করলাম। আমাকে বাঁচাও! প্লিজ …
অনেক সময় লেগেছিল ঠিক হয়ে ফেরত আসতে। নিউট্রিশন নিয়ে মাস্টার্স পাশ করলেও আমি ইংল্যান্ডে প্রথম প্রফেশনাল চাকরি করেছিলাম কাউন্সিলে ইকুয়ালিটি এন্ড ডাইভারসিটি বিভাগে প্রজেক্ট কোঅরডিনেটর হিসেবে। কমিউনিটির মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ। অনেক প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। আমার কাজ এতো ভালো ছিল যে কাউন্সিল আমার ছবি ও প্রোফাইল তাদের ওয়েবসাইটে রাখলো। তারপর চাকরি পেলাম সরকারি হাসপাতালে শিশু পুষ্টিবিদ হিসেবে। এরপর কাজ করলাম পুষ্টিবিদ হিসেবে ইটিং ডিসওর্ডার ও এনরকজিয়া বিভাগে। এর মাঝে আমার পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। সময় সামলানোর জন্য তারপর আবার ফিরে গেলাম কাউন্সিলে। ড্রাগ এডিকট ও এলকোহলিক বাচ্চাদের জন্য পুষ্টিবিদ হিসেবে সোশ্যাল সার্ভিস এর এক প্রজেক্টে। এর মাঝে অন্য কাজও ছিল। যেমন কেয়ারার, কেয়ার হোমের সুপারভাইজার, ওজন ম্যানেজমেনট প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে।
এসব কাজের কারণে অনেক অনেক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল।
সবকিছু ভালো চলছিল। এর মাঝে ছেলের অটিজম ধরা পড়লো। আমি ধসে গেলাম। আমার ডিপ্রেশন তখন থেকেই শুরু মনে হয়। অটিজম নিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করলাম। পিএইচডি করা বা সায়েন্টিস্ট হবার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। চারপাশে শুধু সমালোচনা। শরীর অসুস্থ হওয়া শুরু করেছিল।
সেসময় বীরাংগনা মায়েদের জন্য কাজ শুরু করেছিলাম। এতকিছু নিয়ে এই আমি দুর্বল হদয়ের ছিলাম না। কিন্তু সেই আমিও আত্মহত্যা না করার জন্য মাসের পর মাস ঔষধ খেয়েছি। নিজের মস্তিষ্কের সঙ্গে নিজের লড়াই চলছিল।
আমার সংসার করার আনন্দ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। মনে হতো বেঁচে আর কী হবে!
আমি অনেক প্রশিক্ষণ নিয়ে মস্তিষ্ককে বদলে দিয়েছি। আমার সঙ্গে অনেক মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সন্তানের কাস্টডি হারিয়েছিল। নয়তো ড্রাগ এডিকট বা এলকোহলিক হয়েছিল। নয়তো পতিতাবৃত্তি বেছে নিয়েছিল।
আমি আত্মহত্যার কালো থাবা থেকে নিজেকে ফেরত আনতে পেরেছিলাম। নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছি। পুষ্টিবিদ এর পাশাপাশি কিনেজিওলজিসট থেরাপিস্ট, ট্রমা রিলিজ প্র্যাকটিশনার, লাইফ কোচ হিসেবে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সফল ক্যারিয়ার নিয়ে সফলভাবে সিঙ্গেল মা হিসেবে বেঁচে আছি। ছেলেও ভালো হয়েছে।
ট্রমা রিলিজ প্র্যাকটিশনার হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে আমি প্রচুর সিভিয়ার ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার রোগীদেরকে সাহায্য করেছি স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যেতে।
আত্মহত্যার রোগীদের মধ্যে সেলফ হার্ম এর প্রভাব দেখা যায়। নিজেকে আঘাত করে। মস্তিষ্ক কারণ খুঁজতে থাকে আত্মহত্যার, কারণ তখন মস্তিষ্কের অন্য পথ খুলে যায়। করটিসল বাড়তে থাকে, ডোপামাইন কমতে থাকে।
এখন লকডাউনে সবাই ঘরে আটকে আছে। তাই একাকিত্ব, নিজেকে দোষারোপ করা, অনিশ্চয়তা বেড়ে গেছে। ছোট গণ্ডির মাঝে আসছে মৃত্যুর হাতছানি। আমি প্রচুর রোগী পাচ্ছি যারা অনুধাবন করছে পৃথিবীতে কতো একা তারা! মনে হচ্ছে আমি বেঁচে থেকে কী হবে!
এমন কঠিন সময়ে মৃত্যুচিন্তা এলে অবশ্যই কারও সঙ্গে শেয়ার করুন। আবেগের ওপর দখল নিতে প্রফেশনাল সাহায্য নেন। শিশু কিশোরদের দিকে খেয়াল করুন। কোন ভুল করলে, ফেইল করলে না মেরে, না বকে বোঝান। ঘরে আপনার সঙ্গে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হলে আইনের আশ্রয় নেন। কিন্তু দয়া করে মরে যাবেন না। পুরুষরা কারও সঙ্গে অনেক কিছু শেয়ার করতে পারেন না। নিজের নীরবতা ভাঙ্গুন। কথা বলুন। আপনার ভয়, হতাশার কথা শেয়ার করুন। ধরেন কেউ সমালোচনা করে বললো আপনি খুব খারাপ। তো, তাতে আপনি আসলে কী কিছু হারালেন? না। কিছুই হারালেন না। যা হারাবেন তা হলো বুকের ভেতরের ভয়াবহ ভার আর স্তব্ধতা।
ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং নেন, টক থেরাপি করুন, টেপিং করুন, ট্রমা রিলিজ থেরাপি করুন। আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচুন। মুক্ত করুন নিজেকে নিজের চিন্তার কারাগার থেকে। আত্মহত্যা সমাধান নয়। জীবনকে আর একটা সুযোগ দিন। প্লিজ।